হবিগঞ্জে ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের সেকাল একাল

লিটন পাঠান, হবিগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি: রোদে শুকানোর পর মাঠির তৈরী সারি সারি বিভিন্ন ধরণের মটকা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এক সময় চারদিকে হবিগঞ্জের লাখাইয়ের মৃৎশিল্প একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প হিসাবে বেশ খ্যাতি ছিল। এ পেশার সাথে জড়িতদের জীবনযাপন ছিল স্বচ্ছল। কিন্তু কালের বিবর্তনে দিনবদলের পালায় তাদের সে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য আজ শুধুই অতীত। এককালে মাটির তৈরী তৈজসপত্র ছিল গ্রামবাংলার সকল শ্রেনীর মানুষের নিত্য ব্যবহার্য উপকরন ও অনুষঙ্গ।

তখনকার সময়ে মাটির হাঁড়ি পাতিল, বোল, বাটি, গামলা, মটকা, নাইন্দা, কলস, মাটির সানুক সহ বেশীরভাগ নিত্যব্যবহার্য দ্রব্যাদি ছিল মাটির তৈরী। এসকল পরিবেশবান্ধব মাটির তৈরী দ্রব্যাদি প্লাস্টিকপন্য ও এলোমিনিয়ামের ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে। এসব প্লাস্টিক ও এলোমিনিয়াম পন্য টেকসই ও সহজলভ্য হওয়ায় দিন দিন এর জনপ্রিয়তা বাড়ছে, এদিকে চাহিদা হ্রাস পাচ্ছে মাটির তৈরী পণ্য সামগ্রীর সনাতন পদ্ধতিতে কারিগররা মাঠির দিয়ে তৈরী করছেন বিভিন্ন সামগ্রী।

আর মাটির তৈরী পণ্য কমতে থাকায় এ পেশার সাথে বংশানুক্রমে জড়িত জনগোষ্ঠী পড়ছে সংকটে।চাহিদা না থাকায় মাটির তৈরী পন্য উৎপাদনকারী কুমার সম্প্রদায় তাদের পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় ঝুকেছে
এতে দিন দিন কুমার সম্প্রদায়ের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। উপজেলার মোড়াকরি ও পূর্ববুল্লা সহ বিভিন্ন গ্রামে এককালে কুমার সম্প্রদায়ের বসবাস থাকলেও বর্তমানে এদের সংখ্যা খুবই কম।

মোড়াকরি গ্রামে পূর্বে ৪০ পরিবার কুমার শ্রেনী মাটির কাজের জড়িত থাকলেও বর্তমানে ১০ টি পরিবার এ পেশাকে আকড়ে ধরে রেখেছে
বাকিরা পেশা বদল করে অন্য পেশায় যুক্ত পূর্ববুল্লা গ্রামে বর্তমানে ৩/৪ টি পরিবার এ কুমার পেশা কোনরকমে ধরে রেখেছে।
স্থানীয় কুরাম সম্প্রদায়ের লোকজনের সাথে আলাপকালে জানা যায়, বর্তমানে মাটির তৈরী জিনিসের তেমন চাহিদা নেই। বিভিন্ন পূঁজা – পার্বন, উৎসব ও সীমিত পরিমানে গ্রামের মহিলারা হাঁড়িপাতিল, গামলা ও সরাসহ কিছু পন্য ব্যবহার করে থাকে।

এছাড়া চাপাশুটকীর মটকার চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে পুরুষ কারিগররা মটকাই বেশী তৈরী করে। আর এর চাহিদা মোটামোটি এখনো রয়েছে। মহিলারা তৈরী করে তাকে হাঁড়িপাতিল ও সরাসহ অন্যান্য পন্য। সরেজমিন মোড়াকরি কুমার পল্লীতে পরিদর্শনকালে শ্যামল রুদ্রপাল, সুধন চন্দ্র রুদ্রপাল, ববিতা রানী রুদ্রপাল, দিপালী রানী রুদ্রপাল, সীমা রানী রুদ্রপাল ও মিনা রানী রুদ্রপাল জানান, আমরা আমাদের পূর্ব পুরুষের পেশা এখনো কোনোরকমে আকড়ে ধরে রয়েছি। জানিনা কতদিন টিকে থাকতে পারব।

একসময় আমাদের সুদিন ছিল। সংসারে কোন অভাব অনটন বলতে কিছুই ছিলনা। মাটির তৈরী পন্যের ছিল বেশ চাহিদা।আমাদের বাবা দাদারা বর্ষাকালে নৌকাযোগ গ্রামে গ্রামে পণ্য বিক্রয় করে নৌকা বোঝাই করে ধান/ চাল নিয়ে আসতো।আমাদের কোন অভাব ছিলনা
মাটির পন্যের বিনিময়ে প্রচুর ধান/চাল পাওয়া যেত বিধায় তারা জমিজমা চাষাবাদের ধার- কাছেও যেত না বা প্রয়োজন ছিলনা তাই ভিটেমাটি ছাড়া কোন জমিজমাও নেই। বর্তমানে ব্যবসায়ও ধস নেমেছে।

মাঠি দিয়ে তৈরী বিভিন্ন ফুলদানি সাজিয়ে রেখেছেন নিপুণ হাতের কারিগর এমতাবস্থায় আমরা খুবই সংকটময় অবস্থায় রয়েছি। বর্তমানে মাটি হাওর থেকে কিনে আনতে হচ্ছে এক সময় মাটি সংগ্রহে কোন টাকাকড়ি লাগতো না এতে মাটির তৈরী জিনিসে খরচও বেড়ে গেছে। তাই এ পেশায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে অর্থনৈতিক ধৈন্যদশা লাঘবে স্থানীয় প্রশাসনের তরফে নেই কোন উদ্যোগ ঐতিহ্যবাহী এ শিল্পকে রক্ষায় আমরা সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্তৃপক্ষের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

পাশাপাশি তারা আরো জানান, আমাদের এ সম্প্রদায়ভুক্ত ২/৩ জন ইতিমধ্যে ভাতার আওতায় এসেছে তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এ ব্যপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার লুসিকান্ত হাজং এর সাথে আলাপকালে জানান ঐতিহ্যবাহী এ মৃৎশিল্প রক্ষা এবং এর আধুনিকায়ন বিষয়ে উদ্যোগ নিতে চেষ্টা চলছে এছাড়া তাদেরকে প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সহযোগীতা করার বিষয়ে চেষ্টা করছি।