নিজেকে ‘নির্দোষ দাবি’ ন্যায় বিচার চান আদালতে-ড. ইউনূস

নিজস্ব প্রতিনিধিঃ গ্রামীণ টেলিকমে শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের করা মামলার বিচার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে।

বৃহস্পতিবার শ্রম আদালতে সশরীরে উপস্থিত হয়ে নিজেকে ‘নির্দোষ’ দাবি করে আদালতের কাছে ন্যায় বিচার প্রার্থনা করেছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

ড. ইউনূসকে হেয় করতেই কলকারখানা অধিদপ্তর ‘ভিত্তিহীন’ ও ‘বানোয়াট’ মামলা দায়ের করেছে বলে মন্তব্য করেন তাঁর আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন।

আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় সব অভিযোগ অস্বীকার করে ড. ইউনূস আদালতকে জানান, নিজের লাভের জন্য তিনি কোনো কিছুই করেননি।

তাঁর দীর্ঘ লিখিত বক্তব্য শোনার পর বিচারক শেখ মেরিনা সুলতানা আগামী ১৬ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের তারিখ নির্ধারণ করেন।

আদালতে আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন জানান, ইউনূসসহ তাঁর সব মক্কেলের একই বক্তব্য। তাঁরা সবার লিখিতভাবে বক্তব্য জমা দেওয়ার পরে আইনজীবী মামুন তাঁদের বক্তব্য পোড়ে শোনান।

ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে এই মামলা দায়ের করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।

মামলায় অভিযুক্ত অন্যরা হলেন, গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুর জাহান বেগম ও শাহজাহান।

অভিযোগে বলা হয়, গ্রামীণ টেলিকমের ১০১ জন কর্মীকে স্থায়ী করার কথা থাকলেও করা হয়নি। এছাড়া শ্রমিকদেরকে প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের ৫ শতাংশ দেবার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি।

এই মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ ছয় মাস জেল ও ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে বলে বেনারকে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।

আমিও ন্যায় বিচার চাই: ড. ইউনূস

লিখিত বক্তব্যে ড. ইউনূস বলেন, গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানি আইনের ২৮ ধারায় নিবন্ধিত একটি অলাভজনক কোম্পানি। এই কোম্পানির কোনো শেয়ার হোল্ডার নেই। এই কোম্পানি থেকে কোনো পরিচালক লাভ গ্রহণ করতে পারবেন না। লাভের টাকা দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ব্যয় করা হয়।

শ্রম আইন অনুযায়ী, এই কোম্পানির লাভের শতকরা পাঁচ ভাগ দেশের কোম্পানির কর্মীদের সঙ্গে ভাগাভাগির কোনো বিষয় নেই। তাই এই বিধান গ্রামীণ টেলিকমের জন্য প্রযোজ্য নয়। সে কারণে শ্রম আইনের ২৩৪ ধারার অধীনে কোম্পানির লভ্যাংশ না দেওয়ার অভিযোগ সত্য নয়।

কর্মচারীদের স্থায়ী না করার অভিযোগ প্রসঙ্গে ড. ইউনূস লিখিত বক্তব্যে বলেন, গ্রামীণ টেলিকম কোম্পানি গ্রামের জনগোষ্ঠীর জন্য পল্লীফোন বিক্রির মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন করে এবং মোবাইল ফোন সেট বিক্রি করে ও বিক্রয়োত্তর সেবা দিয়ে থাকে।

এই কোম্পানির সাত স্তরের কর্মচারী রয়েছেন। ওপরের একটি স্তরে কোম্পানির নিজস্ব কয়েকজন কর্মচারী ছাড়া কোনো স্থায়ী কর্মচারী নেই। কারণ এই কোম্পানি তিন বছর মেয়াদী প্রকল্পের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। প্রকল্পের ধরন অনুসারে তিন বছরের জন্য কর্মীদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা হয়। তবে একই প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি হলে কর্মীদের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি হয়।

চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের চাকরি স্থায়ীকরণ না করে শ্রম আইন লঙ্ঘিত হয়নি।

ড. ইউনূস বলেন, “আমরা নির্দোষ। আমরা আদালতের কাছে ন্যায় বিচার চাই।”

আত্মপক্ষ সমর্থন শেষে আদালত প্রাঙ্গণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস সাংবাদিকদের বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার জন্য কোনো কিছু করেননি।

তিনি বলেন, “মানুষ প্রতিষ্ঠান করে মুনাফা করবে, বড়ো করবে। আমরাও লাভ করেছি, বড়ো করেছি।”

ড. ইউনূস বলেন, “আমাদের মূল লক্ষ্য যেটি আমরা বলি সামাজিক ব্যবসা, ব্যবসার মাধ্যমে মানুষের কল্যাণ। যিনি বিনিয়োগ করছেন তিনি কোনো মুনাফা নেবেন না।”

কোর্টের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী জানতে চাইলে গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি বলেন, “মানুষ আদালতের কাছে কী জন্য আসে? ন্যায় বিচারের জন্য আসে। আমিও ন্যায় বিচার চাই।”

‘ইউনূসকে হেয় করতে এই মামলা’

ড. ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন আদালতে বলেন, আইন অনুযায়ী কোনো কোম্পানি আইন ভঙ্গ করলে কোম্পানির প্রত্যেক পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সচিবসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তাকে আসামি করতে হবে।

“গ্রামীণ টেলিকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে বাদ দিয়ে কোম্পানির ১২ জন পরিচালকের মধ্যে থেকে ড. ইউনূসসহ চার জনকে ‘পিক অ্যান্ড চুজ’ ভিত্তিতে আসামি করা হয়েছে, যা আইনের লঙ্ঘন,” বলেন তিনি।

আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “জেরার সময় কলকারখানা অধিদপ্তরের পরিদর্শক তরিকুল ইসলাম স্বীকার করেছেন যে, ড. ইউনূস গ্রামীণ টেলিকম পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নন। কিন্তু তাঁকে এক নম্বর আসামি করা হলো।”

তিনি বলেন, “শ্রম আইন অনুযায়ী, এই মামলা কলকারখানা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অথবা তাঁর ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা করতে পারেন। কিন্তু মহাপরিচালকের ক্ষমতাপ্রাপ্ত না হয়ে একজন পরিদর্শক এই মামলা করেছেন, যা আইনের লঙ্ঘন।”

আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “শ্রম আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানে শ্রম আইন লঙ্ঘিত হলে সেটি ধরা পড়ার পর ৯০ দিনের মধ্যে কলকারখানা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবেন, আদেশ দেবেন। কিন্তু ২০২১ সালের ১৬ আগস্ট গ্রামীণ টেলিকম কার্যালয় পরিদর্শনকালে তাদের ভাষায় শ্রম আইন লঙ্ঘনের ঘটনা পরিলক্ষিত হলেও এর ৯০ দিনের মধ্যে মহাপরিচালক কোনো ব্যবস্থা নেননি। সে কারণেই এই অভিযোগ গ্রহণযোগ্য নয়।”

তিনি বলেন, “শ্রম আইনের আওতায় যেসব সমস্যা সমাধানের উপায় দেওয়া আছে, সেগুলোর জন্য জরিমানাসহ বিভিন্ন ব্যবস্থার কথা বলা আছে। এই মামলা হয় না। কোনোভাবেই এই বিষয়গুলোর জন্য ফৌজদারি অভিযোগ উত্থাপিত হতে পারে না।”

আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, “ড. ইউনূসকে হেয় করতে এবং তাঁর সামাজিক ব্যবসা যাঁরা পছন্দ করেন না; এমন একটি বিশেষ গোষ্ঠী এই মামলা করিয়েছে।”

তিনি বলেন, “উত্থাপিত সকল অভিযোগ মিথ্যা, ভিত্তিহীন, কাল্পনিক, বানোয়াট। আমরা আদালতের কাছে সুবিচার, ন্যায় বিচার চাই।”

অভিযোগগুলো ফৌজদারি অপরাধ: রাষ্ট্রপক্ষ

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বেনারকে বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী এসব অভিযোগ ফৌজদারি অপরাধ। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের রেফারেন্স রয়েছে।

তিনি বলেন, “আজকে উনারা আত্মপক্ষ সমর্থন করে যে কথা বলেছেন, সেগুলো উচ্চ আদালত বাতিল করে দিয়েছে। উচ্চ আদালত বলেছে, গ্রামীণ টেলিকম একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠান।।”

তিনি বলেন, “উনি শ্রম আইন লঙ্ঘন করায় উচ্চ আদালতের নির্দেশে শ্রম আদালতে তাঁর বিচার হচ্ছে।”

খুরশীদ আলম বলেন, “আগামী ১৬ নভেম্বর এই মামলার ওপর যুক্তিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে। এরপরই মামলার রায় ঘোষণার তারিখ ঠিক করবেন বিচারক।”