পলাশীর ষড়যন্ত্র ও আমঝুপি নীলকুঠি: ইতিহাস বিকৃতির শিলালিপি

মুহাম্মদ আলকামা সিদ্দিকী

আমঝুপি নিলকুঠি

নবাব সিরাজ-উদ্দৌলার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত অনেকগুলো ষড়যন্ত্রের একটি বা সর্বশেষটি মেহেরপুরের সন্নিকটে আমঝুপিতে (বা আমঝুপি কুঠিবাড়িতে (?)) অনুষ্ঠিত হয় বলে একটি অপপ্রচার সম্প্রতি প্রচলন করা হয়েছে। কিন্তু এই ধারণা ইতিহাস সমর্থিত নয়। সৈয়দ আমিনুল ইসলাম তার মেহেরপুরের ইতিহাস গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন: “আমঝুপি নীলকুঠিকে নিয়ে একটি বিকৃত ইতিহাসের অবতারণা করা হয়েছে যা সংশোধন হওয়া প্রয়োজন । আমঝুপি নীলকুঠি নীলকরদের শত অত্যাচারের একটি ঐতিহাসিক স্থান। একথা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না, নীলকুঠিয়াল মিকেনী, সিম্পসন, ফার্গুসেন, জেমস হিল এদের আনন্দের হোলি আর কৃষকদের নির্যাতিত হওয়ার কাহিনী আমঝুপি নীলকুঠির আকাশে-বাতাসে এখনো জড়িয়ে আছে। এই ঐতিহাসিক স্থানের গুরুত্ব অপরিসীম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমঝুপি নীলকুঠির ইতিহাসকে বিকৃত করে তার ললাটে এক কলংকের ইতিহাস লেপন করে দেওয়া হয়েছে।” আমঝুপি নীলকুঠির দেয়ালের গায়ে বিকৃত ইতিহাসের যে শিলালিপি প্রতিস্থাপিত হয়েছে তা হবহু তুলে ধরা হয়েছে সৈয়দ আমিনুল ইসলামের বইয়ে:
ইতিহাস বিকৃতির শিলালিপি
“ “আমঝুপি: ইতিহাসের সোনালী স্মৃতি” ইতিহাস একটি জাতির জীবনের ধারাবাহিক চলচ্চিত্র এবং এর সভ্যতার স্মারক। ‘মৌন অতীত’কে সে মানুষের কাছে বাঙ্ময় করে তোলে নির্মোহ নিরপেক্ষতায় । ইতিহাস তাই গৌরব গর্ব ও কলংকদায়কে একসুত্রে গেঁথে প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই ইতিহাসের সড়ক বেয়েই মানুষের চিরকালের যাওয়া-আসা, প্রবাহমান জীবন স্রোত এমনি করে বয়ে চলে কাল থেকে কালান্তরে। ইতিহাসের এমনি এক ধূসর পথে সীমান্ত শহর মেহেরপুরের কোল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আমঝুপি। এই পথে একদিন মোগল সেনাপতি মানসিংহের বিজয় রথ ছুটেছে, এই পথে ভাস্কর পণ্ডিতের বর্গী দল ধূলি উড়িয়ে গেছে লুণ্ঠনের কালো হাত বাড়িয়ে। বাঙলা-বিহার-উড়িষ্যার অধিপতি নবাব আলীবর্দী খাঁর মৃগয়ার স্মৃতিও রয়েছে এই খানে।

“পলাশীর পরাজয়ের নীলনকশাও রচিত হয়েছিল এইখানে- এই আমঝুপিতে। জনশ্রুতি আছে যে, এখানেই রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে মীরজাফর ও ষড়যন্ত্রকারীদের শেষ বৈঠক হয়েছিল এবং তার ফলে শুধু নবাব সিরাজউদ্দৌলারই ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেনি, বাঙালী হারিয়েছিল তার স্বাধীনতা।
“ইংরেজ আমলের সূচনাপর্বে বাংলার নির্যাতিত মানুষের নীল রং রক্তে গড়ে ওঠে আমঝুপি নীলকুঠি। কুঠিয়াল কেনী-সিম্পসন-ফার্গুসনের সতীর্থদের অত্যাচার-নির্যাতন-শোষণের স্মৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুঠি আমঝুপি। নির্যাতিত নীলচাষীর দুর্বার আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে একদিন বাংলার বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হলো নীলচাষ। হাত বদল হয়ে আমঝুপি নীলকুঠি মেদিনীপুর জমিদারী কোম্পানীর কাচারীতে পরিণত হলো। দেশভাগের পর জমিদারী উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে সে অধ্যায়েরও সমাপ্তি ঘটলো।
“বিবর্তনের ধারা বেয়ে আরেক ইতিহাসের জন্ম হলো ১৯৭৮ সালের ১৩ই মে, খুলনা বিভাগ উন্নয়ন বোর্ডের আমঝুপি অধিবেশনে। এ ইতিহাস অতীতের শোষণ-বঞ্চনা নির্যাতনের স্মৃতি ভুলিয়ে দিয়ে মানুষের রুচি-শ্রম-প্রগতির পথে অভিযাত্রার ইতিহাস। এই সভায় আমঝুপি স্বীকৃতি পেল পর্যটনকেন্দ্ররূপে। ১৮০২০০০ (আঠার লাখ দুই হাজার ) টাকা ব্যয়ে আমঝুপি কুঠিবাড়ী সংলগ্ন এলাকায় আমঝুপি নামের বিলীয়মান স্মৃতিকে পুনর্জাগ্রত করার প্রয়াসে আম্রকানন সৃষ্টিসহ একটি মনোরম পর্যটন কেন্দ্রে রূপান্তরের প্রকল্প গৃহীত হয়।
“ইতিহাসের আরেক কালান্তরে আমঝুপি আবার গৌরব ও স্বীকৃতির শিরোপা লাভ করলো। তার এই আলোকাভিসার আজ যদি ইতিহাসের সরণি বেয়ে স্বকাল ও ভাবীকালের মানুষকে মুগ্ধ ও আকৃষ্ট করে তবেই তার এই পুনর্জন্ম সার্থক হবে-সফল হবে এর স্বপ্নদ্রষ্টা ও পরিকল্পকদের শ্রম ও সংকল্প।
“২৬ শে মার্চ, ১৯৭৯ আব্দুল মান্নান ভূইয়া জেলা প্রশাসক, কুষ্টিয়া।””
সৈয়দ আমিনুল ইসলাম উক্ত ফলকে লিপিবদ্ধ ইতিহাস বিকৃতির প্রতিবাদ করেছেন।
পলাশীর ষড়যন্ত্রের সঙ্গে আমঝুপি বা আমঝুপি নীলকুঠির সংশ্লিষ্টতার উল্লেখ এই অপইতিহাসের শিলালিপি ছাড়া অন্য কোন সূত্রে পাওয়া যায় নি।
উল্লেখ্য, এই নীলকুঠিসহ বাংলার সকল নীলকুঠীর প্রতিষ্ঠা হয় পলাশীর যুদ্ধের অনেক পরে অন্ততঃ কুড়ি বছর পরে। সৈয়দ আমিনুল ইসলামের মতে, লুই বর্মো নামের জনৈক ফরাসী নীলকুঠিয়াল ১৭৭৭ সালে বাংলাদেশে সর্বপ্রথম নীলকুঠী স্থাপন করে। আর ইংরেজদের মধ্যে ক্যারেল বুম নামক জনৈক ব্যক্তি ১৭৭৮ খৃষ্টাব্দে বাংলার নদীয়া জেলায় প্রথম নীলচাষের উদ্যোগ নেন এবং নীলকুঠি স্থাপন করেন। প্রকৃত পক্ষেই চন্দননগর নিবাসী ফরাসী ঔপনিবেশিক Louis Bonnaud ১৭৭৭ সালে এদেশে সর্বপ্রথম নীলচাষ ও নীলের ব্যবসায় শুরু করেন। (সূত্র: DISCOVER CHANDERNAGORE by Dr. Ajit Kumar Mukhopadhay & Kalyan Chakrabortty: http://www.oocities.org/…/par…/4243/discoverchandan.html). ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা নীলগাছের চাষ ও নীল উৎপাদন ও বিপণন ব্যতীত অন্য কোন কারণে নীলচাষ প্রচলনের পূর্বকালে আমঝুপিতে কোন কুঠি স্থাপনের কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। এমনকি কোন সম্ভাবনার অনুমানেরও ভিত্তি নেই। বস্তুতঃ সমগ্র মেহেরপুর জেলার কোথাও (এমন কি মেহেরপুর শহর বা বাগোয়ান পরগণার অন্য কোন স্থানে) নীল চাষ ও নীলের ব্যবসায় শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত কোন ইংরেজ কুঠি নির্মিত হয় নি। সমসাময়িক ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ইংরেজদের কুঠি যাকে তারা গালভরা বুলিতে Fort বলতো সেগুলি ছিল প্রধানতঃ ঢাকা, কলকাতা, চন্দননগর, কাটোয়া, কাশিমবাজার প্রভৃতি বাণিজ্য কেন্দ্রগুলোতে। স্মরণ রাখা উচিৎ ইংরেজ বণিকদের রাজ্যাভিলাষ ছিলো না, নিরুপদ্রবে সর্বাধিক হারে লাভ প্রদানকারী বাণিজ্যের প্রতিই তাদের মূল দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। তারা নিজস্ব সৈন্য বাহিনী গড়ে তুলেছিল নিরাপদ বাণিজ্য যাত্রা এবং ধনসম্পদ রক্ষার জন্য। প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবেই রাজ্যলাভের সুযোগ তারা হাতে পেয়ে তার সর্বোত্তম সদ্ব্যাবহার করেছে মাত্র। এর প্রমাণ পাওয়া যাবে . House of Commons-এ রবার্ট ক্লাইভের ভাষণের নিম্নোদ্ধৃত অংশ থেকেঃ
Let the House figure to itself a country consisting of 15 millions of inhabitants, revenue of four millions sterling, and a trade in proportion. By progressive steps the Company have become sovereigns of that empire. Can it be supposed that their servants (অর্থাৎ কোম্পানির বেতনভূক কর্মচারী) will refrain from advantages so obviously resulting from their situation? (সূত্র: Robert Clive: Speech in Commons on India, 1772. http://www.fordham.edu/halsall/mod/1772clive-india.asp.)
এখানে Situation বলতে রাজ্য জয়ের সহজ সুযোগের কথাই ক্লাইভ বলেছেন। সুতরাং সহজেই বোঝা যাচ্ছে প্রধান প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র ছাড়া অন্য কোথাও কুঠি স্থাপনের কোন সম্ভাবনাই ছিল না পলাশী যুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত। সুতরাং পলাশী যুদ্ধের পূর্বকালে আমঝুপিতে নীল কুঠি বা কোন প্রকারের ইংরেজ কুঠির অনুমান করা এবং সেই কুঠিতে ক্লাইভ-মীরজাফরের ষড়যন্ত্র কল্পনা করা নিতান্ত অবিমৃষ্যকারিতা।
আমঝুপি কুঠিবাড়িতে কোন ষড়যন্ত্র অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইতিহাসে এর কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি এমনকি রবার্ট ক্লাইভও তার কোন রিপোর্ট, চিঠি বা ডাইরিতেও এ বিষয়ে কোন কিছু উল্লেখ করেন নি। তার বিভিন্ন সময়ের রিপোর্ট ও বৃটিশ সংসদে প্রদত্ত বক্তব্যাদিতেও আমঝুপি বা মেহেরপুর বা নদীয়ার কোন স্থানে কোন গোপন বৈঠক হয়েছিল এমন কোন তথ্য পাওয়া যায় নি। পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে মীর জাফর প্রমুখের সঙ্গে রবার্ট ক্লাইভের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি ক্লাইভ স্বীকার করেছেন তার এই রিপোর্টেঃ
About this time some of his (সিরাজউদ্দৌলার) principal officers made overtures to us for dethroning him. At the head of these was Meer Jaffier, then Bukhshee to the army, a man as generally esteemed, as the other was detested. As we had reason to believe this disaffectionate pretty general, we soon entered into engagements with Meer Jaffier to put the crown on his head. All necessary preparations being completed with the utmost secrecy, the army, consisting of about one thousand Europeans and two thousand sepoys, with eight pieces of cannon, marched from Chandernagore on the 13th (১৭৫৭ সালের জুন মাসের) and arrived on the 18th at Cutwa Fort. The 22nd, in the evening, we crossed the river, and landing on the island, marched straight for Plassey Grove, where we arrived by one in the morning. [Letter written on 26 July 1757 by Robert Clive to the East India Company on the Battle of Plassey.]
ক্লাইভের এই engagements with Meer Jaffier-with utmost secrecy কিভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা কিন্তু ক্লাইভ উল্লেখ করেন নি। তবে তার সাথে ক্লাইভের এ বিষয়ে কখনও কোনস্থানেই সরাসরি সাক্ষাৎ হয় নি । তাদের মধ্যে দুতিয়ালির কাজ করেছিলেন ওয়াটস, স্ক্র্যাফটন, রায় দুর্লভ, খোজা পেত্রস, জগৎশেঠ, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের দেওয়ান কালী প্রসাদ প্রমুখ। কিন্তু তাদের এই দুতিয়ালি কোন নিরবচ্ছিন্ন কার্যক্রম ছিলনা।
পলাশীর ষড়যন্ত্র কোন একটি বৈঠকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না । এর কালিক, ভৌগলিক এবং স্বার্থগোষ্ঠীগত বিস্তৃতি ছিল বহুমাত্রিক। এর উৎস মুর্শিদাবাদের নবাব দরবার। এই দরবার-সংশ্লিষ্ট আমির-ওমরাহ, জমিদারবর্গ এবং নানাদেশীয় শেঠ-সওদাগর প্রভৃতি শ্রেণী সংশ্লিষ্ট ছিল এই ষড়যন্ত্রে। এই ষড়যন্ত্রের বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা আছে রজতকান্ত রায়ের পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ গ্রন্থে।
দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ষড়যন্ত্র তার চরম রূপ পায় পলাশীর আম্রকাননে। পলাশীর আম্রকাননে যুদ্ধের যে অভিনয় হবে তার চিত্রনাট্য আগেই লিপিবদ্ধ হয়। এই চিত্রনাট্য কোন একটি অধিবেশনে লেখা হয় নি। সবার ভুমিকাও একদিনে নির্ধারণ করা হয় নি। তাই আমঝুপির কুঠিবাড়ির প্রস্তর ফলকে যারা লিখে রেখেছেন এখানে শেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় তারা নিতান্ত ভ্রান্তি বশতঃ এই উক্তি করেছেন। পলাশীর ষড়যন্ত্র সম্পর্কিত ঐতিহাসিক তথ্যের কোন প্রাথমিক সূত্র পাওয়া না যাওয়ায় রজতকান্ত রায় ষড়যন্ত্রকারীদের চিঠিপত্রের ভিত্তিতে একটি ধারা বিবরণি তৈরি করেছেন। তাতে এমন কোন উল্লেখ নেই যে, ষড়যন্ত্রকারীরা মুর্শিদাবাদ-পলাশী-কলকাতা-কাসিমবাজার-চন্দননগরের বাইরে কোন স্থানে কখনও কোন বৈঠক করেছেন। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার ষড়যন্ত্রে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তার সংশ্লিষ্টতার জন্য হয়তো কেউ অনুমান করে থাকতে পারেন আমঝুপি (বা আমঝুপি কুঠিবাড়িটি) তার রাজ্যাধীনে হওয়ায় তার ব্যবস্থাপনায় এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ ধারনাটিও ভ্রান্ত। ১৭৫০ সালের পর অর্থাৎ পলাশীর যুদ্ধের সমকালে এই অঞ্চল তার জমিদারি বহির্ভূত ছিল। কারণ নবাব আলীবর্দি খাঁ এই অঞ্চল রাজুগোয়ালিনীকে দান করেছিলেন এবং স্বাভাবিকভাবেই নবাবদত্ত পরগণাতে কোন মধ্যবর্তী জমিদার প্রভৃতি থাকতে পারে না। তবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র ষড়যন্ত্রকারীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য মুর্শিদাবাদ গেছেন। এর সত্যতার ইঙ্গিত পাওয়া যায় রাজীব লোচন শর্মার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং গ্রন্থে: “শেষে এই পরামর্শ হইল যাহাতে জবন (নবাব) দূর হয় তাহার চেষ্টা করহ ইহাতে জগৎসেঠ কহিলেন এক কার্য্য করহ নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অতিবড় বুদ্ধিমান তাঁহাকে আনিতে দূত পাঠাও তিনি আইলেই যে পরামর্শ হয় তাহাই করিব। … পরে এক দিবস জগৎ সেঠের বাটীতে রাজা মহেন্দ্র (রায় দূর্লভ) প্রভৃতি সকলে বসিয়া রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে আহ্বান করিলেন দূত আসিয়া রাজাকে লইয়া গেল যথাযোগ্য স্থানে সকলে বসিলেন।” রাজীবলোচনের বর্ণানুসারে কৃষ্ণচন্দ্র কলকাতায় গিয়ে সাহেবদের সঙ্গে যোগসাজশ করলেন এবং তার ফলে পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজরা জয়ী হয়ে মীর জাফরকে মসনদে স্থাপন করল। রাজীবলোচনের বর্ণনা অতি সরলীকরণ ও কল্পনাবাহুল্য দোষে দুষ্ট বলে তার গ্রন্থটিকে বিশুদ্ধ ইতিহাসের মর্যাদা দেওয়া যায় না বলে রজত রায় মন্তব্য করেছেন।
এই ষড়যন্ত্রের প্রাথমিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের অনেকেই শেষ পর্যন্ত ষড়যন্ত্রে সামিল থাকতে পারেন নি। ষড়যন্ত্রের চুড়ান্ত পর্যায়ে যারা মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন তারা হলেন- মীর জাফর আলী খান, রাজা রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ খান, উমিচাঁদ, জগৎ শেঠ মাহতাব রায়, কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ, অ্যাডমিরাল ওয়াটসন, লিউক স্ক্রাফটন, ওয়াটস, খোজা ওয়াজিদ, খোজা পেত্রস, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মজুদার প্রমুখ। ষড়যন্ত্রকারীদের প্রথম সারির কেউ সরাসরি কোন বৈঠক করার মতো কোন ফুরসত পান নি। নবাবের কিছু বিশ্বস্ত চর সব সময়ই তাদের ওপর নজরদারী করতো এবং তাদের প্রতিদিনকার কার্যক্রম নবাবের কাছে হাজির করা হতো। ষড়যন্ত্রের মূল কলকাঠি ছিল নবাব দরবারে উপস্থিত ইংরেজ কোম্পানীর দূত ওয়াটসের হাতে । তিনি প্রতি নিয়ত দরবারের অভ্যন্তরের ঘটনাপ্রবাহ ক্লাইভকে জানাতে থাকেন। দরবারের ঘটনাবলী পর্যালোচনা করে তার মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে যে সিরাজউদ্দৌলার পরিবর্তে একজন নতুন নবাব পেতে দরবারের দরবারীরা খুবই উদগ্রীব।
এই পরিস্থতির প্রেক্ষাপটে পলাশীর ষড়যন্ত্রের ধারাবাহিক একটি চিত্র তুলে ধরা হল: (এই ধারাবাহিক বয়ানটি রচনায় সম্পূর্ণরূপে রজতকান্ত রায়ের দীর্ঘ গবেষণালব্ধ তথ্যবহুল মুল্যবান ও এ বিষয়ে একটি আকর গ্রন্থ পলাশীর ষড়যন্ত্র ও সেকালের সমাজ-এর অনুসরণ করা হয়েছে। আমি গ্রন্থটি ব্যাবহার করার জন্য তাঁর কাছে অকৃত্রিম ঋণ স্বীকার করছি।)
১৭৫৭ সালের ৮ই এপ্রিল ঢাকার কুঠিয়াল স্ক্র্যাফটন (কলকাতায় রবার্ট ক্লাইভের সাথে সাক্ষাৎ করে) মুর্শিদাবাদে আসেন ক্ষতিপূরণের টাকা নিতে। তার কাছ থেকে ওয়াটস জানতে পারেন রবার্ট ক্লাইভের প্রত্যাশা মুর্শিদাবাদের নবাব পদে নতুন কাউকে বসানো যায় কিনা সে ব্যাপারে তিনি ও ওয়াটস যেন খোঁজ খবর নেন। সেই নির্দেশ মতে তারা উমিচাঁদ ও জগৎশেঠের মাধ্যমে সম্ভাব্য সকলের সাথে গোপনে যোগাযোগ করতে থাকেন। ষড়যন্ত্রকারীদের প্রথম মনোনয়ন ছিল সেনাপতি মীর খুদা ইয়ার লতিফ খান। কিন্তু মীরজাফর আলী খান তাকে সমর্থন না করায় তার মনোনয়ন বাতিল হয়ে যায়।
২৪শে এপ্রিল আরমানি সওদাগর খোজা পেত্রসের মাধ্যমে মীরজাফর আলী খান অত্যন্ত গোপনে ওয়াটসকে একটি বার্তা পাঠান তার মূল বক্তব্য হলো “ ক্লাইভ যদি রাজী থাকেন তবে আমি নিজে, রহিম খান, রায় দূর্লভ আর বাহাদুর আলী এবং আরো কেউ কেউ তৈরী আছি তার সাথে সামিল হয়ে নবাবকে গ্রেফতার করে যাকে পছন্দ এমন আর কাউকে নবাবীতে আসীন করবো।” ওয়াটস মীরজাফরের এই প্রস্তাবে সুপারিশ করে বিবেচনার জন্য রবার্ট ক্লাইভের কাছে পাঠিয়ে তার জবাবের অপেক্ষা করতে থাকেন।
১লা মে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কুঠিতে মীরজাফর আলীর প্রস্তাব বিষয়ে বৈঠক বসলো। বৈঠকে মীর জাফরের প্রস্তাব এই বিবেচনায় গৃহীত হলো যে, নবাব মহলের অভ্যন্তরে যে অবস্থা তাদের মতে, The Nabob is so hated by all sorts and degrees of men; the affection of the army is so much alienated by him for his ill usage of the officers, and a revolution (i.e. change over বা পরিবর্তন) so generally wished for, that it is probable that the step (of dethroning Siraj) will be attempted ( and successfully too) whether we give our assistance or not. যেহেতু এমনিতেই ঘটনাটা ঘটে যাবে তখন বিজয়ীপক্ষকে করায়ত্ত করার এই সুযোগ হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না এই বিবেচনায় কোম্পানি কর্তৃপক্ষ মীরজাফরের প্রস্তাবে সম্মতি দেয়।
৬ই মে তারিখে মুর্শিদাবাদে অবস্থিত ওয়াটসকে খবর দেওয়া হলো যে মীরজাফরের প্রস্তাবে সম্মতি দেওয়া হয়েছে। ওয়াটসের পক্ষে সরাসরি মীরজাফরের সঙ্গে কোন কথা বলা সম্ভব হয় নি যা হয়েছে সবই খোজা পেত্রসের মাধ্যমে। মীরজাফরের প্রস্তাবের ওপর কোম্পানির সম্মতির খবর যখন ওয়াটসের কাছে পৌঁছায় তখন মীরজাফর নবাবের নির্দেশে পলাশী সৈন্য শিবিরে অবস্থান করছিলেন।
১২ই মে তারিখে খোজা পেত্রস পলাশীতে গিয়ে মীরজাফরকে কোম্পানির সম্মতির কথা জানালেন। এবং সাথে সাথে কোম্পানির শর্তও তাকে জানানো হলো। এত সব পরেও ক্লাইভের মনে মীরজাফরকে ঘিরে সন্দেহের মেঘ দানা বেঁধে উঠছিল কারণ মীরজাফর কীভাবে কোথায় ইংরেজদের পক্ষে লড়াইয়ে নামবেন সে বিষয়ে কোন কিছুই তখনও ঠিক হয় নি। এই বিষয়ে শলা-পরামর্শের জন্য তিনি কলকাতা প্রত্যাগত স্ক্রাফটনকে পলাশীতে মীরজাফরের শিবিরে পাঠালেন কিন্তু স্ক্রাফটনের পক্ষে নবাবের চরদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে মীরজাফরের সাথে সাক্ষাৎ করা সম্ভব হলো না।
৩০শে মে মীরজাফর নবাবের হুকুমে মুর্শিদাবাদ ফিরলেন। স্ক্রাফটন ক্লাইভের পরামর্শ মত তার সাথে ষড়যন্ত্রের কার্য পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করতে যেয়ে দেখলেন দরবারের যে অবস্থা তাতে মীরজাফরের সঙ্গে কোনভাবেই কথা বলা সম্ভব নয়।
২রা জুন ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম রাজা রায় দুর্লভ পলাশী থেকে মুর্শিদাবাদ ফিরলেন। মীর জাফরের সঙ্গে আলাপে জানতে পারলেন ফিরিঙ্গিরা আড়াই কোটি টাকা চায়। তাতে রায় দুর্লভ আপত্তি উত্থাপন করেন। তিনি প্রস্তাব করেন নবাবকে হত্যার পর যে টাকা হাতে আসবে তার অর্ধেক ইংরেজরা পাবে।
৩রা জুন রায় দুর্লভের আপত্তির কথা জানতে পেরে ওয়াটস চন্দন নগরে অবস্থানরত ক্লাইভকে জানান, “মীর জাফরের সাথে আমাদের পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে।…সে রায় দুর্লভের হাতের পুতুল। … তারা আমাদের কোন কাজে আসবে না। আমরা জয়ী হলে তারা তার ফল ভোগ করবে আর নইলে আমাদের সাথে কোন যোগাযোগ নেই এমন ভাব দেখিয়ে আগের মতই থাকবে। তাদের মতো a set of shuffling, lying, spineless wretches -দের সাথে কোন চুক্তি বা সম্পর্কের মধ্যে যাওয়া উচিৎ নয়”। এ কথার পরও ওয়াটস মীরজাফরের কাছে আধাআধি প্রস্তাবে রাজী হয়ে দূত পাঠালেন।
৫ই জুন মীরজাফরের সাথে সাক্ষাৎকারে স্ক্র্যাফটনের ব্যর্থতার কথা এবং তদবধি মীরজাফরের সাথে প্রস্তাবিত চুক্তিনামায় তিনি এখনও সই করেন নি জানতে পেরে ক্লাইভ হতাশাগ্রস্ত হয়ে ওয়াটসকে লিখলেন -“আপনি আগাগোড়া ঠকে গেছেন। চুক্তির কাগজপত্রগুলো ফেরৎ নেওয়া ছাড়া আপনার আর কোন কাজ নেই। আমি ঐ সব রাস্কেলদের সাথে কোন অভিযানে বের হবোনা।”
ঐ দিনই অর্থাৎ ৫ই জুন তারিখেই রায় দুর্লভের পরামর্শ মতো মীরজাফর ইংরেজদের প্রণীত চুক্তিনামায় ইংরেজদের আরোপিত শর্তেই সই করলেন। ইতোমধ্যে মীরজাফর সেনাপতির পদ থেকে বরখাস্ত হয়েছেন। দুটি ভিন্ন পত্রে এই দুটি খবর জানিয়ে ঐ দিনই ওয়াটস ক্লাইভের কাছে দূত পাঠালেন।
৬ই জুন ক্লাইভ ওয়াটসকে লিখলেন- “আপনি লিখেছেন চুক্তির শর্তে ওরা রাজী হয়েছে আর সেগুলো আপনি আমাকে পাঠাচ্ছেন। কিন্তু নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কেউ কি আমার সঙ্গে যোগ দেবে? কেমনভাবে? কবে? কে কে? জেনে রাখুন এই ক’টি বিষয়ে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমি এক পাও এগুবো না। স্ক্রাফটন তো একটা Plan of Operations ঠিক করার জন্য মীর জাফরের সাথে মন্ত্রণা করতে গিয়ে মুর্শিদাবাদে ফেঁসে গিয়েছিলেন। আবার আপনি লিখেছেন মীরজাফর বকশির (সেনাপতির ) পদ থেকে বরখাস্ত হয়েছেন; আমার ধারণা নবাব কিছু একটা জেনে ফেলেছেন, আর রায় দুর্লভ আমাদের এবং মীরজাফরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। ক্লাইভ তাকে নির্দেশ দিলেন “শুধু চুক্তি সই করলেই হবে না মীরজাফরকে কোরান স্পর্শ করে কসম করাতে হবে”।
ক্লাইভের কড়া চিঠি পেয়ে ওয়াটস প্রমাদ গুনলেন। তখন পর্যন্ত যুদ্ধক্ষেত্রের কার্যক্রম নিয়ে মীরজাফর আলীর সাথে তার সরাসরি কোন আলোচনা হয় নি। চারদিকে নবাবের চর ঘুরছে। ওয়াটসের সাথে মীরজাফরের সাক্ষাৎ হয়েছে এই খবর পেলে নবাব দ’জনেরই গর্দান নেবেন। তবুও ওয়াটস মরিয়া হয়ে প্রাণ হাতে করে সন্ধ্যায় খোজা পেত্রসের পরামর্শ মতো জেনানাদের পর্দাঘেরা পালকিতে চেপে একেবারে মীর জাফরের গৃহের অন্দর মহলে গিয়ে ঢুকলেন। মীরজাফর মাথায় কোরান শরীফ নিয়ে পুত্র মীরণের মাথায় হাত রেখে বললেন চুক্তিপত্রে ও অন্যান্য কাগজে যা আছে তিনি তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবেন। প্লান অব অপারেশনস বিষয়ে আলোচনা হলেও কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনায় উপনীত হওয়া গেল না। এ ব্যাপারে মীরজাফর ওয়াটসকে জানালেন, যুদ্ধ শুরু হলে তিনি যদি নবাবী ফৌজের সম্মুখভাগে থাকেন তাহলে ঢাক পিটিয়ে পতাকা তুলে ক্লাইভের বাহিনীর ডান দিকে গিয়ে তাদের সাথে যোগ দেবেন। আর যদি তিনি নবাবের ডানে বাঁয়ে বা পিছনে থাকেন তাহলে তিনি যুদ্ধের ময়দানে ত্বরিৎ গতিতে নবাবকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করবেন, চেষ্টা সফল হলে তিনি সাদা পতাকা তুলে দেবেন।
৭ই জুন মীরজাফরের বিশ্বস্ত সেনানী মীর্জা আমীর বেগ মীরজাফর স্বাক্ষরিত চুক্তি পত্র নিয়ে কলকাতায় ক্লাইভের কাছে রওনা হলেন। ইতোমধ্যে জগৎশেঠের প্ররোচনায় ইয়ার লতিফ খান মীরজাফরের সাথে হাত মেলালেন। ফলে মীরজাফরের ষড়যন্ত্রে বাহ্যত আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী থাকলো না।
ইতোমধ্যে নবাব মীরজাফর আলীকে সেনাপতির পদ থেকে অপসারণ করে তার জায়গায় খাজা আব্দুল হাদি খানকে বসিয়েছেন। মীরজাফর সেনাপতির পদ হারিয়ে দরবারে আসা ত্যাগ করে নিজের বাসগৃহে অবস্থান করতে লাগলেন এবং নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলতে লাগলেন। তিনি তার জমাদারদের একত্রিত করে সিদ্ধান্ত নিলেন, হয় ময়দানে বেরিয়ে গিয়ে ইংরেজদের আসার অপেক্ষায় ছাউনি ফেলবেন না হয় এখনি নবাবকে ঘিরে ফেলবার চেষ্টা করবেন।
এই সব পরিস্থিতির আলোকে ৯ই জুন দ্রুতগামী হরকরা মারফৎ ওয়াটস ক্লাইভকে জানালেন- Whether we interfere or not it appears affairs will be decided in few days by the destruction of one of the parties (i.e. either the Nabab or Mir Jafar). ওয়াটস তার নিজের নিরাপত্তার জন্য মুর্শিদাবাদ থেকে পালাবার জন্য ক্লাইভের কাছে অনুমতিও চাইলেন।
১১ই জুন ক্লাইভ ওয়াটসকে পালানোর অনুমতি দিলেন।
১২ই জুন ক্লাইভ চন্দন নগর থেকে মুর্শিদাবাদের দিকে যাত্রা শুরু করলেন।
১৩ই জুন নবাবের কাছে ক্লাইভ কড়া ভাষায় চিঠি লিখলেন নবাব শর্ত ভঙ্গ করায় তিনি কাশিমবাজার আসছেন। তিনি ঐ চিঠিতে নবাবকে দোষারোপ করলেন যে, তাদের কাছে খবর আছে তিনি তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ফরাসী সেনাপতি মঁসিয়ে ল’কে মাসে দশ হাজার টাকা করে দিচ্ছেন। এই চিঠি ও ইংরেজদের যুদ্ধ প্রস্তুতির খবর পেয়ে নবাব প্রমাদ গুনলেন। তিনি পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ও সুহৃদদের সাথে পরামর্শ করে বুঝলেন মীরজাফরের সাথে বিবাদ মিটিয়ে তাকে দলে টানা ছাড়া এই বিপদ মোকাবেলা করা যাবে না। নবাবের অনুরোধে মীর জাফর ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিতে রাজি হলেন।
১৯শে জুন নবাবের অসহায়ত্বের কথা এবং যুদ্ধের ময়দানে তার সম্ভাব্য অবস্থান জানিয়ে মীরজাফর ক্লাইভ শিবিরে অবস্থানরত মীর্জা আমীর বেগের কাছে চিঠি লিখলেন।
ঐ দিনই অর্থাৎ ১৯শে জুন ইংরেজরা কাটোয়া দূর্গ দখল করে নেয়। এখানে ছাউনি ফেলে ক্লাইভ গঙ্গা পার হয়ে পলাশীর দিকে যাবেন কি যাবেন না এই নিয়ে ইতস্তত করতে লাগলেন। কারণ চুক্তি মতো মীরজাফরের কাছ থেকে নবাব বাহিনীর খবরাখবর আসার কথা। কিন্তু কোন খবর না পেয়ে ক্লাইভ মীরজাফরকে চিঠিতে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন-মীরজাফর নিজের দলবল সহ নবাবী ফৌজ ছেড়ে বেরিয়ে এসে পলাশীতে তার সাথে যোগ না দিলে তিনি কাটোয়া ছেড়ে এক পাও অগ্রসর হবেন না।
ঐ ১৯শে জুনই তিনি কলকাতায় সিলেক্ট কমিটির কাছে মীরজাফরের সম্ভাব্য বিশ্বাসঘাতকতায় তার উদ্বেগের কথা জানিয়ে চিঠি লিখলেন- “মীরজাফর সাহায্য না করলে কী করবো সে সম্বন্ধে খোলাখুলিভাবে আপনাদের মতামত পাবার ইচ্ছা পোষণ করি।”
২০শে জুন ক্লাইভ বীরভূমের রাজা আসাদুজ্জামানকে চিঠি লিখলেন- তিনি যদি নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাকে তিন শ’ ঘোড়সোয়ার দিয়ে সাহায্য করেন তা হলে তিনি তার জমিদারির ওপর কোন আমিল (রাজস্ব আদায়ের তত্ত্বাবধায়ক) বসাবেন না । কিন্তু পাঠান রাজা আসাদুজ্জামান তার প্রস্তাবে সাড়া দিলেন না।
২১শে জুন সিদ্ধান্তহীনতায় আক্রান্ত ক্লাইভ সিলেক্ট কমিটির কাছে পরামর্শ চাইলেন মীরজাফর যখন প্রতারণা করছে বলে মনে হচ্ছে তাহলে নবাবের সাথে কোন সম্মানজনক শর্তে সন্ধি করার অনুমতি তারা দেবেন কিনা।
২১শে জুনেই দিবাবসানে হতাশাগ্রস্ত ক্লাইভ মীরজাফরের চিঠি পেলেন। তাতে ক্লাইভকে তার উদ্যমহীনতার জন্য রীতি মতো ভর্ৎসনা করা হয়েছে- ‘‘আপনি এখন পর্যন্ত খালি চিঠি চালাচালিই করে যাচ্ছেন কাজের কাজ কিছুই করেন নি। এখন আপনার আরামের সময় নয়। আপনি যখন কাছে আসবেন তখন আমি আপনার সাথে যোগ দেবো।”
ঐ দিনই অর্থাৎ ২১শে জুন গভীর রাতে ক্লাইভ তার বাহিনী নিয়ে গঙ্গা পার হয়ে রাত ১টায় (ক্লাইভের ভাষায়- by one in the morning.) পলাশীর আম্রকাননে ছাউনি ফেললেন। সেখান থেকে মীর আমীর বেগের মারফৎ তিনি মীরজাফরকে তার চরম পত্র দিলেন- “আমার যা করার তা করেছি, আর কিছু করার নেই। আপনি যদি দাউদপুর পর্যন্ত আসেন তাহলে আমি পলাশী ছেড়ে এগিয়ে আপনার সাথে মোলাকাত করবো, কিন্তু আপনি যদি তাও না করেন তবে আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি নবাবের সাথে বিবাদ মিটিয়ে ফেলবো”।
২২শে জুন ভোর না হতেই নবাবের ঘোড়সওয়ার, পদাতিক ও গোলন্দাজ সৈন্যরা পায়ে পায়ে আমবাগানের দিকে এগিয়ে আসতো লাগলো।
২৩শে জুন ভোর ছটার সময় নবাবের সৈন্যদল দাউদপুর শিবির থেকে নিষ্ক্রান্ত হয়ে আমবাগানের দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। ঐ দিনই পলাশীতে যুদ্ধ নামের ঐতিহাসিক ও কলঙ্কময় নাটিকাটি অভিনীত হলো। যার ফলাফল ও পরিণাম বিশ্ববাসীর জানা।
এই ধারাবাহিক বর্ণনাটি পাঠ করলে বেশ ভালোভাবে বোঝা যায় নবাব সিরাজের অভিষেকের মুহুর্ত্যে সূচিত ষড়যন্ত্র পলাশীর যুদ্ধের পূর্বক্ষণ পর্যন্ত নানা রূপে নানা মাত্রায় চালু ছিল এবং ষড়যন্ত্রকারীদের কারো পক্ষেই করণীয় স্থির করার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে কোন পূর্ব নির্ধারিত স্থানে বৈঠকে বসা সম্ভব হয় নি। আর ষড়যন্ত্রকারীদের শেষ বৈঠক বলতেও কোন কিছুর ঐতিহাসিক অস্তিত্ব নেই।
আমঝুপির এই স্থানটির সে সময়কার অবস্থাটি তাহলে কি ছিল? এ ব্যাপারে সৈয়দ আমিনুল ইসলাম তার গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, কাজলা নদীর খরস্রোত-বিধৌত বাঘ-শুকর থাকার মতো বিশাল জঙ্গলে আবৃত ছিল বলে অত্র এলাকার প্রাচীন ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকে জানা যায়। মেদিনীপুর জমিদারী কোম্পানীর অধীনে আমঝুপি নীলকুঠিতে ইংরেজ আমলের সর্বশেষ নায়েব ছিলেন মোঃ দবিরউদ্দিন। তিনি আমঝুপি নীলকুঠি সম্পর্কে অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, নীলকুঠিয়ালদের আমলে এখানে নীলকুঠি স্থাপিত হয়। তার পূর্বে এ অঞ্চলে তেমন কোন জনপদ ছিল না বললেই চলে। রবার্ট ক্লাইভ ও মীরজাফরের ষড়যন্ত্রের নীল নকশা প্রণয়ন সম্পর্কে তিনি বলেছেন, এটা অবাস্তব এবং অত্যন্ত দুঃখজনক কল্পকাহিনী।
পলাশীর ষড়যন্ত্রের সাথে আমঝুপির নীলকুঠিকে সংশ্লিষ্ট করে তৎকালীন সময়ের কতিপয় কর্তাভজা ইতিহাস রচনার নামে যে বালখিল্য প্রদর্শন করেছেন তা ক্ষমার অযোগ্য এক ইতিহাস বিকৃতি ও অত্যন্ত দুঃখজনক অপপ্রচার। এ বিষয়ে সকল বিভ্রান্তির অবসান হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে দেশ বিদেশের প্রথিতযশা ইতিহাসবেত্তাদের আশু দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।

লেখকঃ বাংলাদেশ সরকাবের সাবেক সচিব, কবি ও লেখক। মেহেরপুরের গাংনীর কৃতী সন্তান