সে আছে সে অমর, মৃত্যুঞ্জয়ী, মৃত্যু নেই তার

জে. অলক চৌধুরী

৯ মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা, স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেশে ফিরে আসার দিন ১০ জানুয়ারী ‘১৯৭২ সন।
এই দিনে বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশে মাথা উঁচু করে ফিরে এসেছিলেন।

লন্ডন থেকে দিল্লিতে নেমে বঙ্গবন্ধু ভাষনে বলেছিলেন ‘‘এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশার অভিযাত্রা”।

বঙ্গবন্ধু নিজে কোনদিন মাথা নত করেনি এমনকি একবার অসুস্থ্য অবস্থায় জেল থেকে বার হওয়ার সময় বঙ্গবন্ধুকে জেলের ছোট গেট খুলে বার হতে বলা হয় উত্তরে তিনি বলেছিলেন “শেখ মুজিব কখনো মাথা নীচু করে না, বড় গেট খুলে দিতে বাধ্য করেন তৎকালীন শাসকদের।

যুদ্ধে পুরা দেশ ধংশ স্তুপে পরিনত হয়েছিলো। তারপরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মাথা নত করেননি।

নিকট অতীতে দেখেছি আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব ব্যাংকে টাকা ছাড়া নিজ অর্থে পদ্মা সেতু এখন বাস্তবতা। তিনিও মাথা নত করেননি।এ যেন পিতারই প্রতিচ্ছ্ববি। আক্ষায়িত করা
তলাবিহীন ঝুঁড়ি থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নত করে মাথা উচুঁ করে জাতিকে সন্মানিত করেছেন আমাদের যোগ্য প্রধানমন্ত্রী।

‘আমরা কারো কাছে মাথা নত করি না। আমরা বিশ্বে মর্যাদার সাথে মাথা উঁচু করে চলবো। এটাই হোক আজকের দিনে আমাদের প্রতিজ্ঞা।’ লাখো শহীদদের ত্যাগের মহিমায় যোগ্য নাগরিক হিসেবে নিজেদেরকে গড়ে তুলে দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করা ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল করতে আগামী প্রজন্মের প্রতি আহবান জানিয়ে চলেছেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মাথা নত করেননি জাতীয় চার নেতা,মাথা নত করেননি অ্যাডভোকেট সেরাজুল হক সহ লক্ষ লক্ষ আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ,যুবলীগের নেতা কর্মীরা।প্রাণ দিয়ে হলেও দেশের ও দলের মান রক্ষা করেছে।

বঙ্গবন্ধু শিখিয়েছিলেন, মাননীয় সভানেত্রী শেখাচ্ছেন তারপর আর মাথা নত করার প্রশ্নই উঠে না।

তারপরেও কেন জানি মনে হয় আমাদের মাথা মাঝে মাঝে নত হচ্ছে বা কেউ ঘাড় ধরে নত করতে বাধ্য করছে।

আজ এই আশংকা ঘুরছে অনেকের মনে।

৫২-৭১ প্রতিটি সংগ্রাম আন্দোলনে আওয়ামী লীগ কখনো আপোষ করেনি মাথা নত করেনি।৭২-৭৫ সন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু সমস্ত ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দেশকে গড়ে তোলার কাজে আত্নবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে গেছেন।এমনকি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও খুনিদের ধমক দিয়ে বলেছিলেন “কি চাস তোরা”।

পশ্চিম বাংলার মূখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি গত নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে বলেছেন “দল মাথা উঁচু করে জিতেছে কিন্তু জনগনের সেবা করবেন মাথা নীচু করে”।

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ কখনো আপোষ করেনি, অনুকম্পাও কামণা করেনি কারো কাছে।কর্মীরা, নিবেদিত নেতারা প্রাণ দিয়ে দেয় হাসি মুখে কিন্তু দলের ইজ্জত ঐতিহ্য বিকিয়ে দেয় না।এটাই হলো আমাদের দলের মাধুর্য ও মর্যাদা।এটাই সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ভাষায় “অনুভূতি”।

যে আশংকার কথা বলছিলাম।বিগত ১৫ বছর ধরে দলে অনুপ্রবেশ ঘটেছে এবং এরা কিছু কিছু অপকর্মে লিপ্ত আর এদের সহায়তা করছে দলের কিছু লোভী নেতা।এমনকি দলের অনেক বড় নেতার আশ্রয়ে তারা বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে, মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে কটুবাক্য বলতেও ছাড়ছে না। গাজীপুর, গোদাগাড়ীর মেয়র তার উদাহরণ।ক’দিন আগে শুনলাম কুমিল্লার উত্তর জেলার সাধারণ সম্পাদকের ফোন আলাপ।চলমান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচনে চাঁদাবাজীর টেলিফোন আলাপ শুনেছি।বিশ্বাস হয় না এরা নাকি আওয়ামী লীগ নেতা। আসলে এরা কেউ আওয়ামী লীগ করেনি কোনদিন।এরা আমাদের চরিত্রহননের জন্য দলে অনুপ্রবেশ করে এখন নিজেরা নিজেদের আওয়ামী লীগের “মার্কেটিং ম্যানেজারের ” ভুমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।এখানেই আমাদের মাথা হেট হয়, এখানেই অনুভূতিতে আঘাত লাগে।তা না হলে ৮০/৮২ সনে চরম আওয়ামী বিরোধী এখন নিবেদিত কর্মীদের মাথায় কাঠাল ভেঙ্গে চরিত্র হননের চেস্টা করে।এখানেই কর্মীরা হতাশ হয় এবং তাদের মাথা নত হয়।

মাথা নত হয় যখন চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলায় নৌকা প্রার্থী ১০২ ভোট, কক্সবাজারে এক ইউনিয়নে ৬৭ ভোট, আরেক ইউনিয়নে ৯৯ ভোট, আরেক ইউনিয়নে ১৪৫ ভোট, সৈয়দপুরে ৯৩ ভোট,বগুড়াতে ১১২ ভোট ও ঝিনেদাতে ৪২ ভোট পেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করে এবং পঞ্চম ধাপের নির্বাচনে কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন পরিষদে নৌকার তিন চেয়ারম্যান প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। এই তিন চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোট পেয়েছেন যথাক্রমে ১১৪, ১৭৭ ও ২৩২টি। এমন বিপর্যয়ের জন্য প্রার্থীরা দুষছেন দলের নেতাদের। এই কারণেই মাথা নত হয়ে পড়ে কর্মীদের তখনই কর্মীদের লজ্জা লাগে যদিও সেই লজ্জা স্থানীয় নেতাদের লাগে কিনা জানি না।

এখন প্রশ্ন হলো কারা এদের নমিনেশন দিয়ে বানিজ্য করেছে? জনপ্রিয় প্রার্থীকে কেনো নৌকা দেওয়া হলো না এই প্রশ্ন তো আমরা করতেই পারি?

ইউপি নির্বাচনে দলীয় ফর্ম বিক্রি থেকে শুরু হওয়ার পর “মার্কেটিং ম্যানেজাররা” জেলা থেকে ঢাকায় এসে হোটেলে অবস্থান করে নমিনেশন বানিজ্য সম্পাদন করে যার ভুরি ভুরি প্রমান ও টেলিফোনে লেনদেন ইত্যাদির প্রমান আওয়ামী লীগের কিছু নেতা কর্মীদের কাছে আছে।অনেকের মত আমারও দেখার ও শোনার ভাগ্য হয়েছে। এই সবের বিরুদ্ধে কথা বললে আপনার মাথা নত হয়ে যাবে কারণ আপনি নিবেদিত,আপনি পরীক্ষিত তারপরও কিছু নব্য চরিত্রহীন অনুপ্রবেশকারী আপানাকে আখ্যা দেবে “চিটার,ভুয়া, মিথ্যাবাদী।রেকর্ড বাজালে বা অপকর্মের প্রমান দেখালেই আস্ফাল কিন্তু শেষ হয়ে যাবে।জেলা ছাত্রলীগের প্রাক্তন সভাপতি লন্টুকে (যিনি মৃত্যু বরণ করেছেন) তাঁকে মিথ্যাবাদী বলতেও এদের মুখে বাধে না কারণ এরা ৮০ সনে তাঁর বাড়ী আক্রমণ করেছিলো শুধু ছাত্রলীগের সভাপতি(১৯৭৮-৮৩)হওয়ার অপরাধে। নিশ্চয় মনে আছে।আমাদেরও মনে আছে।সেদিন ক্ষমা চেয়ে রক্ষা পেয়েছিলেন এও জানি প্রয়োজনে আবার তাই-ই করবেন আমি নিশ্চিত।সময়ই কথা বলবে কারণ এটাই হলো রাজনীতির মারপেঁচ।

এই সব কারণে আমাদের মাথা নত হয়।এই তো কয়েকদিন আগেই মেয়র নমিনেশনের জন্য ভুয়া লোকের কাছে ধর্না ধরেছেন কতই না অনুনয়-বিনয় করেছেন আর বছর ঘুরতে না ঘুরতেই তারা”ভুয়া”হয়ে গেলো?
এখানেই আমাদেরর লজ্জা আর নব্যদের গর্ব,কারণ এই নব্য অনুপ্রবেশকারীরাই বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্লট তৈয়ারী করেছিলো।

কিছু দিন আগে কলেজ ক্যান্টিনের আকবরের সহায়তা তহবিল গঠন করার সময় কারো কারো চরিত্রহনন শুরু হলো। বলেন তো এটা কি কোন চাঁদাবাজি, নাকি নমিনেশন বানিজ্য যে উঠে পড়ে লাগলেন? আসলে দল বদল আর চরিত্র বদলের মধ্যে কোন প্রার্থক্য নেই।এটাই তো প্রমান হলো।
কারো কারো আচরণে মনে হয় আওয়ামী লীগ এদের কাছে লীজ দেওয়া হয়েছে।তাই “মার্কেটিং ম্যানেজাররা” এত একটিভ।

যাহোক অপকর্মের কথাগুলো বললে হয়ত পাঠকদের এক ঘেয়েমী লাগবে তাই প্রসঙ্গে আসি।

রক্তের তেজ কত শক্তিশালী তার প্রমান রেখেছেন বঙ্গবন্ধু নিজেই।১০ জানুয়ারি বলেছিলেন নিজের রক্ত দিয়ে শহীদদের রক্ত ঋণ শোধ করবেন। কিসের ঋণ?এটা বাংগালীর ভালোবাসার ঋণ।

মুক্তিযোদ্ধা কবি রফিক আজাদ লিখেছেন”এই সিঁড়ি নেমে গেছে বঙ্গোপসাগরে, সিঁড়ি ভেঙে রক্ত নেমে গেছে- বত্রিশ নম্বর থেকে সবুজ শস্যের মাঠ বেয়ে অমল রক্তের ধারা বয়ে গেছে বঙ্গোপসাগরে”।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন ” আমাদের শরীরে একই রক্ত, আমরা পরীক্ষিত “।

১৭ আগস্ট ৭৫ উর্দ্দু ভাষার প্রক্ষাত কবি নওশাদ নূরী লিখেছিলেন “তোমরা কি জানো? তোমরা কি জানো? পথের শুরুটা হয়েছিল এইখানে, পথ খোয়া গেল, হায়, সেও এইখানে”। তিনি আরেকটিতে লেখেন-“সে আছে, সে আছে- সর্বদা হাজির সে যে, অফুরান শক্তি হয়ে সে আছে, সে আছে সে অমর, মৃত্যুঞ্জয়ী, মৃত্যু নেই তার”।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কবিতা লিখে কারাবন্দি হন পাঞ্জাবি কবি আহমেদ সালিম। লাহোর ডিস্ট্রিক জেলে বসে লেখা তাঁর ‘সিরাজউদ্দৌলা ধোলা’ কবিতাটি তিনি উৎসর্গ করেন শেখ মুজিবুর রহমানকে। শেখ মুজিব তাঁর চোখ”সিরাজউদ্দৌলার মতো স্বাধীনতার রক্ষক”।এখানে আমার কিছুটা দ্বিমত আছে আর তাহলো নবাব আয়েশী জীবনযাপন করেছেন এবং পরাজিত হওয়ার পর পালিয়ে গিয়ে হত্যার স্বীকার হন বিশ্বাসঘাতকদের হাতে ও ষড়যন্ত্রে।

আর বঙ্গবন্ধু সাধারণ জীবন যাপন করতেন সাধারণ মানুষের মত তিনি ছিলেন মেঠো বাংগালী তিনি পালিয়ে যাননি। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বীরের মত হুংকার দিয়ে বুক পেতে দিয়েছেন,জেলে চার জাতীয় নেতা বিশ্বাস ভঙ্গ করেননি।

এখানেই আমাদের আদর্শ নিঃসন্দেহে আমরা ১০ জানুয়ারির মত মাথা উঁচু করে দাড়াবো চিরকাল। আওয়ামী লীগের নিবেদিত প্রাণ কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর মত শির দাঁড়া সোজা করে দেখিয়ে দিবে রক্তের ধারা।।আমরা মাথা নত করিনা করবো না কোনদিন। যতদিন বেঁচে থাকবো মাথা উঁচু করেই বাঁচতে শিখেছেন আমাদের মহানায়ক।১০ জানুয়ারীর এটাই শিক্ষা দেয়।

জয় বাংলা।
জয় বঙ্গবন্ধু।