চুয়াডাঙ্গার ফারফিন রোড

মেসবাহ উল হক জোয়ার্দ্দারঃ আজ হতে প্রায় সোয়াশো বছর আগে চুয়াডাঙ্গা শহরে মাত্র একটি রাস্তারই নাম ছিলো – সেটা ফারফিন রোড Firfin Road। কেউকেউ বলতেন ফিরফিন রোড যেমন চুয়াডাঙ্গাকে অনেকে বলেন চুঙোড্যাঙা। তা যে নামেই তাকে প্রকাশ করি না কেন সব পথ এসে মিলে যায় শেষে, তাইনা! যাহোক ফারফিন রোড এই নামটির সাথে যাদের সুপরিচয় আছে বলাই বাহুল্য তাদের বেশিরভাগ ইতোমধ্যে গত হয়েছেন। আর বাকি যারা এখনো জীবিত আছেন তাদের সবাই বয়সে প্রবীণ।

১৯০০ দশকে চুয়াডাঙ্গা শহরের পাকা অর্থে একমাত্র সেমিপাকা রাস্তা ছিলো মাত্র একটি – সেটি ফারফিন রোড। লাল ইটের সুরকিতে ঢাকা ওই রাস্তার দুপাশে তার আগে হতেই বিভিন্ন বড়বড় গাছ ছিলো কালের পরিক্রমায় যা উচ্চতায় ও পরিধিতে বৃহৎ হতে বৃহত্তর হয়ে ওই রাস্তাটিকে একটি ছায়াঢাকা ‘শান্তির পথ’-এ পরিনত করে। ১৯৫০ দশকেও ওই রাস্তাটি সম্পূর্ণ ছায়াঢাকা দেখেছি। তবে পরবর্তীতে সেসব গাছের দু’একটি বাদে কোনটিই হয়তো করাতির করাত হতে রক্ষা পায়নি। ওই রাস্তার দুপাশে তখন কড়ই, দেবদারু ও আমগাছ সহ অন্ততঃ দশ ধরণের বিশাল বিশাল গাছ ছিলো।

আর প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে অর্থাৎ ১৯২০-১৯২২ সালের দিকে তৎকালীন চুয়াডাঙ্গা মহকুমায় সম্পূর্ণ পাকা অর্থাৎ মেটালিক রাস্তা বলতে ছিলো মাত্র একটি। ওই রাস্তাটি ছিলো দশমাইল হতে চুয়াডাঙ্গা রেলক্রসিং পেরিয়ে মাথাভাঙা ফেরিঘাট পর্যন্ত। ফেরিঘাটটি ছিলো বর্তমান মাথাভাঙ্গা সেতুস্থলে। সে’সময় এই অঞ্চলের মধ্যে ওই রাস্তায় সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয় পোর্টল্যান্ড সিমেন্ট এবং পাথরের চিপস্। ওই কংক্রিটের রাস্তাটি তখন একদিকে ঝিনাইদহ ও অপরদিকে মেহেরপুরের সাথে চুয়াডাঙ্গাকে যুক্ত করে। স্বাধীনতা পরবর্তী কালে রাস্তাটির চুয়াডাঙ্গা রেলক্রসিং হতে মাথাভাঙ্গা সেতু পর্যন্ত অংশটি শহীদ আবুল কাশেম সড়ক নাম পরিগ্রহণ করে।

এবার আসি ফারফিন রোডের কথায়। ইতোমধ্যে হয়তো অনেকেই ধারণা করতে পারছেন আমি কোন রাস্তার কথা বলছি। হ্যা, চুয়াডাঙ্গা রেলস্টেশন হতে পুরাতন কারাগার পর্যন্ত বর্তমানের শহীদ আলাউল ইসলাম সড়কটিই আগে ছিলো ফারফিন রোড। যতদূর জানা যায় চুয়াডাঙ্গা রেলস্টেশন হতে বর্তমান বড়বাজার মোড় হয়ে পশ্চিমে গুদারা ঘাট পর্যন্ত কাঁচা রাস্তাটিই ছিলো গ্রাম চুয়াডাঙ্গার প্রধান রাস্তা অর্থাৎ ব্যাকবোন। পরবর্তীতে গ্রাম চুয়াডাঙ্গা, মহকুমা সদর হিসেবে উন্নিত হলে ১৮৭০ দশকে চুয়াডাঙ্গা রেলস্টেশন হতে পুরাতন কারাগার পর্যন্ত আরেকটি কাঁচারাস্তা নির্মিত হয়। মূলতঃ এই রাস্তাটি ছিলো চুয়াডাঙ্গার প্রশাসনিক ব্লকের সাথে রেলস্টেশনের সংযোগ সড়ক। জানা যায় ১৯০১ সালে শ্রী এস. এন. ঘোষ যখন চুয়াডাঙ্গার এস.ডি.ও. ছিলেন তখন এই রাস্তাটি কাঁচা হতে সেমিপাকা রাস্তায় উন্নিত হয়। এই রাস্তার পাশে আগে হতেই বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ছিলো। তবে রাস্তাটি সেমিপাকা করার সময় এস.ডি.ও. (বর্তমানে ডি.সি.) বাংলোর সামনে হতে পুরাতন কারাগার পর্যন্ত পথের দুপাশে সারিবদ্ধ ভাবে গোটা ত্রিশেক দেবদারু গাছ লাগানো হয়। দেবদারুর ডালগুলি ডানার মতো বিস্তার লাভ করে বিধায় সেখান থেকেই ফারফিন রোডের নামকরণ হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

ফারফিন রোডের স্মৃতি আজ প্রায় মৃত তবুও চুয়াডাঙ্গাবাসীর জন্য একটা গর্বের বিষয় হলো সোয়াশো বছর আগে সেখানকার একটি রাস্তার নাম কোন ব্যক্তির নামে নয়, বরং তা ছিলো বৃক্ষের নামে। বর্তমানে প্রকৃতি সংরক্ষণ ও বৃক্ষের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার কথা যখন বিশেষভাবে উচ্চারিত হচ্ছে তখন ফারফিন রোড অতীত ঐতিহ্যের অন্যতম প্রতীক হিসেবেই আমাদের পরিচিতিকে তুলে ধরে, আমাদেরকে গর্বিত করে।

লেখক : চুয়াডাঙ্গার গুণীজন, প্রবাসী বাংলাদেশী