১০ এপ্রিল: মুজিবনগর সরকার গঠন ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র দিবস

প্রফেসর ডাঃ মাহবুব হোসেন মেহেদী

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের আজকের দিনে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়েছিল। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বা মুজিবনগর সরকার নামে পরিচিত। ২৫ মার্চ ভয়াল কালরাত্রিতে পাকিস্তানী হানাদারদের নির্বিচারে গণহত্যা ও ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর বাংলাদেশ বহির্বিশ্বের কাছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল।

স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার মাত্র ১৫ দিনের মাথায় সরকার গঠন হবে তা অকল্পনীয় ছিল পাকিস্তানিদের কাছে। কিন্তু দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘুরে দাঁড়ায় স্বাধীন বাংলাদেশ। গঠন করা হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকার বা মুজিবনগর সরকার। এই অস্থায়ী সরকার গঠনের মধ্য দিয়েই পরিকল্পিত কায়দায় মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত ও সমন্বয় সাধন করে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ পরিচালনা ও স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায় করেছিল মুজিব নগর সরকার।
২৫ মার্চের ভয়াবহ, দুর্বিষহ গণহত্যার সময় আওয়ামী লীগের প্রধান নেতা তাজউদ্দীন আহমেদ নিজ বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপন করেন। এসময়েই মূলত তিনি বাংলাদেশ সরকার গঠনের পরিকল্পনা শুরু করেন। প্রথমে আত্মরক্ষা, তারপর প্রস্তুতি এবং সর্বশেষে পাল্টা আক্রমণ এই নীতিকে সাংগঠনিক পথে পরিচালনার জন্য তিনি সরকার গঠনের চিন্তা করতে থাকেন। এরই মধ্যে ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি ফরিদপুর কুষ্টিয়া হয়ে মেহেরপুরে চলে যান। এরপর ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ৩১ মার্চ মেহেরপুরের সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। সীমান্ত অতিক্রম করার পর বিএসএফ এর মহাপরিদর্শক গোলক মজুমদার তাদের যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শনপূর্বক তাদের নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। গোলক মজুমদারের কাছে সংবাদ পেয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক কেএফ রুস্তামজী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন এবং পূর্ববাংলার সার্বিক পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়ে জানতে চান। কিন্তু সীমান্তে পৌঁছে তাজউদ্দীন দেখলেন বেঙ্গল রেজিমেন্টের বিদ্রোহী সেনাদের সমর্থনে ভারত সরকার থেকে নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ভারতীয় সামরিক বাহিনী এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কিছু করার নেই।
এরপর মুক্তিবাহিনী গঠনের ব্যপারে তাজউদ্দীন আহমদ বিএসএফ এর সাহায্য চাইলে বিএসএফ প্রধান তাকে বললেন মুক্তিসেনাদের ট্রেনিং এবং অস্ত্র দেওয়া সময়সাপেক্ষ কাজ। ট্রেনিংয়ের বিষয়ে তখন পর্যন্ত ভারত সরকারের কোন নির্দেশ না থাকায় তারা মুক্তিবাহিনীকে ট্রেনিং ও অস্ত্র দিতে পারবেন না। এরপর  কেএফ রুস্তামজী দিল্লির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হয় তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে  যাওয়ার জন্য।
দিল্লিতে পৌঁছানোর পর মূলত ভারত সরকার বিভিন্ন সূত্র থেকে নিশ্চিত হয়, তাজউদ্দীন আহমদই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী। এ সময় ভারত সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের কয়েক দফা বৈঠক হয়। তাজউদ্দীন আহমেদ পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার কথা ও এবং এজন্য ভারতের সাহায্যের প্রয়োজনের কথা তাদের বলেছিলেন।


এক পর্যায়ে  তিনি উপলব্ধি করেন যে আওয়ামী লীগের একজন নেতা হিসেবে তিনি যদি সাক্ষাৎ করেন তবে সামান্য সহানুভূতি ও সমবেদনা ছাড়া তেমন কিছু আশা করা যাবে না আবার সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ওই সরকারের দৃঢ় সমর্থন ছাড়া বিশ্বের কোন দেশই বাংলাদেশের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে না। এছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আগের দিন এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চান যে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে কোনো সরকার গঠিত হয়েছে কি না। তখন তিনি পূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন যে বৈঠকে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি রূপে নিজেকে তুলে ধরবেন। কারণ এতে কাজ সহজ হবে। এদিকে পূর্ব বাংলার জনগণের সংগ্রামকে সাহায্য করার জন্য ৩১ মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্টে যে প্রস্তাব গৃহীত হয় তা কার্যকর রূপ লাভ করতে পারে বলে তাজউদ্দীনের ধারণা হয়।

ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের সূচনাতে তাজউদ্দীন জানান যে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ২৬ মার্চেই বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করে সরকার গঠন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেই স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট এবং মুজিব- ইয়াহিয়া বৈঠকে যোগদানকারী সব প্রবীণ সহকর্মীই মন্ত্রিসভার সদস্য। শেখ মুজিবের গ্রেপ্তার ছাড়া তখন পর্যন্ত দলের অন্যান্য প্রবীণ নেতাকর্মীর খবর অজানা থাকায় সমবেত দলীয় প্রতিনিধিদের সাথে পরামর্শক্রমে দিল্লীর সেই সভায় তাজউদ্দীন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী রূপে তুলে ধরেন। বৈঠকে তাজউদ্দীন আহমদ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। ইন্দিরা গান্ধী তাকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, উপযুক্ত সময়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়া হবে। এভাবেই অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের ধারণার সূচনা।
ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের সময় ইন্ধিরা গান্ধী মুক্তিবাহিনীর অস্ত্র, ট্রেনিং, শরণার্থীদের সাময়িক আশ্রয়ের বিষয়ে রাজি হয়েছিলেন।  সে আলোচনার পর তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ এবং এমপিএদের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশনে আহ্বান করলেন। এই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়েছিল। এই মন্ত্রিপরিষদ এবং এমএনএ ও এমপিএগণ আবার প্রত্যেকেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে জনপ্রতিনিধি হয়েছিলেন।

১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করা হয়। এই সরকার সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপ্রধান এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান ও সশস্ত্র বাহিনীর অস্থায়ী সর্বাধিনায়ক নির্বাচিত করে। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী,ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদকে পররাষ্ট্র, আইন এবং সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী, এ এইচ এম কামরুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র, কৃষি, ত্রাণ এবং পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়ে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হয়। চার জন মন্ত্রীকে ১২টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া হয়।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছিল বেশ কয়েকটি সিদ্ধান্তের এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবায়নের। প্রথমে ১৯৭০ এর নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ৩ মার্চে জাতীয় পরিষদ বৈঠক অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা। ২৫ মার্চ থেকে নির্বিচারে গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা এবং জনপ্রতিনিধিদের গণপরিষদ গঠন এবং  জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করতে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা দৃঢ় সমর্থন এবং  বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি এবং সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিয়োগ, জাতিসংঘের সনদ মেনে চলার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়েছিল। এই ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছিল, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ৭১ এর ২৬ মার্চ তারিখ থেকে কার্যকর হয়েছে এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি ও উপ-রাষ্ট্রপতির শপথ পরিচালনার জন্য অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে প্রতিনিধি নিয়োগ করার কথা বলা হয়।

১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক এম ইউসুফ আলী। এই ঘোষণাপত্রে বাংলাদেশের মুক্তির জন্য যা যা করণীয় তা করবে বাংলাদেশ সরকার সেই ঘোষণাও দেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে এই ঘোষণাপত্র কার্যত মুজিবনগর সরকার কর্তৃক অলিখিত সংবিধান ছিল।

স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র ও এর পরিপ্রেক্ষিতে সদ্য ঘোষিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ঘোষণা দিয়ে ভাষণ দেন। সেই ভাষণে তিনি গোটা দেশব্যাপী সর্বাত্মক প্রতিরোধ যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের পরিকল্পনা তুলে ধরেছিলেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সিদ্ধান্ত ও এর ধারাবাহিকতায় ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতোলায় মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

তথ্য সূত্র- ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র’, একাত্তরের রণাঙ্গন/ শামসুল হুদা চৌধুরী, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে/ রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম, আত্মকথা ১৯৭১/ নির্মলেন্দু গুণ

লেখক ও সংগ্রাহক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, অর্থপেডিক স্পাইন এন্ড ট্রমা সার্জারী বিভাগের অধ্যাপক এবং সাবেক অধ্যক্ষ, চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক এই আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি।