প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোরের বর্ণাঢ্য জীবন

রাজশাহী ব্যুরো : ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে অবশেষে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান প্লেব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর। সোমবার ৬ জুলাই সন্ধ্যা ৬ টা ৫৫ মিনিটে রাজশাহীতে মৃত্যুবরণ করেন। শরীরে নানা ধরনের জটিলতা নিয়ে এন্ড্রু কিশোর অসুস্থ অবস্থায় গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে দেশ ছেড়েছিলেন। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গত ১৮ সেপ্টেম্বর তাঁর শরীরে নন-হজকিন লিম্ফোমা নামের ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে। সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক লিম সুন থাইয়ের অধীনে তাঁর চিকিৎসা শুরু হয়। কয়েক মাস ধরে সেখানে তার চিকিৎসা চলে। দীর্ঘমেয়াদি ও ব্যয়বহুল চিকিৎসায় শিল্পীকে সহায়তা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সিঙ্গাপুরের চিকিৎসা শুরুর কয়েক মাস তাঁর অবস্থা কিছু ভালো হলেও শেষ দিকে এসে আবার অবনতি হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত কোনো উপায় না দেখে করোনার এই সংকট সময়ের মধ্যেই গেল মাসের ১১ তারিখ দেশে ফেরেন তিনি। দেশে ফিরে বোন শিখা বিশ্বাসের বাড়িতে অবস্থান করেন এবং সেখানেই মারা যান।

১৯৫৫ সালের ৪ঠা নভেম্বর রাজশাহীতে জন্মগ্রহণ করেন এন্ড্রু কিশোর। এ হিসেবে মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। রাজশাহীতেই কেটেছে তাঁর শৈশব ও কৈশোর। এন্ড্রু কিশোর প্রাথমিকভাবে সংগীতের পাঠ শুরু করেন রাজশাহীর খ্যাতনামা ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। একসময় গানের নেশায় রাজধানীতে ছুটে যান। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রবীন্দ্রসংগীত, নজরুল সংগীত, আধুনিক গান, লোকগান ও দেশাত্মবোধক গানে রেডিওর তালিকাভুক্ত শিল্পী হন।

১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘মেইল ট্রেন’ সিনেমায় ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানের মধ্য দিয়ে এন্ড্রু কিশোরের চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক যাত্রা শুরু হয়। সেই শুরুর পর থেকে তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এন্ড্রু কিশোরের খুব জনপ্রিয় গানের মধ্যে রয়েছে- ‘হায়রে মানুষ রঙের ফানুস’, ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যে খানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘পদ্মপাতার পানি’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘আমি চিরকাল প্রেমের কাঙাল’প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

জীবনের গল্প আর বাকি রইল না। আজ সোমবার ৬ জুলাই পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চিরবিদায় নিলেন এন্ড্রু কিশোর। বাংলা গানের কিংবদন্তি এই শিল্পী পুরো ক্যারিয়ারে বিখ্যাত সব গান উপহার দিয়েছেন। মানুষের ভালোবাসা যেমন পেয়েছেন, তেমনি পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। এন্ড্রু কিশোর মোট ৮ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন। বাচসাস পুরস্কার পেয়েছেন ৫ বার। এছাড়াও মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এছাড়া সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য দেশ-বিদেশের আরও অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন উপমহাদেশের খ্যাতনামা এই শিল্পী। সবেচয়ে বড় অর্জন কোটি মানুষের ভালোবাসা।

মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী লিপিকা কিশোর ইতি ছাড়াও ছেলে জে এন্ড্রু সপ্তক (২৪) এবং মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা (২৬) রেখে যান। স্ত্রী পাশে থাকলেও দু’সন্তানই বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় পড়াশোনা করেন। মেয়ে সংজ্ঞার পড়াশোনা প্রায় শেষের পথে। ইতোমধ্যে তারা বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছেন। পর্যন্ত তারা বিমানের টিকেট তার মেয়ে ও ছেলে দেশে আসার পর তাঁর দাফনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হবে।

তবে না ফেরার দেশে যাওয়ার আগে স্বজনদের বলে যান, ‘মায়ের পাশেই যেন সমাহিত করা হয় তাকে’। তাঁর মরদেহ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতাল মর্গের হিমঘরে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে। তাঁর মৃত্যুতে রাজশাহীতে শোকের ছায়া নেমে আসে।