ত্রিশ পেরুনো মন- সাদিয়া মুবাররা (লেখালেখি)

            ত্রিশ পেরুনো মন
                        সাদিয়া মুবাররা

বয়ঃসন্ধি এর মত ত্রিশের পরের জীবনেরও একটা নাম থাকা উচিত।বুড়িও না, আবার ছুড়িও না, অদ্ভুত একটা বয়স। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সংসারি ছয়/সাত বছর ধরে। দুই-তিন সন্তানের মা হলেও মনের ভেতরকার কিশোরীটা কোথাও যেন রয়ে যায়। সেই মনের কিশোরীটাকে অবদমনের ক্লান্তিকর প্রচেষ্টা সবসময়। কারন, পরিবেশ পরিস্থিতির কাছে ছুড়ি হয়ে থাকাটা নিছক হাস্যকর।

যা পাওয়ার ছিল, আর যা পাওয়া হয় নাই, মনটা সেই হিসেব নিয়ে বসে না চাইতেও। কত ব্যস্ত থাকা যায়, সংসার, রান্নাবান্না, কিংবা অফিসে? দিন শেষে না পাওয়া গুলো কেমন যেন খোঁচাতে থাকে, দিন শেষে মনেহয় কেউ থাকুক, কেউ শুনুক, মনের সব কথা, কোন জাজমেন্ট ছাড়া। এদিকে সংসার, বাচ্চাকাচ্চা করতে করতে জীবনটা বন্ধুহীন হয়ে যায়, সবাই যার যার জীবনে ব্যস্ত কিংবা ত্রিশ পেরোনো তারাও ব্যস্ততার নাটকই করছে।

ত্রিশে পেরোনো মেয়েরা একটা কঠিন রোগে ভোগে। নস্টালজিয়া! কারনে অকারনে শুধু পুরনো কথা মনেহয়। ফেলে আসা শৈশব, তারুন্যের চঞ্চল মন, স্কুল, কলেজ, ভার্সিটির সোনালি দিন গুলো, তার সাথে প্রথম দেখা, কখনও না ফুরানো কত গল্প, বৃষ্টি বিলাস, যে কিছু সময়ের জন্য নিজের হয়েছিল, যে কস্ট দিয়েছিল, কিংবা না চাইতেও যাকে কষ্ট দিতে হয়েছিল, সব মনে পড়ে যায় সময়ে অসময়ে। রাতের বেলা সব কাজ সেরে আয়নার সামনে দাঁড়ালে বড় অসুন্দর মনেহয় নিজেকা। চুল পড়ে অর্ধেক, মুখে বলিরেখারা সবে আকিবুকি শুরু করেছে, এক সময়ের মেদহীন শরীরটা সপ্নের মত লাগে, পেটে স্ট্রেচ মার্কের দাগ, সব মিলিয়ে ভীষণ অনাকর্ষণীয় লাগে নিজেকে। সেই বিষণ্ণতা ঢাকতেই হয়ত শাড়ি-গয়নায় মেতে থাকতে চাওয়া মেয়েদের।

জীবনের অর্ধেকটা পাড় করে এসে ত্রিশ পেরোনো মেয়েদের দুর্নিবার প্রেমের ইচ্ছা জাগে। নাহ, প্রেম করার জন্য প্রেম না। মনেহয় কেউ থাকুক, কেউ শুনুক সব কথা, আবার কারো আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হতে মন চায়। মনটা আবার সব নতুন করে শুরু করতে চায়। মন নতুন কাউকে চায়না, পুরাতন মানুষটাকেই আবার নতুন করে চায়। আবার তার চোখের তারা হয়ে থাকার বড় সাধ হয়। সংসার, বাস্তবতা সব অস্বীকার করতে চায় মনটা মাঝে মাঝেই।

ত্রিশ পেরোনো মেয়ের বাবা-মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। সেই জীবনটা খুব মনে পড়ে। প্রতিনিয়ত। অনেকের বাবা, মা হয়তো এতদিনে আল্লাহর কাছে, যাদের আছে, কাছে-দূরে। যা করতে ইচ্ছা করে, তাঁদের জন্য চাইলেই করা যায় না। শুধু মেয়ের বাবা-মা বলে অধিকারবোধ সীমিত করে রাখতে হবে ব্যাপারটা খুব ভাবায়। নিজের সন্তানকে আঁকড়ে অন্যরকম সমাজের প্রত্যাশা করে ত্রিশ পেরোনো মন।

ত্রিশ পেরোনো মেয়ে বিয়ে করেনি? বাচ্চা হয়নি? ডিভোরসি? শোভাকাংখির অভাব নেই। অথচ এই ত্রিশ পেরোনো মেয়ের বাচ্চা হবার পর তার মনের খবর কেউ রাখে না। বিয়ের পর মেয়েটা কিভাবে এডজাস্ট করছে নতুন সংসারে কে কবে জিজ্ঞেস করে!

আজকাল নতুন শ্লোগান, মেয়েদের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্ডিপেন্ডেন্সের। ত্রিশ পেরোনো মেয়েটা বুঝে যায়, এই ইন্ডিপেন্ডেন্সের সাথেও অনেক কিছু হারাতে হয়। সময় অথবা অর্থ, যে কোন একটাই পাওয়া যায়। আর শুধু ফাইন্যান্সিয়ালি ইন্ডিপেনডেন্ট হলেই কি সমাজ ইন্ডিপেন্ডেন্স দেয়? মেয়েরা কখনই সমাজের দাসত্ব থেকে পুরোপুরি বের হতে পারে না।

ত্রিশ পেরোনো মেয়েটার মাঝে মাঝেই খুব একা থাকতে মন চায়। নিজের মত করে, নিজের জন্য। পরমুহূর্তেই সন্তানদের জন্য মন কাঁদে। মায়েরা সবচেয়ে ভয় পায় মৃত্যু। শত অভিমানেও সে বেঁচে থাকতে চায়, তার সন্তানদের জন্য। অন্তত যতদিন সন্তানদের জীবনে তার প্রয়োজন আছে ততদিন। চিৎকার করে কাঁদতে বড় সাধ হয়, সেই কান্না কেউ শুনতে পাবেনা, এমন জায়গা খোঁজার অভিযানেই মনেহয় জীবনটা পাড় হয়ে যায়।

ত্রিশের কাছে এসে মেয়েদের সবুজ মনটা আস্তে আস্তে নীল হতে শুরু করে, প্রথমে, হাল্কা, তারপর আস্তে আস্তে গাড়ো হয়। এক সময়, বেশি কথা বলা মেয়েটা চুপচাপ হয়ে যায়, মেনে নিয়ে বেঁচে থাকা শিখে যায়। পান থেক চুন খসতেই যে মেয়ের চোখের পানি, নাকের পানি এক হয়ে যেত, তার নিঃশব্দ কান্না খুব কাছের না হলে কেউ টের পায় না। ত্রিশ পেরোনো মেয়েগুলো ব্যালেন্স করতে করতে নিজেদের কথা ভুলে যায়। ভুলে যায় কি করলে ভালো লাগবে, ভুলে যায় মনটা কি চায়।

ত্রিশ পেরোনো শরিরটাও আগের মত সাপোর্ট দেয় না। দুই/তিনবার করে আট/নয় দিন না, নয় মাস পেটে রাখা সহজ নয়। অপারেশনের এর ধকল, মেরুদন্ডে দেয়া ইঞ্জেকশন শরিরটাকে অকেজো করে দেয়। ভাঙ্গা কোমর নিয়ে দিব্যি রান্নাবান্না, বাচ্চার দেখাশোনা, ঘরের-বাইরের কাজ, জার্নি সব করে যায়। সবার বাসায়ই বয়ঃজেশঠ কেউ না কেউ থাকেন, অসুস্থ। তাঁদের অসুস্থতার কাছে নিজের কষ্ট গুলো নস্যি ভেবেই মেয়েগুলা কষ্ট সহ্য করে। কিংবা কে কি ভাবল সেই চিন্তা। পুরো পরিবারের খেয়াল রাখা মেয়েটাও চায় কেউ বলুক, আজকে কেমন আছো?তুমি অনেক কষ্ট করো। তোমার মনটা কেমন আছে আজ? অথবা মলিন দেখাচ্ছে, কি হয়েছে?

ত্রিশ পেরোনো মেয়ের মন চায় কারো উপর দাবী খাটাতে অথচ ত্রিশ পেরোলেই সে বুঝতে পারে, মেয়েদের কারো উপর দাবী রাখতে নেই। ত্রিশ পেরোনো মেয়েগুলো যত্ন চায়, তারা চায় কেউ তার মনের যত্ন করুক।।।