ঢাকার রাস্তায় আবারও বিচারপতির মেয়ে

ঢাকার রাস্তায় আবারও মেয়েসহ সেই তুহিন সুলতানা (বাঁয়ে) এবং ডানে বাবা বিচারপতি শামসুল হুদা মানিক।

বিশেষ প্রতিনিধি

‘বিচারপতির মেয়ে’ পরিচয় দিয়ে ঢাকার রাস্তায় পথচারীদের কাছে সাহায্য চাওয়া সেই তুহিন সুলতানা তপুর বিষয়ে এবার গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন তার বাবা বিচারপতি শামসুল হুদা মানিক।

উচ্চ আদালতের সাবেক এই বিচারক বলেছেন, মিথ্যা অভিযোগ তুলে মানুষের সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করছে তার মেয়ে তুহিন।

বিচারপতি মানিকের দাবি, তুহিনের কারণেই তার মায়ের মৃত্যু হয়েছে। এই মৃত্যুর শতভাগ দায় তুহিনের।
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় নিজ বাসভবনে সোমবার গণমাধ্যমের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে এ অভিযোগ করেন বিচারপতি মানিক।

সম্প্রতি এক ভিডিওতে তুহিন সুলতানা তপু নামের ওই নারীকে বলতে শোনা যায়, তিনি অভিজাত পরিবারের সন্তান, বাবা উচ্চ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারক। তার এক মেয়ে নায়িকা, ছেলেরাও বেশ ভালো অবস্থানে আছেন। অথচ তাদের কেউ দেখাশোনা করেন না বলে কিশোরী মেয়েটিকে নিয়ে রাস্তায় ভিক্ষা করছেন তিনি।

এই নারীর আহাজারি ভাইরাল হলে অনেকেই আর্থিক সহায়তার জন্য এগিয়ে আসেন। ভিডিওর বিবরণে ০১৯৫৬৮৪১৭৮১ নম্বরটি দিয়ে সেখানে বিকাশে টাকা পাঠানোর অনুরোধ করেন মাহসান স্বপ্ন।

তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষক জানান, গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরেকটি পোস্টে তার নজর আকৃষ্ট হয়। সেখানে এই একই নারীর আলাদা ছবি দিয়ে মোহাম্মদ বদরুদ্দোজা নামে একজন ফেসবুক ব্যবহারকারী লেখেন, পিতৃহারা চতুর্থ শ্রেণির ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে তুহিন সুলতানা তপু নামের ওই নারী এখন কপর্দকশূন্য। অসুস্থ অবস্থায় তিনি চিকিৎসা নিতেও পারছেন না।

সেই পোস্টটিও ফেসবুকে বেশ ভাইরাল হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষক জানান, তখন অন্য অনেকের পাশাপাশি তারা নিজেরা উদ্যোগ নিয়ে এক লাখ টাকার বেশি অর্থ সংগ্রহ করে ওই নারীকে দিয়েছেন। এমনকি কয়েকজন তাকে বিকাশে প্রতি মাসে টাকা পাঠাচ্ছেন।

অনুসন্ধানে তুহিনের সব শেষ অবস্থান শনাক্ত হয়েছিল টাঙ্গাইল সদরের বটতলা বাজার এলাকায়। মাহসান স্বপ্নও ক্ষমা চেয়ে তার ফেসবুক পেজ থেকে ভিডিওটি সরিয়ে নেন।

তবে বছর শেষে আবারও রাস্তায় নেমেছেন তুহিন সুলতানা তপু। রাজধানীর উত্তরায় রোববার দুপুরে তাকে আগের ভঙ্গিতে সহায়তা চাইতে দেখা গেছে।

উত্তরার ১ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর রোডের মাথায় বেলা ২টার দিকে বসে থাকতে দেখা যায় তুহিন ও তার কিশোরী মেয়েকে। দুজনের হাতে ছিল দুটি বাঁধাই করা কাগজ।

মেয়েটির হাতের কাগজে লেখা, ‘আমরা বাঁচতে চাই। আমি পড়াশোনা করতে চাই। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন।’
আর তুহিনের হাতের কাগজে লেখা, ‘সাবেক বিচারপতি শামসুল হুদা মানিক সাহেবের মেয়ে আমি। ভিক্ষা আমার পেশা নয়, আমি বিপদে আছি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন।’

গত জানুয়ারিতে তুহিন তার বাবাকে ‘বিচারপতি’ দাবি করেন। তবে মাহসান স্বপ্নর ভিডিওতে তিনি বাবার নাম জানাতে রাজি হননি।

বিচারপতি হুদা হাইকোর্ট বিভাগে ২০০১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। ২০১২ সালের ২ নভেম্বর আপিল বিভাগের বিচারক হিসেবে তিনি অবসরে যান। তবে তাকে ২০১৩ সালে শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। বিচারপতি হুদার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জে হলেও তিনি দীর্ঘদিন ঢাকায় সপরিবারে আছেন।

তুহিন বলেন, ‘সে (বিচারক বাবা) আমার মাকে মেরে ফেলছে, আমাকেও মেরে ফেলবে। সে তিন দিন আগে আমার মামাকে মেরে ফেলেছে। আপনি ওরে চেনেন? সবাই চেনে। পুলিশ, সাংবাদিক সবাই চেনে। সবাই তাকে ভয় পায়।

‘এর আগে আমাদের সাহায্য করতে কয়েকটা সাংবাদিক আসছিল। তাদেরকেও মারছে ওই লোক (বাবা)। আপনি তার সঙ্গে কথা বললে আপনাকেও মেরে ফেলবে। মামার সঙ্গেই কেবল আমাদের যোগাযোগ ছিল, সে হেল্প করত। তাকেও মেরে ফেলেছে।’

‘মজার টিভি’ নামের ফেসবুক পেজে গত জানুয়ারিতে আপলোড করা তুহিনের ভিডিওটি মুহূর্তে ভাইরাল হয়
মাহসান স্বপ্নকে নিয়ে এখনও আক্ষেপ আছে তুহিনের। তিনি বলেন, ‘সব পুলিশ, ল-ইয়ার সবাই তাকে (বাবা) চেনে। সবাই তাকে ভয় পায়। কেউ তার বিরুদ্ধে কিচ্ছু বলবে না। এর আগে ফেসবুকে একজন আমাদের নিয়ে ভিডিও দিয়েছিল। তাকে মারছে। সবার কাছে মাফ চাওয়াইছে।

‘আমি তো ভয়ে মেয়েকে নিয়ে টাঙ্গাইল গিয়ে লুকিয়ে ছিলাম। এখন এত অসুস্থ, তাই ঢাকায় আসছি। কী করব, রাস্তায় বসা ছাড়া কিছু করার নাই। লোকজন যা দেয়, দিনে দেড়-দুই হাজার টাকা পাই। তা দিয়ে যা পারি কিনি।’
তুহিনের এসব অভিযোগের জবাব দিয়েছেন বিচারপতি শামসুল হুদা মানিক।

তিনি সোমবার একটি অনলাইন পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেন, ‘সে (তুহিন) ডাহা মিথ্যা কথা বলেছে। জীবনের শুরু থেকেই সে উচ্ছৃংখল। তার জীবনে করেনি এমন কিছু নাই। সব কিছুই সে করেছে। সে তার মায়ের ২০০ ভরি স্বর্ণ চুরি করেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পেছনে ওর (তুহিন) দায় রয়েছে। ওকে হত্যাকারী বললেও ভুল হবে না। আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পেছনে শতভাগ দায় তার রয়েছে। সে আমার স্ত্রীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে।’

বিচারপতি মানিকের পরিবারের সদস্যরা জানান, ২০১৫ সালে বাসা থেকে ২০০ ভরি স্বর্ণালংকার ‘চুরি করেন’ তুহিন। এরপর বিচারপতি মানিকের স্ত্রীর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়। বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১৬ সালের ৯ মার্চ তিনি মারা যান।

তুহিনকে প্রতি মাসে ২০ হাজার করে টাকা দেয়া হচ্ছে বলেও জানান বিচারপতি মানিক।

তিনি বলেন, ‘আমার যে শ্যালককে মেরে ফেলার কথা তুহিন বলেছে, তার কাছ থেকেও কিছু দিন আগে সে ২০ হাজার টাকা নিয়েছে। আমার শ্যালক কামালই আমার বাড়িঘর দেখাশুনা করে। আমার বড় মেয়ে ও ছোট মেয়েও ওকে (তুহিন) সাহায্য করে। অথচ ও বলছে ওকে আমরা টাকা দেই না। ও ডাহা মিথ্যা কথা বলছে।’

বিচারপতি মানিক বলেন, ‘তুহিনকে আমার গ্রামের বাড়ি দিয়েছিলাম। সেখানে গিয়েও সে হাবিজাবি করছে। পরে তাকে শহরে নিয়ে আসি, এখানে এসেও সে থাকবে না। তাহলে আমি এখন কী করব। আমি অবসরপ্রাপ্ত। আমি ওকে এখন এত কিছু কোথা থেকে দেব। আমার তো কোনো কামাই (আয় রোজগার) নাই।’

তুহিনের দাম্পত্য জীবনও ঠিকমতো চলেনি জানিয়ে বিচারপতি মানিক বলেন, ‘প্রথমে তাকে বিয়ে দিয়েছিলাম ফরিদ নামে একটি ছেলের কাছে। ছেলেটি তখন মাস্টার্সে পড়ত। পরে এই ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে লিটন নামে আরেকটি ছেলের সঙ্গে সে সম্পর্ক করে। এখন তার ঘরে যে মেয়েটি আছে সেটা লিটনের ঘরের। বিয়ে ছাড়াই এই মেয়ের জন্ম হয়েছে। অথচ আগের ঘরে তার দুটি সন্তান রয়েছে।

‘তাকে (তুহিন) রামপুরাতে চার লাখ টাকা দিয়ে একটা দোকান করে দিই। সেই দোকান বিক্রি করে সব টাকা সে লিটনকে দিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রত্যেক শীতে আমি গ্রামে কম্বল বিতরণ করি। গরিবদের জন্য রাখা সেই কম্বলও সে চুরি করে। এই হলো ওর স্বভাব।’

আক্ষেপ করে বিচারপতি মানিক বলেন, ‘বিভিন্ন জায়গায় চুরি করে সে (তুহিন) ধরা খায়। তখন আমার নাম বলে পার পাওয়ার চেষ্টা করে। এটাই ওর স্বভাব।’

তুহিনের মামাকে হত্যার অভিযোগের বিষয়টি তুলতেই তাৎক্ষণিক নিজের শ্যালক মো. কামালকে ফোন করেন বিচারপতি মানিক।

এ সময় ফোনের অপর প্রান্তের কামালকে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘আমি নাকি তোমাকে হত্যা করেছি।’
তুহিনের মামা কামালের জবাব ছিল, ‘তাহলে আমি এখন আপনার সঙ্গে কথা বলছি কীভাবে! আর ও যদি এসব বলে বেড়ায় তাহলে আমার কী বলার আছে! কী বলব এসব নিয়ে।’