বিনা তেলে রান্না কেন জরুরি?

রাজিব আহমেদ : মানবদেহ ১০০ ট্রিলিয়ন জীবন্ত কোষ দিয়ে তৈরি। প্রত্যেকটি কোষের মূল খাদ্য অক্সিজেন- যা কিনা রক্ত দ্বারা পরিবাহিত হয়। এই অক্সিজেন আহরিত হয় শ্বাস গ্রহণের মাধ্যমে এবং পানকৃত পানি থেকে। এ কারণে মানুষ বাতাস গ্রহণ ছাড়া বাঁচতে পারে সর্বোচ্চ দেড় মিনিট আর পানি ছাড়া সাত থেকে সর্বোচ্চ দশদিন। এর বাইরে আমরা যে খাবারগুলো খাই, সবই সহায়ক শক্তি হিসেবে মানবদেহে ক্রিয়াশীল। সে কারণে খাদ্যগ্রহণ না করেও মানুষ তার দেহে সঞ্চিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৩০ দিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে। কিন্তু আমরা অজ্ঞতাবশত খাদ্যগ্রহণকেই বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন মনে করি!
প্রত্যেক মানুষের বয়স, BMl (Body Mass Index; উচ্চতার ভিত্তিতে ওজন নির্ধারণ), শারীরিক অবস্থা, লিঙ্গ, শারীরিক কর্মকাণ্ড ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে খাদ্য পরিকল্পনা করা উচিত।
মানবদেহকে যদি যন্ত্র হিসেবে ধরে নিই, তাহলে খাবার হচ্ছে সেই যন্ত্রের জ্বালানি। কিন্তু খাদ্যগ্রহণে আমরা মূলত চার ধরনের ভুল করে থাকি- ১. পদ্ধতিগত ভুল, ২. পরিমাণগত ভুল, ৩. সময়গত ভুল ও ৪. গুণগত বাছ-বিচার সংক্রান্ত ভুল। এর পরিণাম অসুস্থতা এবং শাস্তিস্বরূপ নানা ধরনের রোগ অকালে আমাদের শরীরে বাসা বাঁধে। ভুল সময়ে, ভুল পরিমাণে, ভুল নিয়মে, ভুল জ্বালানীর প্রয়োগে শরীর প্রায়ই জটিলতায় পড়ে, এমনকি চিরতরে অকেজো হয়ে যায়। খাওয়া-দাওয়ার ভুল তথা অপরিকল্পিত জীবনযাপন হৃদরোগের কারণগুলোর ৩০% যোগানদাতা।
মানবদেহের জন্য দরকারি ১৬০০ ক্যালোরির ৬৫% কার্বোহাইড্রেড, ২৫% প্রোটিন ও ১০% ফ্যাট থেকে আসা উচিত। ফ্যাট-এর এই ১০% ক্যালোরি প্রায় ১৮ গ্রাম ফ্যাট-এর সমান, যা চাল, ডাল, গম ও তৈলবীজ থেকে পূরণ করা যায়। তার মানে বাড়তি কোনো তেলের প্রয়োজনই নেই। কিন্তু আমাদের দেশের রাঁধুনীরা তেলকে রান্নার জন্য অপরিহার্য জ্ঞান করেন! ফলে আমাদের শরীরে কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারাইড-এর মাত্রা ঠিক থাকছে না।
মহিলা সমাজে এখন এই ধারণা সুপ্রতিষ্ঠিত যে, তেল ছাড়া রান্নাই করা যায় না! আচ্ছা ভাবুন তো সৃষ্টির শুরুর সময়টার কথা। পৃথিবীর প্রথম মানব হযরত আদম (আ.) কোন তেলের রান্না খেতেন? বিবি হওয়া কি আদৌ রান্না করার সুযোগ পেয়েছিলেন? কেননা আগুন প্রজ্বলনের প্রচলন হয়েছে আরো অনেক পরে (যদিও আল্লাহ সুবহানুতায়ালা আদমকে সকল বিষয়ে জ্ঞানদান করেছিলেন)।
আচ্ছা থাক, সৃষ্টির শুরুর কথা না হয় বাদই দিলাম; আমাদের দাদী-নানীরা কোন ব্র্যান্ডের তেল দিয়ে রাঁধতেন? দেশ স্বাধীনের পরপর এদেশে বিদ্যমান চিনি, তেল ও লবণ সংকটের কথা যদি উহ্যও রাখি, বাস্তবতা হলো- গৃহকর্তাগণ সপ্তাহে একদিন তেলের ছোট্ট শিশি হাতে নিয়ে হাটে যেতেন; সেইটুকু তেলে ৮-১০ সদস্যের পুরো পরিবারের সারা সপ্তাহের রান্না হতো। অথচ এখন ৪-৫ জনের পরিবারে মাসে ৮/১০ লিটার তেল লাগছে!
একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন- গণমাধ্যমে (টেলিভিশন ও পত্রিকায়) রান্নার অনুষ্ঠানগুলো স্পন্সর করে বিভিন্ন তেল উৎপাদন ও বাজারজাতকারী কোম্পানিগুলো। রান্নার অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র সেইসব রেসিপি-ই দেখানো হয়, যেগুলো রাঁধতে তেল বেশি লাগে এবং রান্নাটা শুরুই হয় ফ্রাইপ্যান-এ তেল ঢালার মাধ্যমে!
তেলকে স্রেফ বাণিজ্যিক স্বার্থে রান্নার প্রধান ও অপরিহার্য উপাদান হিসেবে পরিগণিত করানো হয়েছে। তেল ছাড়া নাকি তরকারিতে স্বাদ হয় না! কিন্তু রান্না করা খাবারে স্বাদের কৃতিত্ব আসলে তেল-এর নয়, মশলার। বিশ্বাস না হলে এক চামচ তেল মুখে ঢালুন তো! দেখুন- কেমন লাগে? নিশ্চয় আপনার গা গুলিয়ে উঠবে, বমি করে ফেলে দেবেন। যে তেল মুখে ঢাললে এমন অবস্থা হয়, সেই তেল রান্নায় ব্যবহার করলে স্বাদ বাড়ায় কেমনে?
জন্মের পর থেকে ২০ বছর বয়স পর্যন্ত মানুষের শারীরিক বৃদ্ধি চলতে থাকে। এই বাড়ন্ত বয়সে (Growth stage) মানুষ যে খাবার গ্রহণ করে, তার প্রায় পুরোটাই তার শরীর গঠনের উপাদান (Construction materials) হিসেবে কাজে লেগে যায়। ফলে এ সময়টাতে সাধারণত শরীরের অতিরিক্ত ক্যালোরি চর্বি বা ফ্যাট হয়ে রক্তনালীতে জমা হয় না। কিন্তু ২০-২৫ বছর বয়সের পর করোনারি ধমনিতে চর্বি জমে ব্লক হওয়া শুরু হয়। জীবনযাপনের প্রণালী আর খাদ্যাভ্যাসের ভিত্তিতে প্রতি বছর এই ব্লক ২% থেকে ৩% হারে বাড়তে থাকে। এমনকি রমজান মাসে ইফতারির নামে আমরা যে পরিমাণ ভাজা-পোড়া খাই, তাতে করে ব্লকেজ এই এক মাসেই ২% থেকে ৩% বেড়ে যেতে পারে!
২০ বছর বয়সের পর থেকে আলগা তেল মানবদেহের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। শরীরের প্রয়োজনীয় তেল/চর্বির ৭৫% পর্যন্ত কলিজা তৈরি করে নিতে পারে। সুষম খাদ্যে দৃশ্যমান তেল ছাড়াও এসব খাদ্যের মধ্যে অদৃশ্য তেল শরীরের মোট ক্যালোরির ১৮% সরবরাহের জন্য যথেষ্ট। বাড়তি একফোঁটা তেলও শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
আপনি কি জানেন- সয়াবিন তেল উৎপাদনের সময় প্রথমে পরিশুদ্ধ (refine) করার জন্য ৫০০/৬০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় তেল উত্তপ্ত করা হয়। তখন এটা এক প্রকার পোড়া কালো মোবিল-এ পরিণত হয়। তারপর এটাকে ব্লিচ করে পরিষ্কার বা স্বচ্ছ করা হয়। তারপর কৃত্রিম রঙ যোগ করে চকচকে বানানো হয়। সবশেষে কৃত্রিম ভিটামিন A, B, C, D ইত্যাদি (যে ভিটামিনগুলো মানবদেহ কখনোই খাদ্য উপাদান হিসেবে গ্রহণ করতে পারে না) মিশিয়ে দৃষ্টিনন্দন, আকর্ষণীয় মোড়কে বাজারজাত করা হয়। এর ক্ষতিকারক দিক হলো- রক্তে কোলেস্টেরল-এর মাত্রা বাড়ায়, ডায়াবেটিস, গ্যাসট্রিক/আলসার, কিডনি কার্যকারিতা নষ্ট, চর্মরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, এমনকি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। তাই আসুন, সামাজিকভাবে আলগা তেল বর্জন করার আন্দোলন গড়ে তুলি।
স্পষ্ট জেনে রাখুন- স্বাদের জন্য তেলের কোনো ভূমিকা নেই। তেল বড়জোর চোখের ক্ষুধা মেটায়- মানে দেখতে চকচক করে, কিন্তু এর পুরোটাই শরীরের জন্য ক্ষতিকর। রান্না করা খাবারে স্বাদ আসে বিভিন্ন প্রকার মশলা থেকে- যেগুলো নানাবিধ ঔষধি গুণে গুণান্বিত এবং শরীরের জন্য উপকারী। তাই তেল ছাড়া শুধু পানি দিয়ে বেশি পরিমাণে মশলার মিশ্রণে তরকারি রান্না করলে একদিকে স্বাস্থ্য-ঝুঁকি কমবে, অন্যদিকে শরীর তার প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ফিরে পাবে।
এ কথা সত্যি যে, আমাদের শরীরে কিছু ফ্যাট-এর প্রয়োজন আছে এবং তা আমরা প্রাকৃতিক বিভিন্ন খাবার থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পেয়ে যাই। প্রযুক্তিগতভাবে উৎপাদিত উচ্চ ক্যালরিযুক্ত তেলের প্রভাবকে নিঃশেষ করতে যতখানি শারীরিক পরিশ্রম করা দরকার, আধুনিক জীবনযাপনে প্রায়শ তা করা হয়ে ওঠে না। ফলে এই তেল ক্যলরিতে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগ পায় না। উপরন্তু বেশি মাত্রায় তেল খেলে অতিরিক্ত ফ্যাট কোলেস্টেরল ও ট্রাইগ্লিসারিনরূপে হৃৎপিন্ডের ধমনীগুলোতে জমে অকাল মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়ায়- যেটাকে হার্টের ব্লকেজ বলা হয়।
শুধুমাত্র নির্বিচারে তেল খাওয়ার কারণে বিগত কয়েক বছরে হৃদরোগীর সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বেড়ে গেছে। ফলস্বরূপ বাংলাদেশে এখন যত নারীর হাতে (আঙুলে) রিং পরানো থাকে, তারচেয়ে অনেক বেশি পুরুষের হার্টে রিং পরানো আছে!
অনেকের ধারণা- একবার ব্লকেজ হয়ে গেলে তা আর অপসারণ/বিলোপ করা যায় না। কিন্তু বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে- জীবনযাপনের ভুলগুলো শুধরে আদর্শ খাদ্যাভ্যাসে ফিরে এলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিই কমে না, বরং আগে থেকে জমে থাকা ব্লকেজও ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে। একইসঙ্গে ডায়বেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হাড়ক্ষয় ও গিঁটে বাত থেকেও রেহাই মিলতে পারে। এমনকি কিছুদিনের মধ্যে অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। তাই নিতান্ত প্রাণে বাঁচতে চাইলে এবং নিজের পরিবারকে সুস্থ তথা সুরক্ষিত রাখতে চাইলে কোনো অবস্থাতেই রান্নায় তেল ব্যবহার করা উচিত নয়।
ফ্যাট বা চর্বি হচ্ছে শক্তির সঘন স্রোত। এর উৎস দু’টি – ১. প্রাণীজ আমিষ থেকে প্রাপ্ত কোলেস্টেরল এবং ২. উদ্ভিদ থেকে প্রাপ্ত ট্রাইগ্লিসারিন। কিছু চর্বি বেশি তাপমাত্রায় গলে যায় আর সাধারণ তাপমাত্রায় নিরেট অবস্থায় থাকে। আবার কিছু চর্বি ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় গললেও সাধারণ তাপমাত্রায় দ্রব অবস্থায় থাকে। চর্বি তিন রকমের হয়ে থাকে- সম্পৃক্ত চর্বি (স্যাচুরেটেড ফ্যাট), অসম্পৃক্ত চর্বি (আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট) এবং বিশেষ ধরনের অসম্পৃক্ত চর্বি।
চর্বি সহজে শরীর থেকে বের হতে চায় না, উল্টো বদহজমের সৃষ্টি করে। এক গ্রাম ফ্যাট-এ নয় ক্যালরি থাকে। সব রকমের সম্পৃক্ত চর্বি (মূলত তেলরূপে) রান্নার সময় খাবারে মিশে ট্রাইগ্লিসারাইডের স্তরকে বাড়িয়ে তোলে। যেসব খাবারে পুষ্ট চর্বি বেশি থাকে, সেগুলো স্থুলতা আর অপচনের সৃষ্টি করে এবং প্রয়োজনীয় পুষ্টিযুক্ত পদার্থগুলোকে সহজে গ্রহণ করতে বাধা দেয়! সম্পৃক্ত চর্বি রক্তের ঘনত্ব বাড়িয়ে তোলে; পরিণামে রক্ত জমে যেতে শুরু করে। হৃৎপিণ্ডের ধমনীগুলো সংকুচিত হয়ে গেলে অকাল মৃত্যু-ঝুঁকি অনেকাংশে বেড়ে যায়।
তেল ছাড়া শুধু পানি দিয়েই সব রকমের রান্না করা সম্ভব। তবে এজন্য রাঁধুনীকে রান্নায় অধিক মনোযোগী হতে হবে। রান্নার সময় শুধু রান্নাই করতে হবে, অন্য কোনোদিকে মনোযোগ দেওয়া চলবে না। কেননা তরকারি যাতে লেগে/পুড়ে না যায়, সেজন্য ক্রমাগত নাড়তে হবে এবং একটু একটু করে পানি মেশাতে হবে। মশলার পরিমাণ সামান্য বাড়াতে হবে আর বাকি সব প্রক্রিয়া আগের মতোই বহাল থাকবে। তাহলেই তৈরি করা সম্ভব হবে তেল-বিহীন স্বাদযুক্ত মজাদার সব খাবার।
আমার নিজের পরিবারে (তিনজন শিশুসহ মোট পাঁচজন) বিগত তিন বছর ধরে তেল ছাড়া রান্নার অনুশীলন চলছে…! এমনকি রমজান মাসেও তেল-বিহীন ইফতারি তৈরি হয় প্রতিদিন। আগে থেকে বলে না দিলে তেল ছাড়া রান্না করা খাবার দেখে নবাগত কারো পক্ষে বোঝার কোনো উপায় নেই, স্বাদেও কমতি হয় না! আগে প্রতি মাসে ১০/১২ লিটার সয়াবিন তেল লাগত; এখন সেখানে মাত্র এক লিটার সরিষার তেল লাগে (এই তেলটুকু ব্যবহৃত হয় কালেভদ্রে)!
শুভ সংবাদ হলো- বিগত তিন বছরে আমার পরিবারে কোনো ওষুধ সেবনেরও প্রয়োজন হয়নি! শোকর আলহামদুলিল্লাহ, আমরা সবাই খুব ভালো আছি; নিরাপদ জীবনযাপন করছি এবং আপনাদেরকেও তেল ছাড়া রান্নার ভূবনে স্বাগত জানাচ্ছি…।