২০ এপ্রিল ১৯৭১ : আজ তোফায়েল আহমদসহ আওয়ামীলীগ নেতাদের সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন টিক্কা খান

প্রফেসর ডা. মাহবুব হোসেন মেহেদী
মুক্তিযুদ্ধে ২০ এপ্রিল ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। এদিন ভারতের দিল্লিতে দুই বাঙালি কূটনীতিক প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নতুন দূতাবাস থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল ৩০ পাকিস্তানি ও অবাঙালি নাগরিককে। এদিন খাগড়াছড়ির মহালছড়ি উপজেলায় এক যুদ্ধে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফ। ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও পাকিস্তানের অখণ্ডতার দাবিতে শান্তিকমিটির উদ্যোগে মিছিলও হয়েছিল।
ঢাকায় ২০ এপ্রিল ১৯৭১
এদিকে এদিন পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আব্দুল মান্নান, তোফায়েল আহমদ ও দ্য পিপল-এর সম্পাদক আবিদুর রহমানকে ২৬ এপ্রিল সকাল ৮টায় ঢাকার এক নম্বর সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়।
ঢাকায় ২০ এপ্রিল নেজামে ইসলাম পার্টির মাওলানা আজিজুল হক, সৈয়দ মোস্তফা আল মাদানি, অ্যাডভোকেট সৈয়দ আনিসুর রহমান, হাজী আঁকিল সাহাব এক বিবৃতিতে বলেন, ভারতের সহযোগিতা বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ভারতের চর দেশদ্রোহীরা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলা চালাচ্ছে।
ঢাকায় খাজা খয়েরউদ্দিনের সভাপতিত্বে এদিন শান্তি কমিটির কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে দেশের প্রতিটি এলাকায় শান্তি কমিটি গঠনের জন্য গোলাম আযম, আবুল কাশেম, এ জে খদ্দর, মাহমুদ আলীকে দায়িত্ব দেয়া হয়।
ঢাকায় এদিন শান্তিকমিটি ও নেজামে ইসলাম পার্টির উদ্যোগে এক বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। মিছিলের নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা আজিজুল হক, সৈয়দ মোস্তফা আল মাদানি, গোলাম আযম। এই মিছিলে তারা বলেছিলেন, ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি অঞ্চল নিয়ে বিদেশি গণমাধ্যম এবং ভারতীয় সরকার অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, দেশের প্রতিটি স্থান এখন শান্ত ও নিরাপদ। দেশপ্রেমিক পাকিস্তানি বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে দেশ আছে। মিছিলের প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল “পাকিস্তান বাঁচাও ভারত হঠাও”, “ভারতের দালাল হুঁশিয়ার”, “মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই পূর্ব ও পশ্চিম এক পাকিস্তান”।


বিদেশে রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিদের বিবৃতি ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ
২০ এপ্রিল ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে পাকিস্তান হাইকমিশনের দুজন বাঙালি কূটনীতিক শিহাবউদ্দিন ও আমজাদুল ইসলাম পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে পদত্যাগ করে ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় নেন। তারা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।
এদিন কলকাতাস্থ সাবেক পাকিস্তান হাইকমিশন থেকে ৩০ জন পাকিস্তানি কূটনীতিক ও কর্মচারীকে বহিষ্কার করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ নামের একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচানো সম্ভব’ শিরোনামে এই দিন একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাটমিক এনার্জি–সংক্রান্ত যুক্ত কমিটির সদস্য সিনেটর জন ও পেস্টর বাঙালিদের ওপর অমানবিক আচরণের বিরোধিতা করে একটি চিঠি লেখেন।
২০ এপ্রিল ফ্রান্সের প্যারিস থেকে প্রকাশিত ফরাসি দৈনিক লা মঁদ তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ভারতীয় সীমান্ত থেকে এক মাইল ভেতরে বাংলাদেশের মধ্যে একটি আমবাগানে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের শপথ অনুষ্ঠান হয়েছে। যদিও সরকার গঠিত হয়েছিল ভারতের কলকাতায়, কিন্তু বাংলাদেশে শপথ করার কারণ যেন বিদেশী গণমাধ্যম এবং জাতিসংঘে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার দাবি সুদৃঢ় করা যায়।
ঢাকার বাইরে মুক্তিযুদ্ধ
ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ দেশের কোন এক মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলেন, “শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন।” বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ সাংবিধানিক সরকারের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য বিশ্বের গণতন্ত্রকামী ও মুক্তিকামী রাষ্ট্র ও মানুষের প্রতি তিনি আহবান জানান।
দিনাজপুরের হিলিতে মুক্তিবাহিনীর উপর ব্যাপক হামলা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তখন লেফটেন্যান্ট আনোয়ার, নায়েক সুবেদার শহীদুল্লাহ, নায়েক সুবেদার করম আলীর নেতৃত্বে কোম্পানিগুলো ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যায় হানাদারদের সঙ্গে। এসময় পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীর মর্টার ও শেলিংয়ের হামলায় ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং কয়েকজন ভারতীয় নাগরিক শহীদ হন। হিলির অবস্থান টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না বুঝে এদিন গভীর রাতে মুক্তিবাহিনীর ২৫০ মুক্তিযোদ্ধা হিলি থেকে ১৩ মাইল দূরে ভারতের কামালপাড়ায় কুরমাইল বেসিক ট্রেনিং ইন্সটিটিউশনে আশ্রয় নেয়।
২০ এপ্রিল মুক্তিবাহিনী সিলেটের শেওলা ফেরীঘাটে পাকিস্তানি হানাদারদের একটি দলের উপর হামলা চালায়। এসময় হানাদারদের ৮ জন সেনা নিহত হয়। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা ফেরিঘাট ধ্বংস করে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।
এইদিন পাকিস্তানি হানাদারদের দুই ব্যাটেলিয়ন ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। ভোর সাড়ে চার টায় শুরু হওয়া এই যুদ্ধ শেষ হয় সন্ধ্যা সাত টায়। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড ক্ষতি হয় এই যুদ্ধে। তারপর রাতেই মুক্তিযোদ্ধারা মিরসরাই ত্যাগ করে মাস্তান নগরে অবস্থান নেয়। এদিকে টের পেয়ে হানাদারেরা ট্যাংক নিয়ে মাস্তান নগর আক্রমণ করে। এরপর ভোরে মুক্তিবাহিনীর মিরসরাইয়ের হিঙ্গুলিতে নতুন করে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে তুলে।
খাগড়াছড়ির মহালছড়ি ও রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর উপজেলার সীমান্তে কাপ্তাই লেক গুরুত্বপূর্ণ জলপথ ছিল। কাপ্তাই- রাঙ্গামাটি- মহালছড়ি, খাগড়াছড়ি, জালিয়াপাড়া হয়ে রামগড়ের যাওয়ার এটিই ছিলো একমাত্র পথ। এই জলপথ নিয়ন্ত্রণের জন্য মেজর মীর শওকত আলীর নির্দেশে ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআরের মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত একটি দল প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদারেরা এই জলপথ নিজেদের দখলে নেয়ার জন্য তৎপর হয়ে ওঠে।
২০ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য মর্টার, মেশিনগান ও রাইফেল নিয়ে বুড়িঘাটের মুক্তিবাহিনীর নতুন প্রতিরক্ষা ঘাঁটিকে বিধ্বস্ত করতে সাতটি স্পিডবোট এবং দুইটি লঞ্চ নিয়ে এগিয়ে আসতে থাকে। এটি ছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের (এসএসজি) কোম্পানি। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির কাছাকাছি পৌঁছেই পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ শুরু করে। স্পিডবোট থেকে মেশিনগানের গুলি এবং লঞ্চ দুইটি থেকে তিন ইঞ্চি মর্টারের শেল নিক্ষেপ করছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে। তখন অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারাও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পরিখায় অবস্থান নিয়ে নেন। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গোলাগুলির তীব্রতায় প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙে যায় এবং তারা মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করে ফেলে। যুদ্ধের এই পর্যায়ে ৮ নম্বর ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সিপাহী মুন্সী আব্দুর রউফ বুঝতে পারেন, এভাবে চলতে থাকলে ঘাঁটির সকলকেই হানাদার বাহিনীর হাতে মৃত্যু অথবা ধরা পড়তে হবে। সহযোদ্ধাদের পিছু হটার সুযোগ করে দিতে নিজে পরিখায় দাঁড়িয়ে অনবরত গুলি করতে থাকেন পাকিস্তানি স্পিডবোটগুলোকে লক্ষ্য করে। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে একা কৌশলে লড়ছিলেন তিনি। তিনি তাদের সাতটি স্পিডবোট একে একে ডুবিয়ে দিলে তারা তাদের দুটি লঞ্চ নিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। লঞ্চ দুটো পিছু হটে রউফের মেশিনগানের গুলির আওতার বাইরে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়। পাকিস্তানি বাহিনী এরপর লঞ্চ থেকে মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। মর্টারের গোলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা রউফের একার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তবু তিনি চেষ্টা চালিয়ে যান। হঠাৎ একটি মর্টারের গোলা তার বাঙ্কারে এসে পড়ে এবং তিনি শহীদ হন। কিন্তু তার মৃত্যুর আগে সহযোগী যোদ্ধারা সবাই নিরাপদ দূরত্বে পৌঁছে যেতে পেরেছিল। আব্দুর রউফের আত্মত্যাগে তার কোম্পানির প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধার জীবন রক্ষা পেয়েছিল।

সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার ঘাটিনা রেলওয়ে ব্রীজের উপর পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক যুদ্ধ হয়েছিলো এদিন। এই যুদ্ধে ২০ জনের বেশি পাকিস্তানি নিহত হয়েছিল।

তথ্যসূত্র – বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র একাদশ খণ্ড ও দ্বাদশ খণ্ড, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর ২, ৭, ৮, দৈনিক পাকিস্তান ২১ এপ্রিল ১৯৭১, অমৃত বাজার পত্রিকা ২১ এপ্রিল ১৯৭১

লেখক ও সংগ্রাহক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, অর্থপেডিক স্পাইন এন্ড ট্রমা সার্জারী বিভাগের অধ্যাপক এবং সাবেক অধ্যক্ষ, চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক এই আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি।