আমার কাঠগড়ায় আমি (৫ম পর্ব)

আজাদুল ইসলাম আজাদ : চতুর্থ পর্বের শেষাংশে লিখেছিলাম, আমার জীবনের ঐসময় পরপর ঘটতে থাকা কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা আমার মনের উপর প্রচন্ড আঘাত করে,একইসাথে সেগুলো আমাকে প্রভাবিতও করে ফেলে, যার ফলে খেলার মাঠের পাশাপাশি রাজনীতির প্রতি আমার আকর্ষণ তৈরী হয়ে যায়। যেমন,১৯৬৫ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলো। আমাদের বাড়ি দর্শনার দক্ষিণ পাশে, অর্থাৎ আরও একটু সীমান্তের দিকে শ্যামপুর গ্রামে। শুরু হলো সরকারের নির্দেশনায় ভারতের বিমান হামলা বা গোলাগুলির সময়ে আশ্রয় নিতে বাড়ি বাড়ি বাংকার খোড়া। সেকি আতংক আমাদের। সন্ধ্যা থেকেই ব্লাক আউট। তখন তো বিদ্যূত ছিল না, সন্ধ্যার বা রাতের আলো বলতে প্রায় সব বাড়িতে কুপি, সামর্থ্যবানদের কুপির সাথে হারিকেন। সেগুলো জ্বালানো নিষেধ হয়ে গেল। কারন রাতে দূর থেকে দেখা আলো দেখলে ভারতীয় সেনাবাহিনী মানুষের বসবাস চিহ্নিত করে গুলিবর্ষণ করতে পারে। তখন বর্ষার শেষাংশে আমরা।জানালা দরজা আটকে ভয় আর আতংকিত মনে রাস্তার পাশের বৈঠকখানায় পড়তে বসতাম ঠিকই, পড়া হতো না। কান থাকতো রাস্তায়, কারন আমাদের সৈনিক রা ঐ রাস্তা ধরেই সীমান্তে যেত যুদ্ধের জন্য তাদের আশ্রয়, ট্রেন্চ,(অর্থাৎ পুরো সীমান্তের এদিকে ২/৩ ফুট গর্ত করে লম্বা গর্তের আশ্রয়, যার ভিতর থেকে সীমানা জুড়ে পাল্টা গুলি চালিয়ে ভারতীয় আক্রমণ রুখে দেবে। সন্ধ্যার পরে যখন লাইন দিয়ে ওরা রাস্তা দিয়ে যেত দীর্ঘ সময় ধরে, শব্দ হতো পায়ের, আমি পার হওয়ার সময়টা আন্দাজ করেই মনে মনে পুলকিত হোতাম এই ভেবে যে, অনেক সৈন্য গেল, ইন্ডিয়া কিছুই করতে পারবেনা। চেষ্টায় থাকতাম সকলে মিলে হারিকেনের আলো যেন কেন জানালার ফাঁক ফোকর দিয়ে ওরা দেখে না ফেলে। তাহলেই ব্লাকআাউট ভাঙ্গার শাস্তি ভোগ করতে হবে। ঐ বয়সে সে কি উত্তেজনা আমাদের! এরা এক গ্রুপ সন্ধ্যার কিছু পরে যেত,পরদিন সকালে ওখানে আরেক গ্রুপ ওখানে যেয়ে পৌঁছালে এরা ফিরে আসতো। ২/১ দিন পর সকালে যখন এরা ফিরছে, সাহস করে বাড়ির সদর দরজার কাছে গিয়ে দেখি, এদের কমান্ডার আমাদের স্কুলের কেরানী সিরাজ চাচা। সারারাত জেগে যুদ্ধ করবে বলে ঐ মোটা ভুড়িওয়ালা মানুষটা আর ঠিকমতো তাকাতেও পারছে না, ভুঁড়ি নিয়ে সোজা হয়ে সৈনিকের মতো হাঁটতেও পারছে না। দেখি ওনার পিছনে যারা, প্রায় সকলেই তাই, সবাই এলাকারই মানুষ, তবে সকলকে তখনও চিনতাম না। সবার ঘাড়ে রাইফেল, আর গাদা বন্দুক। মনেমনে সান্তনা পাওয়ার চেষ্টা করলাম, ওনাদের শরীর না চললেও বন্দুক তো চলবে, ইন্ডিয়া পাত্তাই পাবেনা, সিরাজ চাচাদের কাছে। বাড়িতে অন্যদের কাছে জানলাম, এরা আমাদের রক্ষার জন্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত আনছার,মুজাহিদ বাহিনীর লোক। সেনাবাহিনীর দু চারজন অফিসার আছেন, তারা জীবননগর থাকেন,ওখান থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করছেন, মোকাবিলাও করবেন আক্রমণ হলে। ওদের আর রেডিওর সাহস,ভরসা সাথে ভয় আর আতংক মিলিয়ে দিন পার হচ্ছে। হঠাৎই এক মধ্যরাতে ঠাস,ঠুস গুলির আওয়াজ। আমরা ভারতীয় আক্রমণের মুখে। আব্বা মা, পাশে মেজ চাচা,মেজ মা, সকলের চেহারায় পরিবর্তন। সবাই মারাত্মক ভাবে আতংকিত। আব্বা ফিস ফিস করে বলছেন, সবাই বিছানা ছেড়ে নীচে শুয়ে পড়ো দেওয়ালের আড়াল নিয়ে। গোলাগুলি বাড়ছে, মনেই হচ্ছে ওরা আমাদের দিকেই গুলি ছুড়ছে। মা তাড়াতাড়ি ছোটবোন কে নিয়ে মেঝেতে শুয়ে লা ইলাহা পড়ছেন, আব্বাও সেরকমই। আক্তার উপুড় হয়ে পাশে শুয়ে চোখ দুটো গোল্লা গোল্লা করে আমার দিকে তাকিয়ে গুনগুন করছে, মনে হলো মার লা ইলাহা পড়াই গলা মিলাচ্ছে, আর আমি সে রাতের আমাদের কমান্ডার আব্বার মুখের দিকে আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছি ওনার পরবর্তী কমান্ডের আশায়। হায় আল্লাহ্! এভাবেই সে রাত কেটেছিল, একেবারেই আল্লাহর উপর ভরসা রেখে। পাকিস্তান সরকার এই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির জন্য, তাদের শত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্যও আমাদেরই সিরাজ চাচাদের মতে মানুষ দিয়ে ছেড়ে দিয়েছিল আল্লাহ আর আমাদের ভাগ্য বা পরিনতির উপর। আমাদের জীবনের দায়িত্ব তারা নেয়নি। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বলতে যাদের তৈরী করা হয়েছিল, তারা ছিল প্রায় সকলেই পশ্চিম পাকিস্তানের সন্তান। কিন্তু তাদের বেতন ভাতা, পোশাক, অস্ত্র সহ সবকিছুর অংশ অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর এই পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির টানতে হয়েছে। যাইহোক সে রাতের এক সময় গোলাগুলি বন্ধ হলো ঠিকই, কিন্তু কেওই আর ঘুমাতে পারিনি। একসময় সকাল হলে গুলি বাড়ির কোন জায়গায় লেগেছে নাকি খোঁজা শুরু হলো। দেখা গেল ঠিক আমাদের ঘরের সাথে যে বৈঠকখানা,তার বর্ডারের দিকের জানালার চৌকাঠে একটা বুলেট অর্ধেকটা গিথে আছে। আমি আসলেই ততক্ষণে বড়োদের আলোচনায় বুঝে গেছি ওরা আক্রমণ করলে আমাদের রক্ষা নেই।সিরাজ চাচাদের ও কাজের ক্ষমতা বা যোগ্যতা, বিশেষত ওদের অস্ত্রের মোকাবিলা করার মতো অস্ত্র, কোনটাই নেই। হতাশা গ্রাস করছে তখন কৈশোরের আমাকে। এমনই সময় আব্বা আমাকে আর আক্তারকে গোসল করে, খাওয়া সেরে রায়টা ট্রেন ধরার জন্য নির্দেশ দিলেন। কোথায় যাবো, তার চেয়ে এ বাড়ি ছেড়ে রায়টা ধরার তাগিদে তৈরী হয়ে নিলাম দু’ভাই। আব্বা সাথে করে চুয়াডাঙ্গা হয়ে নিয়ে গেলেন সরোজগন্জ, আমার বোনের বাড়ি । আমাদের রেখে আব্বা যখন ফিরে আসছেন বাড়ীর উদ্দেশ্যে, তখন কিছুক্ষনের জন্য ভয়, আতংক এবং কেমন একটা মায়ায় পেয়ে বসেছিল আমাকে। মনে হচ্ছিল, দেখা হবে তো আবার? বলতে পারিনি কিছুই। ওখানে বেশ কিছুদিন ছিলাম।সমবয়সী অনেক আত্মীয় স্বজন মিলে আনন্দেই ছিলাম, কিন্তু মনে ঠিকই প্রভাব অনুভব করতাম, যুদ্ধ হলেইতো বাড়ীর সব শেষ। আমরা থাকলে আমরাও। নানা জায়গার আলোচনা আমাকে নিশ্চিত করলো, আক্রান্ত হলে আনসার,মুজাহিদ বাহিনী দিয়ে, আর গাদা বন্দুক, কয়েকটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে কোন লাভ হবেনা। ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকলো আমার কিশোর মনে।তাহলে পাকিস্তান সরকার কি শুধুই পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য?
একসময় তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধ বন্ধ হলে বাড়িতে ফিরলাম। স্কুল খুললো,স্কুলে যেয়ে সেই রাতের অন্যদের অনুভূতির লেনদেন হলো। মনটা কেমন বিদ্রোহী হয়ে উঠছে। অথচ ঐসময়ে আমার পরিচিতি ছিল, অত্যন্ত শান্ত একটা ছেলের। এরই মধ্যে ২১ শে ফেব্রুয়ারী এলো। স্কুলের এ্যাসেম্বলিতে দেখি হটাৎ করেই দর্শনারই সন্তান তিনজন, কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের ছাত্র, ছাত্রলীগ নেতা গোলাম মোর্তজা, (পরে আমাদের স্কুলের শিক্ষক এবং আমৃত্যু আওয়ামী লীগ নেতা), সাথে একই কলেজের ছাত্র, ছাত্র ইউনিয়নের, বর্তমান চুয়াডাঙ্গা জেলা কমিউনিষ্ট পার্টির সভাপতি এ্যাডঃ শহীদুল ইসলাম, এবং খুলনা দৌলতপুর কলেজের সম্ভবত ছাত্র, ছাত্র ইউনিয়নের সৈয়দ মজনুর রহমান।শেষের দুজন এখনো জীবিত, জনাব গোলাম মোর্তজা মৃত্যুবরন করেছেন অনেক আগেই। ওনার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। ওনারা আমাদের উদেশ্যে কথা বলে ২১শের বর্ননা করে ক্লাস ত্যাগ করে মিছিলে যেতে আহ্বান করলেন। আমাদের মধ্যে দ্বিধা বিভক্তি দেখলাম। আমি নিঃসংকোচে মিছিলে যেতে আগ্রহী হোলাম। গেটের বাইরেই দেখি হুডখোলা একটা সেনাবাহিনীর গাড়ি, মনে ধরে নিলাম, এরাই যুদ্ধে আসা সে-ই অফিসার, যারা জীবননগরে আস্তানা গেঁড়ে সিরাজ চাচাদের দায়িত্ব দিয়ে নিরাপদে ছিল, আর আমরা নিরাপত্তাহীন অবস্হায় রাত পার করেছিলাম। হঠাৎই ওদের গাড়ির কাছে গিয়ে স্লোগান দিয়ে ফেললাম, আইয়ুব শাহী, মোনেম শাহী, জবাব এলো সমস্বরে ধ্বস হোক, ধ্বংস হোক। জীবনের প্রথম স্লোগান,সারা মিছিলে একইভাবে স্লোগান দিয়ে দর্শনা সব ঘুরে গার্লস স্কুলের ভিতরে জমায়েত। মজনু ভাই জিজ্ঞেস না করেই আমাকে আহ্বান করে বসলেন বক্তব্য রাখার জন্য। কোনদিনই এরকম কোন অভ্যাস নেই, তারপরও অস্বীকার না করে দাঁড়িয়ে গেলাম। কি বলেছিলাম, কেমন করে বলেছিলাম তাও বলতে পারবোনা, তবে আইয়ুব,মোনেম এর পতন দাবী করেছি আর মায়ের ভাষা বাংলা কে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দিতে দাবী করেছি। সেই শুরু, এখনো চলোমান। এরই মাঝে দারিদ্র্যের কষাঘাতে মানুষের কষ্টগুলো যেন আমার মনে নতুন মাত্রা যোগ করে দিচ্ছে, আমি আমার ভিতরে ক্রমাগতই বিদ্রোহী স্বত্তার অস্তিত্ব অনুভব করছি। একদিন স্কুলের পথে আমার বন্ধু তূল্য একজন কে দেখি,শুকনো ছোলাভাজা পকেট থেকে বের করে খাচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, সকাল থেকেই না খেয়ে সে সহ বাড়ির অন্যরাও। ভীষন প্রতিক্রিয়া হলো মনে। ভিন্ন মাত্রায় অনুভব করলাম সেদিন,। তুষের আগুনে যেন এক মগ পেট্রোল ঢেলে দিল সে।
আজ এখানেই শেষ করছি বন্ধু রা। গত পর্বের শেষাংশে লিখেছিলাম দুই একদিনের মধ্যেই পরবর্তী পর্ব লিখবো। কথা রাখতে পারিনি। লেখায় ধারাবাহিকতা রাখতে যেমন নিয়মিত পরপরই লেখা ভালো, তেমনই পাঠকের জন্যও এটা জরুরী। দূর্ভাগ্যবশত আমার বড়ো মেয়ে এবং তার ঘরে ছোট নাতনি কোভিড আক্রান্ত হয়ে গেল। আমার দুজন ছোট বেলার বন্ধু, খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু,। তারাও আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। একজন চুয়াডাঙ্গার আরেফিন। ও স্বাধীনতার পর সম্ভবত ৭৪ সালের দিকে চুয়াডাঙ্গা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। এখন পারিবারিক প্রয়োজনে বছর দুই আগে আমেরিকার অধিবাসী। আমরা এরই মাঝে একদিন একসাথে সারাদিন কাটানোর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায়। সে আক্রান্ত হয়ে অনিশ্চিত অবস্থায়, লাইফ সাপোর্টে। আরেক বন্ধু দর্শনার আমার খুব ঘনিষ্ঠ হাসমত,যে ৬৯-৭০ আন্দোলনের এক মামলায় সামরিক শাসক গোষ্ঠীর রায়ে জেল খাটছিল মুক্তিযুদ্ধের শুরু পর্যন্ত, সে পরিবারের সকলে হাসপাতালে। আমার প্রানের চুয়াডাঙ্গা জেলাবাসী কোভিডের হিংস্রতায় ক্ষতবিক্ষত। জানিনা আমাদের দেশটাও কোন পরিনতির পথে। সেকারনেই লেখা হয়নি।ক্ষমা করবেন সকলে।