লতা মঙ্গেশকর : তাঁর মৃত্যুতে একটি নয়, শেষ হয়ে গেল একাধিক যুগ!

সৌমিত্র সেন

একটা সময় ছিল রেডিয়ো (তখনকার বিবিধ ভারতী) খুললেই হিন্দিগানের চোরাস্রোত ঢুকে পড়ত বাঙালি মধ্যবিত্তের তথাকথিত স্নিগ্ধ অচঞ্চল চিলেকোঠায়, বারান্দায়, দালানে। সেই স্রোতে সংশ্লিষ্ট শ্রোতার মন হয়ে উঠত উচাটন। শ্রোতার মনের কোনা ধরে টানাটানি ফেলে দিত যেসব ‘প্রাণঘাতী’ সুর তার অধিকাংশের মধ্যেই ফিরে ফিরে অনুরণিত হত ‘পিয়া তোসে’ (গাইড), ‘আপ কি নজরোঁ নে সমঝা’ (আনপড়), ‘লাগ জা গলে’, ‘নয়না বরসে রিমঝিম’ (উও কন থি), ‘তু জাঁহা জাঁহা চলে গা’ (মেরা সায়া), ‘চলতে চলতে’, ‘ইনহি লোগোঁ নে’ (পাকিজা)-র মতো বিধুর মদির সুররাশি, যাদের মীড় ও মোচড়, মেজাজ ও আবেশ যেন সোনা রোদ্দুর থেকে মেঘমগ্ন সন্ধে, মথিত ভোর থেকে নিবিড় রাতের ঔদার্যে ডুবিয়ে দিত শ্রোতার শ্রবণ ও মন!

কার গান এগুলি? বলার জন্য নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই কোথাও কোনও পুরস্কার নেই! এ গানগুলি যাঁর, সেই কোকিলকণ্ঠী, কিন্নরকণ্ঠী লতা মঙ্গেশকর কিছুক্ষণ আগেই ছেড়ে চলে গিয়েছেন এই দেশ-কাল-পৃথিবীর মায়াডোর। যে ঘটনার জেরে অপূরণীয় ক্ষতির মুখোমুখি অগণিত সঙ্গীতপ্রেমী।

সাধারণত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি-ক্রীড়ার জগতে গুরুত্বপূর্ণ কেউ প্রয়াত হলে বিষয়টিকে ১০০ বারের মধ্যে ৯৯ বারই ‘একটি যুগের অবসান’ বলে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। প্রয়াতকে বিরল বিপুল সম্মান জানানোর জন্যই এটা করা হয়। কিন্তু লতা মঙ্গেশকরের ক্ষেত্রে সম্ভবত এই অতি চেনা লব্জ বড় ম্যাড়মেড়ে দেখাবে। কেননা লতার মৃত্য়ুতে তো একটি নয়, ভারতীয় সংস্কৃতিজগতের একাধিক যুগের অবসান ঘটল। ভারতীয় লঘুসঙ্গীতের জগতে বোধ হয় ভেঙে পড়ল গোটা গানের ঘরটিই।

সুর ও সঙ্গীতের সুবিস্তৃত ভুবনে লতা মঙ্গেশকর এক আশ্চর্য বিস্ময়! তিনি ‘জীবন্ত কিংবদন্তি’ ছিলেন বললেও বোধ হয় লতার সবটা প্রতিফলিত হয় না। ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশের সব চেয়ে প্রতিযোগিতাময় মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে রয়ে গেলেন প্রতিদ্বন্দ্বীহীন এক সঙ্গীতসম্রাজ্ঞী হয়ে!

১৯২৯ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে জন্ম লতার। তাঁর বাবা ছিলেন স্বনামধন্য পণ্ডিত দীননাথ মঙ্গেশকর। মারাঠি ও কোঙ্কণী সঙ্গীতজ্ঞ এবং মঞ্চ অভিনেতা ছিলেন তিনি। লতার মায়ের নাম ছিল শেবন্তী মঙ্গেশকর।

১৯৪৯ সালে ‘জিয়া বেকারার হ্যায়’ উতলা করে দিয়েছিল শ্রোতাদের মন ৷ ১৯৫৫ সালে ‘মন দোলে মেরা তন দোলে’ দুলিয়ে দিয়েছিল সারা দেশের মনকেই। ১৯৫৭ সালের ‘আজা রে পরদেশী’ ডাক পৌঁছে গেল সঙ্গীতরসিকের মর্মস্থলে। খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার তুঙ্গে পৌঁছলেন লতা। মুম্বই (তৎকালীন বম্বে) ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি মাথায় তুলে নিল লতাকে। ক্রমে সঙ্গীত পরিচালকদের নয়নের মণি হয়ে উঠলেন তিনি।

ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষায় ও বিদেশি ভাষায় গান গাওয়ার একমাত্র রেকর্ডটি তাঁরই দখলে। তিরিশ হাজারেরও বেশি গান গাইবার বিশ্ব রেকর্ডের অধিকারী লতা। শোনা যায়, ১৯৫৯ সালেই সপ্তাহে গড়ে তিরিশটির মতো গান রেকর্ড করতে হত লতাকে! ১৯৭১ সালের মধ্যেই লতা রেকর্ড করে ফেলেছিলেন প্রায় পঁচিশ হাজার গান!

পুরস্কার? স্বীকৃতি? তা-ও বিপুল, আর যদিও তা-ও তাঁর পক্ষে কম পড়ে যায় হয়তে। মোট ২৩ বার শ্রেষ্ঠ প্লে-ব্যাক সিঙ্গার পুরস্কার। মধ্যপ্রদেশ সরকারের তানসেন পুরস্কার। ভারত সরকারের তরফে চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সম্মান ‘দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার’ ‘পদ্মভূষণ’। ২০০১ সালে ভারতের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘ভারতরত্ন’! এ তো পার্থিব, ট্যানজিবল পুরস্কার; আর বিমূর্ত পুরস্কার? তা-ও অঢেল। অগণিত মানুষের অশেষ আবেগ-ভালোবাসা-ভালোলাগার মথিত স্পর্শ।

বলা হয়, সঙ্গীতজীবনের প্রথম পর্বে লতা নূর জাহানকে অনুকরণ করতেন। দ্রুত অবশ্য লতা তাঁর নিজস্ব গায়নভঙ্গি আবিষ্কার করে নেন। শোনা যায়, একদা দিলীপকুমার মারাঠি লতার হিন্দি-উর্দু উচ্চারণ নিয়ে কিঞ্চিৎ অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। কানে আসা মাত্র লতা নাকি এক উর্দু শিক্ষক রেখে নিজের উর্দু উচ্চারণ শুদ্ধ করে নিয়েছিলেন।

এই ভাবে সঙ্গীতজীবনের প্রথমদিকের বেশ কিছু প্রত্যক্ষ পরোক্ষ বাধা টপকে লতা ক্রমশ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে ফেললেন। আর লতার মধ্যে ক্রমে অবিকল্প এক নারীকণ্ঠকে পেয়ে গেল মুম্বই ফিল্মপাড়া। লতার প্রথম দিকের অন্যতম হিট ক্ষেমচাঁদ প্রকাশের সুরে ১৯৪৯ সালের ‘মুভি মহলে’র ‘আয়েগা আনেওয়ালা’ গানটি। মধুবালার লিপ-সিঙ্কে গানটি সাড়া ফেলে দিয়েছিল সেই সময়ে। তার পর তো আর ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। তাঁর গাওয়া গান এবং সেই গানের ছবির নামের তালিকা করতে গেলে হয়তো দ্বিতীয় মহাভারত তৈরি হয়ে যাবে। সে প্রচেষ্টা ছেড়ে দিয়ে আপাতত এইটুকুই বলা থাকল যে, ১৯৬০ ও ১৯৭০ যেন তাঁর অপূর্ব অতুল অটুট সাম্রাজ্য। অবিসংবাদী সেই সাম্রাজ্যের টান ১৯৭৫ পর্যন্তও প্রায়-তুঙ্গে আর ১৯৮০-তেও তা মোটামুটি বহাল। ১৯৯০-তেও প্লে-ব্যাক করে তিনি প্রায় তাঁর নাতি-পুতি বয়সীদেরও মুগ্ধ করে রাখলেন! শেষের পর্ব বাদ দিলেও বাকি থাকা দীর্ঘ বিছানো সময়ের আস্তরণে একে একে গাঁথা হয়ে যায় ‘মুঘল-এ-আজম’, ‘গাইড’, ‘অভিমান’, ‘পাকিজা’র মতো দ্যুতি-ছড়ানো ছবি। আর শ্রোতারা নিজের কানকেও যেন বিশ্বাস করতে পারেন না ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’, ‘পিয়া তোসে’, ‘আপ কি নজরোঁ নে সমঝা’, ‘লাগ জা গলে’, ‘নয়না বরসে রিমঝিম’, ‘তু জাঁহা জাঁহা চলে গা’, ‘নদিয়া কিনারে’, ‘পিয়া বিনা পিয়া বিনা’, ‘অব তো হ্যায় তুমসে হর খুশি আপনি’, ‘চলতে চলতে’, ‘ইনহি লোগোঁ নে’-র মতো গানের ইন্দ্রধনু শুনতে শুনতে!

লতার দীর্ঘ ফিল্ম-সঙ্গীতজীবনে আলাদা করে বলার মতো বহু-বহু পর্ব থাকলেও, যেক’টি না বললেই নয়, সেগুলির মধ্যেও কয়েকটি হল– সঙ্গীতপরিচালক মদন মোহনের সঙ্গে তাঁর কাজ, মহম্মদ রফির সঙ্গে তাঁর ডুয়েট, সলিল চৌধুরীর সঙ্গে হিন্দির পাশাপাশি তাঁর বাংলাগানের কাজ। এই বাংলাগানের সূত্রেই বলতে হয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের হাত ধরে বাংলায় তাঁর প্রথম গাইতে আসার কথা। আরও আছে। হিন্দিতে মান্নাদের সঙ্গে গাওয়া তাঁর হাতে-গোনা কয়েকটি ডুয়েট যা নিয়ে লতা নিজেও বরাবর মুগ্ধ থেকেছেন; আপ্লুত থেকেছেন বাংলা ভাষায় মান্নার সঙ্গে করা তাঁর মাত্র কয়েকটি দ্বৈতসঙ্গীত নিয়েও!

লতা ১৮৫টি’র মতো বাংলা গান গেয়েছেন। এর মধ্যে ‘প্রেম একবারই এসেছিল জীবনে’, ‘না যেও না’, ‘যা রে উড়ে যা রে পাখি’, ‘ওগো আর কিছু তো নয়’, ‘একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘নিঝুম সন্ধ্যায়’, ‘চঞ্চল মন আনমনা হয়’, ‘আষাঢ় শ্রাবণ’, ‘আজ মন চেয়েছে’র মতো চিরকালীন কিছু গান। যে সব গানের মধ্যে মর্মরিত হয় বাঙালির মন।

এ হেন এক শিল্পীর মৃত্যুতে শুধু একটি কথাই বলা চলে। এরপর হয়তো হিন্দিগানের ভুবনকে দু’টি আলাদা বর্গে ভাগ করে দেখা হবে– লতা-পূর্ব এবং লতা-উত্তর সময়-পর্ব। আর এই দুই সময়-পর্বে লতাই থেকে যাবেন উৎকর্ষের শ্রেষ্ঠতম কষ্টিপাথর।