১৯ কিলোমিটার সড়কে চাঁদা দিতে হয় ৪ জায়গায়

কালীগঞ্জ (গাজীপুর) প্রতিনিধি:গাজীপুরের কালীগঞ্জে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা জন্য নেই তেমন কোন ভালো গণপরিবহণ নেই। ঢাকার সবচেয়ে কাছের শহর হওয়া সত্ত্বেও নেই ঢাকা যাওয়ার সরাসরি কোন বাস সার্ভিস। যাত্রী ভোগান্তি চরমে পৌঁছেছে অনেক আগেই। কালীগঞ্জ-টঙ্গী-ঢাকা সড়কে সরাসরি পরিবহন না থাকায় অতিরিক্ত অর্থ গুনছেন সাধারণ যাত্রীরা। অর্থের অপচয়ের পাশাপাশি দীর্ঘ যানজটে হচ্ছে চরম ভোগান্তি। কালীগঞ্জ থেকে টঙ্গীর দূরত্ব মাত্র ১৯ কিলোমিটার। স্বল্প দৈর্ঘ্যের এ রাস্তায় শুধুমাত্র লেগুনা ও কালীগঞ্জ টান্সপোর্ট (কেটিএল) বাস সার্ভিস বর্তমানে চলছে। যাত্রীর পারাপারের তুলনায় খুব কম। তবে খরচ কমাতে অনেকে রেল পথে বেশি যাতায়াত করেন। কারণ এ সড়কে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়েরও অভিযোগ রয়েছে। তবে সেই অভিযোগের প্রেক্ষিতে ওই বাস ও লেগুনি সংশ্লিরা বলছেন ভিন্ন কথা। কালীগঞ্জ-টঙ্গী সড়কে পরিবহন মালিকদের চাঁদা গুনতে হয় অনেক। যে কারণে এই সড়কে যাত্রীদের ভাড়া গুনতে হয় বেশি।

বাসযাত্রী মো. আকবর আলী জানান, তাঁর কর্মস্থল ঢাকার উত্তরায়। তিনি প্রতিদিন বাসে যাতায়াত করেন। কালীগঞ্জ থেকে টঙ্গির দূরত্ব মাত্র ১৯ কিলোমিটার। এত অল্প রাস্তায় ৪০ টাকা ভাড়া এটা অনেক বেশি। বাংলাদেশে অন্যকোন রাস্তায় এত বেশি ভাড়া আছে তার জানা নেই। কাপাসিয়া মোড় এলাকায় শুধুমাত্র চাঁদা আদায়ের জন্য গাড়ি আটকিয়ে যানজটের সৃষ্টি করা হয় বলেও জানান তিনি।

লেগুনা যাত্রী নীলুফা ইয়াসমিন বলেন, আমি একটি বেসরকারী ব্যাংকে কর্মরত আছি। যেহেতু অফিস করি তাই প্রতিদিন যাতায়াত করতে হয়। সাধারণ দিনে ৪০ টাকা ভাড়া হলেও বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখিয়ে প্রায়শই অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে। এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে চাঁদা দেওয়াটা প্রধান কারণ। চালক বা মালিক পক্ষ আমাদের কাছ থেকেই ভাড়া নিয়ে তাদেরকে দেয়।

স্থানীয়রা জানান, এ অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষের কর্মস্থল ঢাকা-টঙ্গী এলাকায় হওয়ায় প্রতিদিন যাতায়াত করতে হয়। আর তাই রাস্তায় যাত্রীর চাপ থাকে অনেক বেশি। কিন্তু সে তুলনায় গাড়ির সংখ্যা অত্যাধিক কম। এত প্রতিকূলতার ভিতরেও কালীগঞ্জ-টঙ্গী সড়কে চলে শুধুমাত্র লেগুনা ও কেটিএল বাস সার্ভিস। এই মূহুর্তেই যদি এসব চাঁদা আদায়কারীদের দৌরাতœ থামানো না যায় তাহলে অনিরাপদ হয়ে পড়বে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা। পাশাপাশি বাড়বে যাত্রী ভোগান্তি এমনটাই মনে করছেন সাধারণ যাত্রীরা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের এক লেগুনা চালক জানান, প্রতিদিন তিনি ৪ থেকে ৫ বার টঙ্গী-কালীগঞ্জ যাওয়া আসা করতে পারেন। গাড়ীর চাপ অধিক হওয়ায় সড়কে যানজট লেগেই থাকে। তার উপর চাঁদার পরিমান ও বেড়ে গেছে। সকালে গাড়ি নিয়ে সড়কে বের হলে কালীগঞ্জ বাজার বাসস্ট্যান্ডে দিতে হয় ১৩০টাকা, পৌরসভার চাঁদা ৩০টাকা, কাপাসিয়া মোড়ে দিতে হয় ৩০ টাকা আর টঙ্গী স্ট্যান্ডে ২৫০টাকা, সব মিলিয়ে ৪৪০ টাকা। যাত্রী থাকুক বা না থাকুক সড়কে গাড়ি নিয়ে বের ওই টাকা দিতে হয়। বাধ্য হয়ে আমাদের যাত্রীদের থেকে বেশি ভাড়া নিতে হয়।

নাম প্রকাশে আনাগ্রহী একই সড়কের আরেক বাস চালক বলেন, এ রাস্তায় গাড়ি চালানো এখন প্রায় অসম্ভব। রোগারের বড় একটা অংশ এখন চাঁদা দিতে হয়। এত বেশি পরিমান চাঁদা মনে হয় আর কোন সড়কে নেই। কালীগঞ্জ বাজার বাসস্ট্যান্ডে ৩০০টাকা, পৌরসভার জন্য ৩০ টাকা, কাপাসিয়া মোড়ে ৩০ টাকা আর টঙ্গী স্ট্যান্ডে দিতে হয় ৫০০ টাকা। দৈনিক এত চাঁদা দেওয়ার পর নিজের রোজগার নিয়ে আর ঘরে ফিরতে পারি না। তাই পরিবার পরিজনকে স্বাচ্ছন্দে রাখতে পারি না। নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক বাস মালিক বলেন, এত টাকা দিয়ে একটি বাস সড়কে নামিয়ে দিনে ১০০০ টাকা আয় করা বড় কষ্ট। গাড়ির যন্ত্রাংশ সার্ভিসিং, তেল ও মবিলেই চলে যায় অনেক টাকা। তার উপর প্রায় ৮৬০ টাকা চাঁদা দেওয়াটা অনেকটাই কষ্টকর। গাড়ি নিয়ে বিপদে আছি, না পারছি ছাড়তে না পারছি রাখতে।

চাঁদার ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক লেগুনা গাড়ির মালিক জানান, তিনি তিনটি গাড়ির মালিক। আগে যেখানে একেকটি গাড়ি থেকে প্রতিদিন ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা আয় করতে পারতেন এখন তা ৫০০ থেকে ৮০০ টাকায় নেমে এসেছে। রাস্তার যানজটের পাশাপাশি কালিগঞ্জ ও টঙ্গি স্ট্যান্ড মিলিয়ে মোট ৪০০- ৪৫০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। যা বাড়তি খরচ। রাস্তায় গাড়ি চালানোটা এখন অনেক কঠিন। নেতাদের চাঁদা, গাড়ির ড্রাইভারের বেতন, গ্যারেজের মিস্ত্রির বিল, পার্টস কিনার খরচ বাদ দিয়ে দিনশেষে অনেক সময় খালি হাতে ঘরে ফিরতে হয়। খুব কষ্টে আছি।

লেগুনা মালিক সমিতির সভাপতি মুশফিকুর রহমান (টিটিল) বলেন, যারা এ ধরণের অভিযোগ করেছে তারা সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগ করেছেন। আমাদের কালীগঞ্জের বাসস্ট্যান্ডে ৪জন লাইনম্যান আছে। তাদের বেতন বাবদ ১০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর বাইরে আর কোন টাকা স্ট্যান্ডের জন্য নেওয়া হয়না। তবে পৌরসভার চাঁদা ৩০ টাকা, কাপাসিয়া মোড়ে ২০টাকা এবং টঙ্গিতে ২০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হয়। এর বাইরে আর কোথাও কোন টাকা লাগেনা। এ ব্যাপারে বাস মালিক সমিতির ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ আব্দুল হালিম অভিযোগের সত্যতা অস্বীকার করে বলেন, যে বা যারা অভিযোগ করেছে তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এত টাকা চাঁদা নেওয়া হয়না। বাসই চলে চার পাঁচটি। তাহলে কিভাবে এত টাকা নিব। কত টাকা চাঁদা নেওয়া হয় এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি এখন ব্যস্ত আছি পরে কথা হবে।

কালীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় এবং চাঁদা তোলার ব্যাপারে আমি কিছুই জানিনা। আমি এসেছি মাত্র কিছুদিন হল। সামনে আইন শৃঙ্খলা কমিটির মিটিং আছে সেই মিটিং এ বিষয়টি তুলবো।

কালীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারজানা ইয়াছমিন বলেন, আমি আসার পর এমন কোন ধরনের অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।