২৭ বছর পর মন্ত্রী হারাল সিলেট-১

নিজস্ব প্রতিবেদক : সিলেট-১ আসন থেকে যে দলের প্রার্থী নির্বাচিত হন, ওই দলই সরকার গঠন করে। স্বাধীনতার পর থেকেই এমনটি হয়ে আসছে। তাই এ আসনের রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। এতদিন ছিল সে মর্যাদা, কারণ এই আসনের অধিকাংশকেই দেওয়া হতো পৃথক মর্যাদা ও দায়িত্ব। কিন্তু এবার অন্যথা হলো। শেখ হাসিনার নতুন সরকারে জায়গা হলো না সিলেট-১ আসনের বিজয়ী সংসদ সদস্যের।

গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসন থেকে নির্বাচিত হন ড. এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বিগত সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন। ১১ জানুয়ারি যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে, সেখানে নেই আব্দুল মোমেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্বে এসেছেন আগের সরকারের তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ।

বিগত বছরের জাতীয় নির্বাচন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সিলেট-১ আসনে বেশিরভাগ দলই ভিআইপি প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়। নির্বাচনে বিজয়ের পর মন্ত্রিসভারও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পান তারা। এবারও সিলেট-১ আসনে ভিআইপি প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। নৌকা প্রতীক নিয়ে বিপুল ভোটে বিজয়ীও হন ড. একে আব্দুল মোমেন, কিন্তু এবার মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি তিনি। এতে করে প্রায় ২৭ বছরের মন্ত্রিত্ব হারালো সিলেট সিটি করপোরেশন ও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত সিলেট-১ আসন।

গত ২৭ বছর ধরে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি যেই দলের প্রার্থীই এই আসনে বিজয়ী হয়েছেন তার দল সরকার গঠন করেছে এবং তিনি মন্ত্রী হয়েছেন। এর আগে সর্বশেষ ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন করলে সিলেট-১ আসন থেকে বিজয়ী সংসদ সদস্যকে মন্ত্রিসভায় রাখা হয়নি।

১৯৯১ সালে সিলেট থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন খন্দকার আব্দুল মালিক। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হন হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী। হুমায়ূন রশীদকে আওয়ামী লীগ সরকার জাতীয় সংসদের স্পিকার নির্বাচিত করে।

২০০১ সালে বিএনপি থেকে এ আসনে এমপি হন এম. সাইফুর রহমান। বিএনপি ও জোট সরকারের মন্ত্রিসভায় অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। এর আগে বিএনপি ১৯৯১ সালে সরকার গঠনের পরও সাইফুর রহমানকে টেকনোক্র্যাট অর্থমন্ত্রী করা হয়।

২০০৮ ও ২০১৪ সালে এই আসন থেকে নির্বাচিত হওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত টানা দুই মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান। সাইফুর রহমান, আবুল মাল আবদুল মুহিত ও শাহ এএমএস কিবরিয়ার কারণে দেশের রাজনীতিতে সিলেট মানেই অর্থমন্ত্রী এমন একটা ধারণা জন্ম গিয়েছিল।

এই তিনজন মিলে প্রায় ২৭ বছর দেশের অর্থমন্ত্রণালয় সামলেছেন। নির্বাচিত সরকারের পাশাপাশি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালে সাইফুর রহমান অর্থমন্ত্রী এবং এরশাদ শামসানামলে মুহিত অর্থমন্ত্রণালয় এবং হুমায়ুন রশীদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।

২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আবুল মাল আবদুল মুহিত রাজনীতি থেকে অবসর নিলে তার ভাই ড. এ কে আব্দুল মোমেন সিলেট-১ আসনে প্রার্থী হন। ওই নির্বাচনে জয়ী মোমেনকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এবার আবার এ আসন থেকে মোমেন নির্বাচিত হলেও মন্ত্রিসভায় জায়গা হয়নি তার।

কেবল মোমেনই নন, শেখ হাসিনার নতুন মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি সিলেট বিভাগের আরও তিন মন্ত্রী। পরিকল্পনা মন্ত্রী এমএ মান্নান, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং বন ও পরিবেশ মন্ত্রী শাহাবুদ্দিন নেই নতুন মন্ত্রিসভায়। তাদের বাদ পড়ায় সিলেটজুড়ে চলছে নানা আলোচনা।

নতুন মন্ত্রিসভায় সিলেট বিভাগ থেকে দুজন মন্ত্রী ও একজন প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন। মৌলভীবাজার-৪ থেকে সাতবার নির্বাচিত মো. আব্দুস শহীদ এবার প্রথমবারের মতো মন্ত্রী হয়েছেন। তাকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। সিলেটের বিশ্বনাথের সন্তান সামন্ত পেয়েছেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। আর সিলেট-২ আসন থেকে নির্বাচিত শফিকুর রহমান চৌধুরীকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে।

সিলেট থেকে এবার মন্ত্রিসভায় প্রতিনিধিত্ব কমে যাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে বেসরকারি চাকরিজীবী শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘এমনিতেই সিলেট উন্নয়নবঞ্চিত। নানা দিক দিয়ে পিছিয়ে রয়েছে। এখন মন্ত্রী সংখ্যাও কমে গেছে। এতে সিলেট আরও বৈষম্যের শিকার হবে মনে হচ্ছে।’

সিলেট বিভাগের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে উর্বর এলাকা হিসেবে পরিচিত সুনামগঞ্জ। হাওরবেষ্ঠিত এই জেলা থেকে আব্দুস সামাদ আজাদ, সুরঞ্জিত সেনের মতো উঠে এসেছেন। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বেও ছিলেন তারা। আর দুই মেয়াদে মন্ত্রী ছিলেন এমএ মান্নান। এবার মন্ত্রীহীন সুনামগঞ্জ জেলাও।

এ নিয়ে স্থানীয় রাজীব চৌধুরী বলেন, ‘এমএ মান্নানের উদ্যোগে বেশকিছু উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে। সুনামগঞ্জে রেল যোগাযোগ চালুসহ আরও কিছু উন্নয়ন পরিকল্পনা তার ছিল। এখন এগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া সুনামগঞ্জ-৪ আসন থেকে নির্বাচিত সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিকও এবারের মন্ত্রিসভায় জায়গা পেতে পারেন বলে আশা ছিল আমাদের।’

এমএ মান্নান মন্ত্রী না হওয়ার বিষয়ে লেখক হাসান মোরশেদ ফেসবুকে লেখেন, ‘সরকারের সদ্য শেষ হওয়া মেয়াদে সুনামগঞ্জ থেকে পূর্ণমন্ত্রী ছিলেন একজন, এম এ মান্নান। পরিকল্পনা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি তার ব্যক্তিগত সরল ও ভদ্র আচরণ এবং নির্বাচনি এলাকাসহ সমগ্র সুনামগঞ্জ জেলাজুড়ে বিপুল পরিমাণ কর্মযজ্ঞের বিনিময়ে বিরোধীদেরও মন জয় করে নিয়েছিলেন।

‘এম এ মান্নান এবারও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। মন্ত্রী পরিষদে অন্তর্ভুক্ত হননি, তবে এম এ মান্নানের ব্যক্তিগত সততা, অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতা অন্য কোনো ফরমেটে হলেও প্রধানমন্ত্রী কাজে লাগাতে পারেন। আমার ধারণা রাষ্ট্রকে দেওয়ার মতো সময় তার এখনও আছে।’

এ বিষয়ে সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন বলেন, ‘মন্ত্রী করা না করা সম্পূর্ণ প্রধানমন্ত্রীর এখতিয়ার। কাকে কোথায় প্রয়োজন তিনি তা ভালো বুঝেন। তবে যারা এবার সুযোগ পাননি তারাও যোগ্য। নতুনদের সুযোগ দিতেই তারা বাদ পড়েছেন। নিশ্চয়ই অন্যকোনোভাবে প্রধানমন্ত্রী তাদের মূল্যায়িত করবেন।’