ধুঁকে ধুঁকে চলছে ঢাকা বিভাগের শত নদী

নিজস্ব প্রতিবেদক : দূষণ ও দখলদার কবলে পড়ে ধুঁকে ধুঁকে চলছে ঢাকা বিভাগের শত নদী। এই বিভাগে মোট নদীর সংখ্যা ১০২টি নদী। এর সব ক’টিতেই রয়েছে দখলদারদের থাবা। আর ১০০ নদীর অবস্থা করুণ। জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন এক প্রতিবেদনে এ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। কমিশন বলছে, তারা দখলের বিষয়টি সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে তাদের। সুপারিশ মেনে অন্যরা কাজ করবেন। তবে, ১০২টি নদীর মধ্যে কিছু কিছু নদী একাধিক জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। কোথাও একই নামে, কোথাও ভিন্ন নামে। ফলে একই নদীকে একাধিক নদী হিসেবেও দেখানো হয়েছে প্রতিবেদনে। কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ঢাকা বিভাগের ১০ জেলার ১০২ নদীতে ৮৪৪ বড় অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। যার বেশিরভাগই শিল্প কারখানা। নদী কমিশন প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে হাটবাজার ও শিল্প-কারখানাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এখানে সাধারণ মানুষের বসতিকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এরপরও দখলের ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। অনেক ক্ষেত্রে শিল্প মালিকরা শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছেন নদীর জমি দখল করে। ঢাকা বিভাগের ঢাকা ছাড়াও মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও গোপালগঞ্জের নদীগুলো পযবেক্ষণ করেছে কমিশন। নদী কমিশন বলছে, তারা নিজেরা কোনও কিছুই করতে পারে না। কেবল সরকারের কাছে নিজেদের সুপারিশ জমা দিতে পারে। সরকারই জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। তবে জেলা প্রশাসনের ১০টি কাজ থাকলে ১০ নম্বরেই রাখা হয় নদী দখল-দূষণ রোধকে। যদিও সম্প্রতি সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে নদী দখল দূষণ প্রতিরোধের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া নির্দেশ দিলে সংশ্লিষ্টরা তৎপর হন। ঢাকা বিভাগের ঢাকা জেলায় মোট নদীর সংখ্যা ৬টি। নদীগুলো হচ্ছে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, ইছামতি, ধলেশ্বরী ও বংশী নদী। সব নদীই দুষিত। ইছামতি নদীর তীরে ৭৫টি অবৈধ স্থাপনা আছে। ধলেশ্বরীতে ১০০ এবং বংশী নদীতে ৬০টি অবৈধ দখল স্থাপনা রয়েছে। অন্যদিকে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ২টি বাজার এবং ৮৫টি শিল্প কারখানা আছে। তুরাগ নদীর তীরে ৩টি বাজার এবং ৮টি শিল্প কারখানা, ইছামতি, ধলেশ্বরী ও বংশী নদীর তীরে ২টি করে বাজার রয়েছে। মানিকগঞ্জ: এই জেলায় নদী আছে দুটি। ধলেশ্বরী ও কালিগঙ্গা। ধলেশ্বরীর তীরে দুটি শিল্প কারখানা এবং কালিগঙ্গা নদীর তীরে ৩টি বাজার আছে। মুন্সীগঞ্জ: মোট নদীর সংখ্যা সাতটি। পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, রজতরেখা, বাংলাবাজার, চরবানিয়াল ও ইছামতি। এরমধ্যে পদ্মার তীরে ৩টি, মেঘনার তীরে ২টি, ধলেশ্বরীর তীরে ৪টি, রজনরেখার তীরে ২টি ও ইছামতির তীরে ৪টি বাজার আছে। অন্যদিকে, ধলেশ্বরীর তীরে ২৪টি, মেঘনার তীরে ১২টি ও রজতরেখার তীরে ২টি শিল্প কারখানা রয়েছে। গাজীপুর: এই জেলায় রয়েছে তুরাগ, গোয়ালা, বংশাই, শালদহ, শীতলক্ষ্যা, পারুলিয়া, মাটিকাটা, সুতীয়া, ব্রহ্মপুত্র, বানার ও বালু নদী। এরমধ্যে তুরাগ তীরে ৩টি বাজার ও ২৫ শিল্প কারখানা আছে। গোয়ালা নদীতে একটি, বংশাই এর তীরে একটি, শীতলক্ষ্যার তীরে একটি বাজার ও ৬টি শিল্প কারখানা রয়েছে। এছাড়া পারুলিয়ায় ২টি, মাটিকাটার তীরে ১টি, সুতীয়ায় ২টি, ব্রহ্মপুত্রে ৫টি ও বানার নদীর তীরে ৪টি বাজার রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ: মোট নদী ৬টি। এগুলো হলো—বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা, মেঘনা, ব্রহ্মপূত্র ও বালু নদী। এ নদীগুলোর তীরে ২৮টি বাজার এবং ১৮৮টি শিল্প কারখানা রয়েছে। কিশোরগঞ্জ: মোট নদী ৩৩টি। এর মধ্যে নরসুন্দা নদীর তীরে ১৪টি, ব্রহ্মপুত্রে ৭টি, সিংগুয়া ১টি, মেঘনায় ২টি, কালনী কুশিয়ারার তীরে ৭টি, বেতাগায় ৩টি, বেতাই ধমণীতে ৩টি, উজানধনুতে ১টি, ডুবিতে ৫টি, মগরা ১টি, সুরমায় ১টি, কালনী ৩টি, ধনু ২টি, চিনাই ১টি, উজান ধনু ১টি, সুতী নদীর তীরে ৩টি ও আড়িয়াল খা নদীর তীরে ছোট আকারের ১৫টি দোকান আছে। মাদারীপুর: মোট নদী ৪টি। এরমধ্যে আড়িয়াল খার তীরে ৫টি বাজার ও ২টি শিল্প কারখানা, কুমার নদীর তীরে ৩টি বাজার ও ৪ শিল্প কারখানা, লোয়ার নদীর তীরে ২টি বাজার ও ৩টি শিল্প কারখানা এবং টরকী নদীর তীরে ২টি বাজার রয়েছে। রাজবাড়ি: এই জেলায় নদীর সংখ্যা ১০টি। এরমধ্যে নদীর তীরগুলোয় ২টি বাজার, ৩টি হাট এবং ৩৫টি দোকান রয়েছে।এই নদীগুলোর তীরে শিল্প কারখানা নেই। তবে বাজার আছে। ফরিদপুর: জেলায় মোট নদীর সংখ্যা ১১টি। এরমধ্যে কুমার নদীর তীরে ২১টি বাজার, চান্দনা বারশিয়া নদীর তীরে ৬টি বাজার ও ২ শিল্প কারখানা, গড়াই নদীর তীরে ২টি শিল্প কারখানা, মারকুমান নদীর তীরে ১০টি বাজার এবং পদ্মা নদীর তীরে ৮টি বাজার রয়েছে। গোপালগঞ্জ: জেলায় মোট নদীর সংখ্যা ১২টি। এরমধ্যে এই ৯টি বাজার আছে। তবে কোনো শিল্প কারখানা নেই। নরসিংদী: জেলায় মোট ৭টি নদী রয়েছে। তবে এসব নদীর তীরে কোনেও অবৈধ স্থাপনা নেই। এই বিষয়ে কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘প্রতিবছরের মতো এবারও আমরা আবার নতুন করে প্রতিবেদন তৈরি করছি। কাজ এখন চলমান রয়েছে। শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই প্রতিবেদন জমা দেওয়া সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, ‘কোন নদী কী পরিমাণ দখলের শিকার, কী কী পদক্ষেপ নিয়ে নদী দখলমুক্ত করা যাবে এবং এ পর্যন্ত কী কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা উল্লেখ করা হবে।’ মুজিবর রহমান হাওলাদার আরও বলেন, প্রত্যেক জেলা প্রশাসকের কাছে কমিশনের পক্ষ থেকে ডিও লেটার দেওয়া হয়েছে। জেলা প্রশাসকরা জেলা নদী কমিশনের কমিটির সঙ্গে বসে তার এলাকায় কী কী নদী আছে, এসব নদীর পাশে কী কী ধরনের অবৈধ স্থাপনা আছে, আর এসব স্থাপনা উচ্ছেদে কী ধরনের উদ্যোগ নেওয়া দরকার, সে বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেবে। ইতোমধ্যে কিছু কিছূ জেলা থেকে প্রতিবেদন আসতে শুরু করেছে।’ সব জেলার প্রতিবেদন পেলে কমিশনের পক্ষ থেকে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হবে বলেও তিনি জানান।