শেখ হাসিনার কূটনীতি নিয়ে দ্য ডিপ্লোম্যাটের নিবন্ধ

নিজস্ব প্রতিবেদক

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছেন শেখ হাসিনা। নির্বাচনের পরেই ভারত, চীন এবং রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি এশীয় এবং মিত্র দেশ থেকে অভিনন্দন বার্তা পেয়েছেন শেখ হাসিনা। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো শক্তিশালী পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশগুলো প্রায় নীরব থেকেছে।

নির্বাচনের এক মাস পর শেখ হাসিনা মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছ থেকে সহযোগিতার চিঠি পান। এরপর গত সপ্তাহের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে।

নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে উদ্বেগ থাকা সত্ত্বেও মার্কিন অবস্থানের এই পরিবর্তন শুধু ওয়াশিংটনের ইচ্ছার ফল নয়, বরং শেখ হাসিনার কূটনৈতিক দক্ষতারও ফল এটি। বন্ধুত্ব অর্জনের জন্য শেখ হাসিনা দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন।

শেখ হাসিনা এখন পর্যন্ত চার মেয়াদে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং বর্তমানে পঞ্চম মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন। শেখ হাসিনার এই সফল রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের রাস্তাটি কেমন ছিল? কীভাবে তিনি বাংলাদেশের পাশাপাশি বিশ্বমঞ্চে একজন প্রভাবশালী রাজনীতিক হিসেবে নিজের জায়গাকে শক্তিশালী করেছেন?

আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান হিসেবে সবচেয়ে বেশি সময় দায়িত্ব পালন করেছেন শেখ হাসিনা। দলের ইতিহাসে অন্য কোনো রাজনীতিবিদ এত দীর্ঘকাল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দেননি। আওয়ামী লীগে প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন একজন নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তিনি। একইসঙ্গে জনসাধারণের কাছেও মুখ্য নেতৃত্ব হয়ে উঠেছেন শেখ হাসিনা। ১৯৬০ এবং ১৯৭০ এর দশকে তার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের অবিসংবাদিত নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখা হয় তাকে।

যাইহোক, রাজনীতিতে শেখ হাসিনার উত্থান মসৃণ ছিল না। ১৯৮১ সালে নির্বাসন থেকে ফেরার পর, বিভক্ত আওয়ামী লীগকে একত্র করা তার জন্য ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ২১ আগস্ট বোমা হামলায় আইভি রহমানসহ দলের বেশ কয়েকজন নেতার হত্যার ফলে তিনি দুর্বল হয়ে পড়েন। তদুপরি, তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসকের থেকেও নানা ধরনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন তিনি। এসব বাধা সত্ত্বেও, দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে এবং এর চূড়ান্ত পুনরুত্থানের পথ প্রশস্ত করার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে প্রমাণিত হয়েছে।

আ.লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক রুমিন ফারহানা দ্য ডিপ্লোম্যাটকে বলেছেন, ‘পনেরো বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা সহজ কীর্তি নয়। বিশেষত যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু অভিযোগ রয়েছে। হাসিনা তার এক দশকের শাসনামলে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোকে দমন করতে শক্তি প্রয়োগ করেছেন। তার সরকার ভিন্নমতের কণ্ঠকেও রুদ্ধ করেছে। গুম, খুন, গ্রেপ্তারসহ নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে।’

বাংলাদেশের অনেকেই বিশ্বাস করেন, শেখ হাসিনার দীর্ঘ নেতৃত্ব শুধু দলের অভ্যন্তরে এবং দেশের মধ্যে নয় বরং তা বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কে তার বুদ্ধিদীপ্ত উপলব্ধিও তাকে দর কষাকষির করতে সাহায্য করেছে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বলতে গেলে বাংলাদেশের দ্বিতীয় শীর্ষ ক্ষমতাধর ব্যক্তি ওবায়দুল কাদের যেমন উল্লেখ করেছেন, ‘শেখ হাসিনার প্রভাবের পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক কূটনীতি। তিনি সবসময় অর্থনৈতিক কূটনীতিকে অগ্রাধিকার দেন, যা আমি মনে করি তার পররাষ্ট্রনীতির মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে।’ ওবায়দুল কাদের দ্য ডিপ্লোম্যাটের সঙ্গে কথা বলার সময় এই উদ্বৃতি দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি কোভিড-১৯ সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে ভালো করেছে। এই অর্থনীতি বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিকে শক্তিশালী করেছে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে শেখ হাসিনার অবস্থানকে আরও দৃঢ় করেছে।

শেখ হাসিনার ভারত, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনীতিকে পরিপক্ব করেছেন। দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের বড় ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্কও রয়েছে যা এই সম্পর্ককে আরও মজবুত করেছে। চীন বাংলাদেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য গত বছর $১৬ বিলিয়নে পৌঁছেছে। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে ভারত। এদিকে, রাশিয়া বাংলাদেশে ১২ বিলিয়ন ডলারের একটি বিশাল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প।

পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান পোশাক রপ্তানির প্রধান ক্রেতা। ইউরোপ ও আমেরিকায় পোশাক রপ্তানি করে গত বছর বাংলাদেশ আয় করেছিল ৪৭ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশের এই ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক অগ্রগতি বিশ্ব অর্থনীতিতে দেশটির ক্রমবর্ধমান গুরুত্বকে স্বীকার করে। ক্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাংলাদেশ একটি ক্রমবর্ধমান আকর্ষণীয় বাজারে পরিণত হচ্ছে। গত নির্বাচনের ঠিক আগে বাংলাদেশে সফরে এসেছিলেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ। সফরকালে তিনি বাংলাদেশ-ফ্রান্স এভিয়েশন জায়ান্ট এয়ারবাসের জন্য ৩ বিলিয়ন ডলারের একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদের মতে, ‘ভৌগোলিক অবস্থান এবং বর্তমান বৈশ্বিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বাংলাদেশকে ভারত ও চীন উভয় আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। পাশাপাশি এটি বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতে সক্ষম করার ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা পালন করে। আর শেখ হাসিনার অটল কূটনীতি আজ আমাদের বিশ্ব মঞ্চে একজন উল্লেখযোগ্য খেলোয়াড় হিসেবে তৈরি করেছে।’

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল নীতি, ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’। কয়েক দশকের স্থিতিশীল অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়ন বাংলাদেশকে অধিকতর আত্মবিশ্বাস ও দৃঢ়তার সাথে আন্তর্জাতিক আলোচনায় যুক্ত হতে এবং দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক উভয় প্ল্যাটফর্মে তার স্বার্থ অন্বেষণ করতে সক্ষম করেছে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) সাবেক চেয়ারম্যান মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, ‘‘কূটনীতি ও বাণিজ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাফল্য তার সমকক্ষরা স্বীকার করেন। এ ছাড়াও, তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে বৈশ্বিক সমস্যা নিয়েও খুব সোচ্চার ছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের আক্রমণকে ‘গণহত্যা’ বলে আখ্যায়িত করে একটি জোরালো বিবৃতি দিয়েছেন শেখ হাসিনা। পাশাপাশি তার সরকারও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অন্যান্য দেশকে সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন শেখ হাসিনা।”

বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা সুজিত রায় নন্দী শেখ হাসিনার দক্ষতার প্রশংসা করে ডিপ্লোম্যাটকে বলেন, ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণে শেখ হাসিনার দৃঢ়তার প্রশংসা করতেই হবে। অতীতের অভিজ্ঞতা শেখ হাসিনাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে এবং তার লক্ষ্য অর্জনে সাহায্য করেছে। তিনি প্রথমে তার দলে শৃঙ্খলা এনেছেন এবং তারপরে তার যোগাযোগের শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। এবং এই দৃঢ়তা ও শক্তি শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশকে কূটনৈতিকভাবে আরও ভালো করতে সাহায্য করেছে।’