বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ ভাষাশহীদদের

শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বৃহস্পতিবার ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে সর্বস্তরের মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক : ভোর হতেই দেশের সব রাজপথ যেন মিশে যায় শহীদ মিনারে। মায়ের ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে জয়ী বীর বাঙালি জাতি আবারও বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করে তার গর্বিত পূর্বসূরিদের।

দেশের উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখা, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা আর সমাজে শান্তির সুবাতাস বইয়ে দেওয়ার অঙ্গীকারে বৃহস্পতিবার সারাদেশে পালিত হলো মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।

শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বৃহস্পতিবার ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে সর্বস্তরের মানুষ

রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শহীদ মিনারের বেদিগুলোও এদিন ভরে ওঠে ফুলেল শ্রদ্ধায়। ফাল্গুন ভোরের হিম হাওয়ায় নগ্ন পদে সবাই ছুটে যান শহীদ মিনারে। দুপুর অবধি রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ছিল লাখো মানুষের ঢল। মা, মাটি, দেশ আর মাতৃভাষার প্রতি বাঙালির অপরিসীম মমত্ববোধের চিরায়ত প্রকাশ ঘটে এদিন। ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহীদদের প্রতি শিশু-কিশোর, বৃদ্ধ, যুবা, তরুণ-তরুণী, পাহাড়ি, বাঙালি, ভিনদেশি, ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবাই সারিবদ্ধভাবে শহীদ বেদিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় সবার কণ্ঠে ছিল অমর একুশের কালজয়ী সেই গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি…।’

বুধবার মধ্যরাতে ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছোঁয়ার আগেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের সারি দেখা যায় শহীদ মিনারে। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর্ব শেষ হলে শহীদ মিনার সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়। তবে শ্রদ্ধার্ঘ্য অপর্ণের জন্য বৃহস্পতিবার সকালে নামে মানুষের ঢল। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে আসা সর্বস্তরের মানুষের সারি আরও দীর্ঘ হয়। এই দিনে বাঙালির শোককে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বুধবার রাতের চকবাজারের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। আগুনে পোড়া শতাধিক হতাহতের স্বজনের দুঃখ-বেদনা যেন সালাম-বরকতদের শোকে লীন হয়ে তৈরি করে মর্মন্তুদ এলিজি। চকবাজারের আগুনে স্বজনহারাদের হাহাকার ঢাকা মেডিকেল কলেজের করিডোর আর মর্গ পেরিয়ে এসে মেশে শহীদ মিনারের অর্ধনমিত জাতীয় পতাকায়, প্রভাতফেরির কালো পোশাকে।

সভাপতি এ. কে. আজাদের নেতৃত্বে একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন

একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্র্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে ভাষাশহীদদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাত ১২টা ১ মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপরই শ্রদ্ধা জানান প্রধানমন্ত্রী। এরপর স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় প্রধান হিসেবে আওয়ামী লীগের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য ও দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ে শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন। এরপর একে একে শ্রদ্ধা জানান ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া, বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন প্যানেল মেয়র মোস্তফা কামাল। সহকর্মীদের নিয়ে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান। শ্রদ্ধা জানান ঢাকার বিভিন্ন মিশনের কূটনীতিক, একাত্তরের সেক্টর কমান্ডার এবং মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের নেতারা। শহীদ বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন সৈনিক, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, সেনা, নৌ, বিমানবাহিনী, পুলিশ, র‌্যাবসহ বিভিন্ন সংগঠন। বিশিষ্টজনের শ্রদ্ধা জানানোর পর সবার জন্য উন্মুক্ত হয় শহীদ মিনার।


বিশিষ্টজনের প্রতিক্রিয়া: বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায় শহীদ মিনারে ফুল দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখ। শ্রদ্ধা নিবেদনের পর ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, বিশ্বের ৩৩ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। ভাষার দিক দিয়ে এর অবস্থান সপ্তম। তাই বাংলাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষার দাবি গোটা জাতির। এ বিষয়ে সরকার কাজ করছে।

তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ভাষাশহীদরা জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। তাদের অবদানে আজ বাংলা ভাষা বিশ্ব দরবারে স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছে স্বাধীনতা।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলটির নেতাকর্মীরা বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় ভাষাশহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। পুষ্পস্তবক অর্পণের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গণতন্ত্র হরণ করে সরকার একুশের চেতনাকে ভূলণ্ঠিত করেছে। এ সময় তিনি দলীয় চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ বিরোধী নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি জানান।

বিভিন্ন সংগঠনের শ্রদ্ধা নিবেদন: সভাপতি এ. কে. আজাদের নেতৃত্বে একুশের প্রথম প্রহরে শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা জানায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন। প্রথম প্রহরে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে শ্রদ্ধা জানায় জাসদের দুই অংশ, ওয়ার্কার্স পার্টি, সিপিবি, সাম্যবাদী দল, বাসদ, গণতন্ত্রী পার্টি, ন্যাপসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে শ্রদ্ধা জানায় ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রমৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট। ভোরে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি) কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায়। এ সময় নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানম, ইসি সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায় সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ

আরও শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ইডেন মহিলা কলেজ, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার সরকারি মাদ্রাসা-ই-আলিয়া, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, বাংলাদেশ সরকারের আইসিটি ডিভিশন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি), রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ে, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ, রাজউক ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স সমিতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, জাতীয় প্রেস ক্লাব, সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্ট, সামাজিক মহিলা ফোরাম, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, শিল্পকলা একাডেমি, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, কেন্দ্রীয় খেলাঘর আসর, বাংলা একাডেমি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, মহিলা পরিষদ, ছাত্রদল, শ্রমিক দল, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগ, ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স (আইবি), ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স (আইডিবি), বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় গার্হস্থ্য নারী শ্রমিক ইউনিয়নস, ঢাকা নার্স কলেজ, বাংলাদেশ এনজিও ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন। শহীদ মিনারের পাশাপাশি আজিমপুর কবরস্থানে ভাষাশহীদদের কবরেও শ্রদ্ধা জানায় আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।