শতবর্ষী এক হালিমন নেছা

শতবর্ষী এক হালিমন নেছা-র গল্প :
হালিমন নেছার বর্তমান বয়স প্রায় ১০০ ছুঁই ছুঁই। তিনি শহীদ মতিউর রহমান সরদার এর সহধর্মিনী। বাবার বাড়ি থেকে বধু হয়ে স্বামীর বাড়ি এসেছিলেন ১৫ বা ১৬ বছর বয়সে। বাবার বাড়ির সবাই পরহেজগার। তিনিও সেই ধারা নিয়ে স্বামীর বাড়িতে উঠেছেন। গৃহস্থ পরিবারের বউ হয়ে এসেই সারাদিন গৃহস্থালি নানা কাজে কর্মে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তবুও তার মনে কোন ক্লান্তি নেই। তার উপর আরোও একটি গুরুদায়িত্ব তার মনের মধ্যে স্বপ্ন বেঁধে রয়েছে। আর দেরি নয়, বধু হয়ে এসেই তিনি বাড়ির উঠোনে বিছানা পেতে ছেলে মেয়েদের বিনা পয়সায় নামাজ ও কোরআন শিক্ষার মক্তব শুরু করে দেন। এতে স্বামী বেছারা কোন প্রকার আপত্তি করেন নি। এমন ভাল কাজে কেউ আপত্তি করতে পারে ?

দিনে দিনে তার ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক সময় পুরো উঠোন ভরে যায় ছাত্র ছাত্রী দিয়ে। সংখ্যার দিক দিয়ে তা ৫০/৬০ জনের বেশী হবে। হাতে বেতের লাঠি নিয়ে টুলে বসে সবার ছবক নিচ্ছেন এবং নতুন পড়া দিচ্ছেন। দিন চলে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীরা সিপারা, আমপাড়া শেষ করে কোরআন নিচ্ছে। এবার তিনি ভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করলেন। যারা কোরআন পড়ছে তাদের দিয়ে ছোটদের পড়া নিচ্ছেন এবং নতুন পড়া দিচ্ছেন। এভাবেই সময় চলে যাচ্ছে। দিন দিন হালিমন নেছার সুনাম পুরো গ্রাম ছড়িয়ে পড়ছে। ছাত্র ছাত্রীদের সংখ্যা আরোও বেড়েই চলছে।
কোরআন খতমের সময় শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা গামলা ভর্তি খৈ আর বাতাসায় পুরো উঠোন মক্তবে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায় !

কোরআন শেষ হলে শুরু হয় নামাজ পড়ার নিয়ম কানুন শেখানোর পালা। তাতে থাকছে ৫ ওয়াক্ত ছাড়াও, তাহাজ্জুত, ইশরাক, আউয়াবিন, হাজত,সালাতুত তাসবিহ সহ নানা রকম নামাজ, তসবিহ ও আমলের শিক্ষা। এ ছাড়াও থাকছে, পানি পান করার দোয়া, রান্না শুরু করার দোয়া, টয়লেট করার দোয়া, ঘুমাবার দোয়া, খাবার শুরু ও শেষ করার দোয়া ইত্যাদি।

এভাবেই বছরের পর বছর চলতে থাকে হালিমন নেছার উঠোন মক্তব। হালিমন নেছা বয়সের ভারে দূর্বল হয়ে পড়েন। নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে আর আগের মতো শক্তি পান না। যার কারণে ২০১০ সালের পর থেকে তিনি এই মক্তব আর চালিয়ে নিতে পারছেন না। এতোদিনে হালিমন নেছার মক্তবের ছাত্র ছাত্রীদের বিয়ে-শাদী হয়ে ছেলে পুলে এমন কি অনেকেই নাতি- নাতনির মুখ দেখে ফেলেছেন। যে যেখানেই থাকুক না কেন, শহর কিংবা বিদেশে, বাড়ি এলেই সবাই ওস্তাদজীর সাথে দেখা না করে পারে না। যাদের বিয়ে শাদী হয়েছে তাদের প্রায় সবাই মুরুব্বীয়ান কাপড়টা ওস্তাদজীর বাড়িতে পৌছে দিতে ভুল করেনি। সাথে মিষ্টির পুটলিটাও। হালিমন নেছার এ উঠোন মক্তবে পড়েছেন এমন ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা আমরা একটু হিসেব কষে দেখতে পারি। ১৫ বছর বয়সে বিয়ে, ২০১০ সাল থেকে আর পড়াতে পারছেন না। তার মানে মোট পড়িয়েছেন ১০০- (১৫+১১)=৭৪ বছর। প্রতি বছর গড়ে ১০০ জন হলে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা দাড়ায় ৭৬০০ জন। তার দাবী এ সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে বহু আগেই।

স্বাধীনতার পর পরই হালিমন নেছার সাংসারিক কাজ কর্ম শুধুমাত্র রান্নাবান্না ছাড়া গৃহস্থালি কাজ অনেকটাই কমে যাওয়ায় তার সময় কেটেছে উঠোন মক্তবের ছেলে মেয়েদের পড়িয়ে আর বাকি সময় রোজা নামাজ কোরআন তেলাওয়াত আর বন্দেগী করে। হালিমন নেছা দৈনিক ৫ ওয়াক্ত নামাজ ছাড়াও, নিয়মিত তাহাজ্জুত, সালাতুত তাসবিহ, ইশরাক, আউয়াবিন, হাজতের নামাজ সহ আরোও নানাবিধ সুন্নত ও নফল নামাজ পড়তেন। প্রতিদিন ভোর সাড়ে চারটার সময় (সময় ভেদে) গভীর ঘুমের মধ্যেই তিনি মসজিদ থেকে ফজরের আযান শুনতে পান।

প্রতিদিন ফজরের নামাজ শেষ করে হালিমন নেছা প্রায় এক ঘন্টাকাল বিভিন্ন দোয়া দরূদ পড়েন। ফাঁকে ৪ রাকাত ইশরাকের নামাজ আদায় করে নেন। তারপর শুরু করেন কোরআন তেলাওয়াত। তিনি প্রতিদিন দুই বেলা কোরআন তেলাওয়াত করেন এবং প্রতিবারেই ১ পারা পড়ে শেষ করেন। ১৫ দিনেই কোরআন খতম করেন। মাঝেমধ্যে কোন বেলা পড়তে না পারলেও প্রতি মাসে ১ খতম করা চাই-ই। এখনো তিনি নিয়মিত ৫ ওয়াক্ত নামাজ এবং কোরআন তেলাওয়াত করেই যাচ্ছেন। শরীর খুব বেশী খারাপ না করলে তিনি থামেন না। হিসেব কষে দেখতে পারি তিনি সারা জীবনে কতবার কোরআন খতম দিয়েছেন। ১০০-১৫ = ৮৫ বছর। প্রতি মাসে গড়ে ১ বার করে খতম দিলে ৮৫ বছরে কমবেশী ১০২০ বার হয়।

হালিমন নেছা অসাধারন আল্লাহ ভক্ত মানুষ। আল্লাহ, রাসুল (সা:), কোরআন এবং পরকালের প্রতি তার অগাধ বিশ্বাস ! কবরের শাস্তি নিয়ে সব সময়ই তিনি ভীষণ চিন্তিত থাকেন ! ফজরের পর ইশরাকের নামাজ পড়ে বলেন, এই নামাজে ওমরা হজ্বের ছোয়াব। কোরআন পড়ার সময় চোখের জ্যোতি বাড়ানোর জন্য দোয়া পড়ে চোখে ফুক দেন।

হালিমন নেছা কোন শ্রেণি পযন্ত লেখাপড়া করেছেন নিজে বলতে পারেন না। তবে ইসলামী কিতাবের অনেক বই পড়েছেন। নবীদের জিবনী পড়তে বেশী পছন্দ করেন। ক্যাসেট প্লেয়ারে ইসলামী গজল এবং মৌলানা সাহেবদের ওয়াজ শুনতে ভাল বাসেন। এক সময়ে চিঠি লেখায় বেশ পটু ছিলেন। ঘরে বসে ছেলে মেয়েদের চিঠি লিখতেন। কোন কোন শব্দ শক্ত করার জন্য মাঝেমধ্যে ডাবল অক্ষর দিতেন। যেমন, জন্ন্য,ইস্কুল ইত্যাদি। হিসেবের খাতা থাকতো কয়েকটি। কোন ক্ষেতে কত মণ ধান হয়েছে, মোট কত মণ,পাড়াপড়শীরা কে কত টাকা ধার নিয়েছে, কত পরিশোধ করেছে , কত বাকি রয়েছে, সবই খাতায় লিখে রাখতেন।

একবার ছেট ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে এ্যলজাবরার সূত্র পড়ছে। তিনি ভুল ধরে দিয়ে সঠিক সূত্রটি ছেলেকে বলে দিলেন। ছেলে তো অবাক ! কোথা থেকে শিখলেন ? সাদামাটা জবাব, বড় ছেলে যখন পড়েছে, তখন তিনি শুনে শুনে মনে রেখেছেন।

হালিমন নেছা গরীবদের খুব ভাল বাসতেন। নিজের শাড়ী, ব্লাউজ, পেটিকোট সবই গরীবদের দিয়ে দিতেন। রমজানে তার ইফতারের প্লেটের চারদিক ঘিরে ৫/৬ জন গরীব বসে থাকতো। ইফতার করায়ে রাতের খাবারও দিয়ে দিতেন। এ জন্য রমজানের সময় তার খরচের পরিমাণ ছিল বেশী। মাদ্রাসা থেকে এতিম শিশুরা সাহায্য চাইতে আসলে তিনি কখনো চাল/ধান মেপে দিতেন না।
হালিমন নেছা-র মধ্যে ছিল হিন্দু সম্প্রীতি। দুই ঈদে হিন্দুরাই থাকতো তার আসল মেহমান। কোরবানী ঈদের সময় মুরগি, পোলাওর চাল, সেমাই,চিনি হিন্দুদের ঘরে ঘরে গিয়ে দিয়ে আসতেন।
হালিমন নেছার আল্লাহ এবং কোরঅনের প্রতি যে গভীর বিশ্বাস রয়েছে তার কিছু কোরআনের মোজেজা আমরা উপলব্দি করি। ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক সেনারা তার বাড়িতে উঠে পড়ে। তিনি তার ১ বছরের কন্যা সন্তানকে বাম হাতে জড়িয়ে ডান হাতে কোরআন নিয়ে বাড়ির পাশের ধানের জমিতে অল্প পানির মধ্যে লুকিয়ে ছিলেন। পাক সেনারা ২ ঘন্টা অবধি সেখানে অবস্থান করছিল। ভাগ্যিস ! শিশুটি কেঁদে উঠেনি। শিশুটি কেঁদে উঠলেই ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকা ৩০/৩৫ জন নারী-পুরুষ পাক সেনাদের হাতে মারা যেতো ! ঐদিনই পাকসেনারা হালিমন নেছার স্বামী মতিউর রহমান সরদারকে গুলি করে হত্যা করে। মতিউর রহমান সরদারের লাশটি বাড়ির উঠোনে পড়ে ছিল। একই দিনে পাকসেনারা সেই গ্রামের আরোও ৭ জন নারী-পুরুষকে হত্যা করে।

হালিমন নেছার ২ ছেলে মুক্তিবাহিনী। স্বাধীনের পরপর তারা বাড়ি ফিরে আসতে বিলম্ব হওয়ায় গ্রামবাসীরা মনে করেছিল হালিমন নেছার ২ ছেলে বোধ হয় বেঁচে নেই। এমন সংবাদ হালিমন নেছার কানে পৌছে। হালিমন নেছা অজু করে কোরআন তেলাওয়াত করতে থাকেন। আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে মোনাজাত করতে থাকেন। হালিমন নেছার মনে সাহস আসে। তিনি বোঝতে পেরেছেন তার মুক্তিযোদ্ধা ২ সন্তানই বেঁচে আছে।

হালিমন নেছা এখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। ২০১০ সাল থেকে নানা অসুখে ভোগছেন। ষ্ট্রোক করেছেন ৩বার। সমস্ত শরীরে এলার্জীতে ফোসকা পড়ে গেছে। হার্টের সমস্যা, চোখের সমস্যা, শ্বাস-প্রশাসের সমস্যা। হাটতে পারেন না। নিজের কাজ নিজে করতে পারেন না। সব কিছুতেই অন্যের সাহায্য দরকার হয়। তবুও নামাজ, কোরআন তেলাওয়াত ছাড়ছেন না। শুয়ে শুয়ে নামাজ আদায় করছেন। চেয়ারে বসে টি টেবিলের উপর বালিশ দিয়ে জায়নামাজ বিছায়ে নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করছেন। বড়াই করে বলেন, হযরত আইয়ুব নবীর গায়ে পচন ধরে দুর্গন্ধ হয়েছিল। ত্বকে পোকা ধরেছিল। ওগুলো ছিল আইয়ুব নবীর জন্য আল্লাহর পরীক্ষা ! আমার জন্যও এগুলো আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে পরীক্ষা !!

হালিমন নেছা কখনো নিজের খাবারের জন্য চিন্তা করেন না। আগামী কাল কি খাবেন তাও কখনো ভাবেন না। রিজিক আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকেই তার কাছে চলে আসে। ঢাকায় তিনি একাধিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অধীনে চিকিৎসাধীন আছেন। প্রফেসর বরেন চক্রবর্তী- কার্ডিওলজিষ্ট, প্রফেসর কবীর চৌধুরী- ডার্মাটোলজিষ্ট, প্রফেসর আনোয়ার উল্লাহ- নিউরোলজিষ্ট, প্রফেসর শামসুন নাহার- ফিজিক্যাল মেডিসিন, প্রফেসর মোতাহার হোসেন- অফথালমোলজিষ্ট, প্রফেসর আনোয়ারুল ইসলাম-ইউরোলজিষ্ট। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারগণ পুঁথিগত মেডিকেল সায়েন্স থেকে রোগের বিবরণ শুনে ওষুধ লেখেন। কিন্তু, প্রত্যেকেই হালিমন নেছার কাছে নিজেদের জন্য, তাদের ছেলে মেয়েদের জন্য দোয়া চাইতে ভুল করেন না।
একবার নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সানজিদা ইয়াসমিন এক বিশেষ কারণে হালিমন নেছার বাড়ি গিয়ে ছিলেন। হালিমন নেছাকে দেখে তিনি তার এবং তার পরিবারের জন্য দোয়া চাইলেন।
এ বছর ২০২১ ফেব্রুয়ারীতে হালিমন নেছাকে উন্নত চিকিৎসা সেবার জন্য শরীয়তপুর থেকে এ্যম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নিয়ে আসেন তার ছোট ছেলে। কিছুদিন পরই রমজান। হালিমন নেছা ছেলেকে জানান দিলেন তিনি রোজা করবেন। পুরো ৩০টি রোজাই রাখলেন। ৫ ওয়াক্ত নামাজসহ তারাবি নামাজও পড়লেন। কোরআন শরীফ খতম দিলেন। সুবহান আল্লাহ !

আল্লাহর প্রতি এমন অগাধ বিশ্বাস আর ভালবাসার জোরেই হয়ত তিনি এখনো নামাজ কোরআন তেলাওয়াত চালিয়ে যেতে পারছেন। মহান আল্লাহ সুবহানাল্লাহু তায়ালার কাছে আমরাও তার আরামদায়ক সুস্থ্যতা ও নেক হায়াত প্রার্থনা করছি।আমীন !!

হালিমন নেছা-র বাড়ি ; শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার পূর্ব লোনসিং গ্রামে। বর্তমানে তিনি ঢাকায় তার ছোট ছেলের বাসায় আছেন।