নেতা নেই, দলও নেই

বিশেষ প্রতিনিধি : হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ অসুস্থ। দলীয় কর্মকোণ্ডে তিনি অংশগ্রহণ করতে পারছেন না। জাতীয় পার্টিতে প্রশ্ন উঠেছে যে, হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ মারা গেলে জাতীয় পার্টির হাল ধরবেন কে? যদিও এরশাদ তার ভাই জিএম কাদেরকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেছেন। কিন্তু জাতীয় পার্টির নেতারাই বিশ্বাস করেন না যে, এরশাদের চলে যাওয়ার পর জিএম কাদের জাতীয় পার্টিকে অটুট রাখতে পারবেন এবং জাতীয় পার্টি একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে টিকে থাকতে পারবে। অধিকাংশ রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই মনে করছেন যে, এরশাদের প্রয়ানের মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টির প্রদীপও আস্তে আস্তে নিভে যাবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা নতুন নয় যে, ব্যাক্তিনির্ভর রাজনৈতিক দল। যখন ওই নেতা চলে যান , তখন ওই দলও বিলোপ হয়ে যায়। এরকম রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বাংলাদেশে কম নয়। যদিও একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের মূল ভিত্তি হলো তার কর্মীবাহিনী এবং নতুন নতুন মেধা। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো যে, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলই ব্যক্তিনির্ভর, নেতা নির্ভর এবং নেতা চলে গেলে দলও নিংশোষিত হয়ে যায়। এরকম রাজনৈতিক দলের উদাহরণ অনেক বেশি।

মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে ন্যাপ গঠন করেছিলেন। ন্যাপ ততদিনই কার্যকর ছিলো, যতদিন মওলানা ভাসানি বেঁচে ছিলেন। মওলানা ভাসানীর চলে যাওয়ার পর ন্যাপ ক্রমশ সংকুচিত হতে হতে এখন একটি নাম সর্বস্ব রাজনৈতিক দল হিসেবেই রয়ে গেছে। যদিও কমিউনিস্ট পার্টির একটি অংশ থেকে আরেকটি ন্যাপ তৈরী করা হয়েছিল। যে ন্যাপও এখন নাম সর্বস্ব, যার প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ অসুস্থ থাকার কারণে দলের কোন কার্যক্রম নেই বললেই চলে। সাত চল্লিশে দেশ বিভাগের পরে বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক দল ছিল মুসলিম লীগ। কিন্তু মুসলিম লীগের মূল নেতারা চলে যাওয়ার পর তা শেষ হয়ে গেছে। মুসলিম লীগের সর্বশেষ নেতা ছিলেন সবুর খান। সবুর খান চলে যাওয়ার পর মুসলিম লীগ আস্তে আস্তে নিস্ক্রিয় হতে হতে বিলীণ হয়ে গেছে। এখন এই দলটি কেবল কাগজে কলমের একটি দল হিসেবে আছে। এই দলের অন্যকোন অস্তীত্ব নেই। গণ আজাদী লীগ নামে একটি রাজনৈতিক দল ছিল, সেই গণআজাদী লীগও মূল নেতা চলে যাওয়ার পর সেটি কার্যত মৃতপ্রায় একটি রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে।

একইভাবে খুনী খন্দকার মোশতাক এবং মইনুল হোসেনের গঠন করা ডেমোক্রেটিক লীগও কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে নেতৃত্বশূন্যতার কারণে। জাতীয় পার্টিসহ এখন বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক দল আছে এগুলোর মূল নেতারা চলে গেলে এই দলগুলো কতিদন থাকবে বা আদৌ থাকবে কিনা এ নিয়েও রাজনৈতিক অঙ্গনে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। যেমন আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জেপি দলটির আনোয়ার হোসেন মঞ্জুই একমাত্র নেতা এবং তাঁকে কেন্দ্র করেই সবকিছু পরিচালিত হয়। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত রাজনৈতিক দলটি নাজমুল হুদা সর্বস্ব, এবং এই দলের অন্যকোনো দ্বিতীয় নেতা খুজে পাওয়া যাবে না। রাশেদ খানের নেত্ররত্বে ওয়ার্কার্স পার্টিও একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। মেনন চলে যাওয়ার পর এই দলের অস্তিত্ব থাকবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কাদের সিদ্দীকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগও ব্যাক্তি নির্ভর রাজনৈতিক দল। তিনি চলে যাওয়ার পর এই দলের অস্তিত্ব থাকবে কিনা তা কেউ জানে না। ডঃ কামাল হোসেনের দল গণফোরামের কি হবে তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। যেমন প্রশ্ন রয়েছে আসম আব্দুর রবের নেতৃত্বাধীন জেএসডির পরিণতি নিয়ে। এমনকি দিলিপ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন সাম্যবাদী দল বা হাসানুল হক ইনুর নেতৃত্বাধীন জাসদ সম্পূর্ণই ব্যাক্তি নির্ভর পারিবারিক প্রতিষ্ঠান। এই দলগুলো গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল হিসেবে বিকশিত হতে পারেনি। কাজেই এই নেতাদের চলে যাওয়ার পর এই দলগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে ভুমিকাহীন হয়ে পরবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু গনতন্ত্রকে সুসংগঠিত করার জন্য শক্তিশালী রাজনৈতিক দল দরকার। যে রাজনৈতিক দলে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব নির্বাচিত হবে। একজন নেতা চলে যাওয়ার পর অন্যজন তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে দলকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সেরকম অবস্থা এই রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেই বললেই চলে।