৫০ হাজার বছর পর ঘুম ভাঙছে জোম্বি ভাইরাসের, মহামারির আশঙ্কা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক: জলবায়ু পরিবর্তন বোঝার জন্য একজন ফরাসি ভাইরোলজিস্টের গবেষণা বিচলিত করার মত নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি একটি ‘জম্বি’ ভাইরাস আবিষ্কার করেছেন যা ৫০হাজার বছর ধরে হিমায়িত অবস্থায় ছিল। খবর ইকোনমিক টাইমসের।

৭৩ বছর বয়সী জে মিশেল ক্লেভেরি এক দশকেরও বেশি গবেষণার পরে ‘দানবীয়’ ভাইরাস আবিষ্কার করেছেন। এই ভাইরাসগুলি দীর্ঘকাল ধরে সাইবেরিয়ার ভূগর্ভস্থ পারমাফ্রস্টে রয়েছে।

তার গবেষণায় দেখা গেছে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এবং পারমাফ্রস্টের গলে সুপ্ত প্যাথোজেন, জীবাণু, ব্যাকটেরিয়া এবং ভাইরাস জনস্বাস্থ্যের জন্য নতুন ঝুঁকি সৃষ্টি করছে।

এই হুমকিকে আরও ভালো করে বোঝার জন্য মেডিসিন ও জিনমিক্সের প্রফেসর জ্য মিশেল ক্লেভরি সাইবেরিয়ান চিরহিমায়িত অঞ্চলের মাটি পরীক্ষা করেন। ‘জোম্বি ভাইরাস’-এর খোঁজ করার জন্যই তিনি এ পরীক্ষা করেন।

এই ধরনের পারমাফ্রস্ট সাধারণত আর্কটিক অঞ্চল, গ্রিনল্যান্ড, আলাস্কা, রাশিয়া, চীন এবং পূর্ব ইউরোপে দেখা যায়। এই জায়গাগুলি সাধারণত স্থলে এবং সমুদ্রের নীচে পাওয়া যায় – যেখানে তাপমাত্রা খুব কমই হিমাঙ্কের উপরে বাড়ে।

গবেষণায় মিলেছে, আর্কটিক চিরহিমায়িত অঞ্চলে মাটির বরফ হয়ে থাকা একটি আচ্ছাদন তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে গলে যাচ্ছে এবং এতে যেসব ভাইরাস বহুকাল ধরে সুপ্ত অবস্থায় ছিল সেগুলো জেগে উঠছে।

মার্সেইলে আইক্স-মার্সেলি ইউনিভার্সিটি স্কুল অফ মেডিসিনের ইমেরিটাস অধ্যাপক ক্ল্যাভারি এবং তার দল সাইবেরিয়ান পারমাফ্রস্ট থেকে এই প্রাচীন ভাইরাসগুলি সংরক্ষণ করেছেন। ক্ল্যাভারির দল এই ভাইরাসগুলির সবচেয়ে পুরানো স্ট্রেন খুঁজে পেয়েছে। ভূগর্ভস্থ একটি হিমায়িত হ্রদে তাদের পাওয়া গেছে। তাদের বয়স প্রায় ৪৮ হাজার বছর। উলি ম্যামথের পেট থেকে তারা যে নমুনাগুলি পেয়েছিল তা ২৭ হাজার বছর পুরানো।

ক্লেভরির মতে, যেসব ভাইরাস বরফ হয়ে যাওয়ার পরেও সংক্রামক থাকে সেগুলো জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হিসেবে প্রতীয়মান হতে পারে।

সংবাদ সংস্থা সিএনএনকে তিনি বলেন, আমরা অনেক ভাইরাসের চিহ্ন পেয়েছি। আমরা জানি সেগুলোর অস্তিত্ব রয়েছে। তবে আমরা এখনো নিশ্চিত নই -এই ভাইরাসগুলো বেঁচে আছে কি না। তবে আমাদের যুক্তি হচ্ছে যদি আমরা অ্যামিবা ভাইরাসগুলোর জীবিত থাকা সমন্ধে নিশ্চিত হই- তবে অন্যান্য ভাইরাসগুলোর না বেঁচে থাকার কোনো কারণ নেই। এগুলো যেখানে আশ্রয় নেয় সেখানে সংক্রমণ ঘটাতেও সক্ষম।

বছরের পর বছর ধরে মানুষের ইম্যুইনিটি নেই এমন সব সংক্রামক রোগ নিয়ে কাজ করছে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের সরকার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘ডিজিজ এক্স’ নামে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্যাথোজেনের একটি তাল্কা করেছে।

মূলত গবেষণা ও মহামারির আশঙ্কাকে যাচাই করার জন্য এ তালিকা করা হয়েছে। সাম্প্রতিক কোভিড-১৯ মহামারির পর এসব চেষ্টা আরও সুবিন্যস্ত করা হয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মুখপাত্র ড. মার্গারেট হ্যারিস বলেন, ‘ডব্লিউএইচও তিনশরও বেশি বিজ্ঞানীকে নিয়ে কাজ করছে। চিরহিমায়িত বরফ গলার মাধ্যমে যেসব ব্যাকটেরিয়া মহামারি সৃষ্টি করতে পারে, তাদের নিয়ে গবেষণা করছে এ বিজ্ঞানীরা।’

তিনি বলেন, ক্লেভরির রিসার্চ বেশ আনকোরা। ফ্রান্সে তার ল্যাবরেটরিতে মাটির বিভিন্ন নমুনা রয়েছে। এ ছাড়া সেখানে বায়োসেফটি সুবিধাও রয়েছে। পার্টিক্যাল ফিজিক্স, কম্পিউটার সাইন্স এবং বায়োকেমিস্ট্রির অভিজ্ঞান ক্লেভরিকে একজন ভাইরোলজিস্ট হিসেবে নতুন সব ধারণা প্রদানে সহায়তা করেছে।

জানা যায়, চিরহিমায়িত অঞ্চলের নিয়ে ক্লেভরি অবাক হন যখন তিনি দেখতে পারেন, ক্লেভরি দেখেছেন ৩০ হাজার বছর পুরোনো একটি ফল থেকে একটি চারাগাছ জন্মেছে। এরপরই তিনি এ নিয়ে আরও বিস্তর গবেষণা শুরু করেন।

২০১৪ সালে তিনি সফলভাবে সাইবেরিয়ান হিমায়িত অঞ্চল থেকে ‘জীবিত’ ভাইরাস উদ্ধার করতে সক্ষম হন। ২০১৯ সালে তিনি এবং তার দল আরও ১৩টি ভাইরাস আলাদা করেন। মানুষ, প্রাণি অথবা গাছপালার ভেতর প্রাচীন এসব প্যাথোজেনের দ্বারা সংক্রমিত ভাইরাস ভয়াবহ পরিণতি বয়ে নিয়ে আসতে পারে বলেও জানান তিনি।

রাশিয়ার দুই-তৃতীয়াংশ অঞ্চলই বরফে আচ্ছাদিত। এটিই জৈব বস্তুর টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো পরিবেশ। সাইবেরিয়ায় চিরহিমায়িত অঞ্চলের গভীরতা ১ কিলোমিটারেরও বেশি। এসব জায়গায় হাজারো মাইক্রোব প্রজাতির ভাইরাস রয়েছে। যদিও আর্কটিকে উষ্ণতা বাড়ার জন্য প্রশস্ত মিথেনের ক্রেটার দৃষ্টিলব্ধ হচ্ছে এবং বরফে আচ্ছাদিত এসব অঞ্চলে গড়ে ওঠা শহরগুলোও অধোগামী হচ্ছে।

ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পশ্চিমা ও রুশ বিজ্ঞানীদের মধ্যেকার শীতল সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে যা গবেষণার পথে অন্তরায়। মাটির আরও গভীরে খনির কাজের জন্য রাশিয়া প্রায়ই খননকাজ চালাচ্ছে। এসবের ফলে প্রাচীন প্যাথোজেন বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে রাশিয়া প্রাকৃতিক সম্পদ আরোহণের তাগিদেই এ জাতীয় খননকাজ চালাচ্ছে। তবে এতে অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও ভয়াবহ মাইক্রোব সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে চলেছে।

এসব ভীতি সঞ্চারকারী প্রশ্নকে সামনে রেখে ক্লেভরি আবারও সাইবেরিয়ায় ফিরে গেছেন। তিনি বিষয়টি নিয়ে আরও গবেষণা চালিয়ে যেতে চান। সূত্র: ইকোনমিক টাইমস ও ইউএসএটুডে।