বাবা বুলবুলকে লেখা চিঠি

নিজস্ব প্রতিবেদক : জানো বাবা, আমার না শরীরটা মনে হয় খারাপ। আজ দুই দিন হলো চুপটি করে বসে থাকলেও দুই চোখ দিয়ে শুধু পানি ঝরছে তো ঝরছেই। কী যে হলো চোখ দুটোর কিছুই বুঝতে পারছি না। সব কেমন যেন এলোমেলো দুঃস্বপ্নের মত মনে হচ্ছে। মাথাটা খুব ঝিম ঝিম করছে আমার। আমি কাঁদছি না, একদম কাঁদছি না, তবুও। আচ্ছা, তুমি কেমন মানুষ গো বাবা! আমার সাথে কথা না বলে এতো সময় আছো কী করে, আমাকে ছেড়ে! এতো সময় তো তুমি আমার সাথে কথা না বলে থাকো না! এখন কেন এমন করছো তুমি বাবা! জানো না, তোমাকে না দেখলে বা তোমার সাথে কথা না বললে আমার খুউব কষ্ট হয়!

বাবা, তুমিতো ভালো করেই জানো তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারি না! তুমি বলতে তুমিই আমার বাবা, তুমিই আমার মা। তাহলে এমন করছো কেন তুমি। আমি কি খুব বড় হয়ে গেছি যে আমার উপর এতটাই চাপ দিচ্ছো তুমি! আমি তো কখনোই বড় ছিলাম না বাবা! আমি বড় হতেও চাইনি কখনো। সেটা ছিল ২০১২ সাল, আমি তখন বেশ ছোট। মনে পড়ে বাবা, তুমি মানবাতাবিরোধী অপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আদালতে প্রথম যেদিন সাক্ষী দিতে গিয়েছিলে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। তুমি বলেছিলে, আমি নাকি ছোট মানুষ, তাই খামোখাই ভয় পাচ্ছি, দুশ্চিন্তা করছি। তখন থেকেই আমি ছোটই থাকতে চেয়েছি। এই সাক্ষী দেবার জন্যই নাকি ওরা ২০১৩ সালের ৯ মার্চ রাতে মিরাজ কাকুকে হত্যা করে কুড়িল উড়ালসেতুর পাশে ফেলে রেখে যায়। তখন আমার খুউব ভয় করেছিলো তোমাকে নিয়ে। ভাবছিলাম, তোমার যদি কিছু হয়! কিন্তু আমি তো ছোট ছিলাম তাই তখনো লুকিয়ে লুকিয়ে কেঁদেছি, সবার সামনে কাঁদিনি, তোমাকে কিছুই বলিনি। তুমিই তো বলতে ছোটদের এত বেশি ভাবতে নেই, দুশ্চিন্তা করতে নেই।

বাবা তোমার মনে আছে? একটা করে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা নিয়ে গান লিখতে আর আমাকে শোনাতে। মুক্তিযুদ্ধের এত গল্প শুনেছি তোমার মুখে যেন আমার চোখের সামনেই হয়েছে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ। আমার মনে হতো আমিও মুক্তিযুদ্ধে ছিলাম তোমার সাথে। ভাবতাম, আমি ছোট কিন্তু খুব ছোট না। যুদ্ধের মাঠে তোমাকে রাইফেলের গুলিটা এগিয়ে দিচ্ছি, তোমার সহযোদ্ধাদের টুকিটাকি সাহায্য করছি, রাজাকারদের খবর এনে দিচ্ছি, এমন। মাঝে মাঝে রাজাকারদের, হায়েনাদের চোখে আমি সূঁচ ফুটিয়ে দিয়ে কষ্ট দিতাম। ওরা দেখতে পেত না, সেই ফাঁকে তোমরা এসে ওদের ধরে ফেলতে। ছোটরা এমন ভাবতে খুউব ভালোবাসে। আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা এর চেয়ে বেশী কী করবো বল! তোমাদের চিন্তাটাই আমরা অন্যভাবে করি, তুমি তো তা জানো।

আচ্ছা বাবা, আমি তো ছোট, কতোই বা বয়স বলো আমার! কিন্তু তুমি তোমার এই ছোট্ট ছেলেটাকে একাকী রেখে কেন এমন করছো গো বাবা! জানোনা ছোটরা বেশি চিন্তা করলে ওদের মাথা এলোমেলো হয়ে যায়, শরীর খারাপ করে। লেখাপড়া করতে পারে না, খেতে পারে না, ঘুমাতে পারেনা, এমন কত সমস্যা হয় ওদের। কত লোক আসছে বাসায়, সবাই আমাকে কী সব বলছে, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। কান দিয়ে খুউব গরম কী যেন ঢুকে মাথা ফুড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কাকুরা, আন্টিরা যা বলছেন তা ঠিক না। শুধু মনে হচ্ছে তুমি ফিরে আসবে। তুমিই তো বলতে মুক্তিযোদ্ধারা মরে না। ওরা ফিরে ফিয়ে আসে, আবার ফিরে আসবে যখন দরকার হবে আমাদের সবার।
এখন অনেক রাত। ঘুম আসছে না। ইউটিউবে তোমার পরম বিশ্বাস থেকে লেখা সেই গানটা শুনছি।

সব কটা জানালা খুলে দাও না,

……………………………………

ওরা আসবে চুপি চুপি,

যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ. . .

সব কটা জানালা খুলে দাও না . . .

হঠাৎ মনে হলো জানালায় তো নেট দেওয়া, তুমি তো ঘরে ঢুকতেই পারবে না। তাই ঘরের দরজা জানালা সব খুলে বসে আছি, তোমার জন্য। আমার পুরোই বিশ্বাস, তুমি আসবে, ফিরে আসবেই তুমি তোমার ছোট্ট ছেলেটির কাছে। তুমিই তো বলতে ছেলে-মেয়েরা বাবাদের কাছে কখনোই বড় হয় না। আমি জানি বাবা, বাবারা কখনোই মিথ্যা বলে না; মুক্তিযোদ্ধারাও তো মিথ্যা কথা বলে না, বলতে শেখেনি ওরা। তুমি আসবে আমি জানি এবং বিশ্বাস করি, তাইতো তোমার ফিরে আসার অপেক্ষায় আছি বাবা।

(আসিফ ইমতিয়াজ মুন এর পক্ষে)