স্বদেশী আন্দোলনের প্রভাবে যশোর-খুলনায় শিল্পোদ্যোগ

এই আমার দেশ ডেস্ক : উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের পরেই ভারতবর্ষে জাতীয়তাবোধের সুচনা হয়। শিল্প গড়ে তোলা, আমদানি রফতানি বাণিজ্যে অংশ গ্রহন করা ইত্যাদির দিকে উদীয়মান ভারতীয় ধনিক শ্রেণির নজর পড়ে। বাংলার ভোলানাথচন্দ্রসহ বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীরা স্বদেশী শিল্প গড়ে তোলার উপর জোর দিতে থাকেন। বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে নবযুগের ভাবধারা প্রবাহিত হতে থাকায় স্বদেশিকতা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। বিত্তশালীদের একটি অংশ শিল্প প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ফলে বাংলায় ব্যাংক, কাপড়ের কল প্রভৃতি স্থাপিত হয়।

যশোরের চুড়ামনকাঠির একাধিক জায়গায় খেজুর-চিনি শিল্প নতুন করে গড়ে তোলার চেস্টা চলে। স্বদেশী পণ্যাদি বিক্রয়ের জন্য যশোরে একটি স্বদেশী ভান্ডারও প্রতিষ্ঠিত হয়।
স্বদেশী আন্দোলন শুরু হলে ১৯০৬ সালে যশোরের মন্মথনাথ ঘোষ, রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ জাপানে চলে যান। মন্মথনাথ জাপান থেকে ফিরে এসে যশোর শহরে চিরুণীর কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এদেশে সেলুলয়েড থেকে চিরুণী তৈরির পদ্ধতি তিনিই প্রথম প্রবর্তন করেন। এই স্বদেশী ভাবাপন্ন ব্যক্তিটি কিন্তু পুলিশের কুনজরে ছিলেন, তবে বাংলার লাট লর্ড কারমাইকেল তাঁর কারখানা পরিদর্শনের পর তিনি সেই কুদৃষ্টি থেকে অব্যাহতি পান। প্রসঙ্গত: গত শতকের প্রথম দিকে স্থাপিত যশোর ষ্টিম নেভিগেশন কোং’র নাম করা যায়। কোম্পানিটি বিলাতি বড় ষ্টিমার সংস্থা আর, এস, এন কোম্পানির প্রবল প্রতিযোগিতার সম্মুখিন হয়েছিল। এর সদর দফতর ছিল যশোর জেলার বুনগাঁতি গ্রামে।( এখন মাগুরা জেলার শালিখা উপজেলা)। যদুনাথ সরকার ছিলেন এই কোম্পানির ওয়ার্কিং ডিরেক্টর। খুব সম্ভব কোম্পানি গঠনের এক বছরের মধ্যে, এই সংস্থা ‘শক্তি’, ‘যশোরেশ্বরী’ ও ‘দুর্গা’ নামে তিনখানি ষ্টিমার ভৈরব, চিত্রা ও নবগঙ্গা নদীপথে চালু করে। কিছু দিনের মধ্যেই বিলাতি আর, এস, এন, কোম্পানি সর্বশক্তি নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামে। অপর দিকে স্থানীয় যুবকরা প্রতি ষ্টেশনে বিলাতি কোম্পানির বিরুদ্ধে পিকেটিং চালান। এই ব্যবসাগত প্রতিদ্বন্ধিতা স্বদেশি আন্দোলনের রুপ নেয়। এই ভাবে ৩ বছর চলে।
এরপর বিলেতি কোম্পানি যাত্রীদের বিনা ভাড়ায় এমনকি সিগারেট, রুমাল প্রভৃতি উপহার দিয়েও প্রলুব্ধ করতে ব্যর্থ হয়। অবশেষে স্বদেশি কোম্পানির সারেং ও খালাসীদের বেশি মাহিনার প্রলোভন দিয়ে সরিয়ে নেওয়ার ফলে স্বদেশি কোম্পানিটি অচল হয়ে যায়।
সেই যুগে সাতক্ষীরার ধানদিয়া গ্রামের ফণীভুষণ বন্দোপাধ্যায়ের পরিচালনায় গঠিত আর একটি স্বদেশি ষ্টিমার কোম্পানির কথাও মনে পড়ে। দীর্ঘদিন ‘কপোতাক্ষ’ ও ‘ফরচুর’ নামে দুটি ছোট ষ্টিমার যশোরের ঝিকরগাছা থেকে খুলনার কপিলমুনি পর্যন্ত নিয়মিত ভাবে চলাচল করত।

এর বহুদিন পর গত শতাব্দির বিশের দশকের শেষদিকে প্রধানত: যশোর খুলনার মধ্যবিত্ত মানুষের দানে এবং নগেন্দ্রনাথ সেন, জ্যোতিষ চন্দ্র ঘোষ, কালিদাস ঘোষ ও রায়বাহাদুর যতীন্দ্রনাথ ঘোষ, হেমনাথ বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ নেতৃবৃন্দের পরিচালনায় খুলনার দেড়শ’ থেকে দুশ’ তাঁত বিশিষ্ট ‘আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র কটন মিলস’ এবং বাগেরহাটেও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের সমর্থনে ও পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় জনসাধারণ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের উদ্যোগে অপর একটি ছোট কাপড় কল স্থাপিত হয়। এখানে উল্লেখযোগ্য যে এই কাপড়ের কলের প্রথম উদ্যোক্তা ছিলেন বাগেরহাটের প্রখ্যাত জাতীয়তাবাদী নেতা উকিল উদ্দিন খোন্দকার।-তথ্যসুত্র: ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যশোর খুলনা/ স্বাধীনতা সংগ্রামে খুলনা/ মুক্তির পথের যাত্রী যাঁরা।