সংকট বাড়ছেই পদ্মা ব্যাংক ঘিরে

অনিয়ম-দুর্নীতির ভারে প্রায় ডুবে গিয়েছিল ফারমার্স ব্যাংক। ডুবন্ত ব্যাংকটিকে জীবন দিতে এগিয়ে এসেছিল অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। তিন বছর আগে ব্যাংকটিকে বাঁচাতে রাষ্ট্রায়ত্ত চার ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইসিবি থেকে ৭১৫ কোটি টাকার পুঁজি ঢালা হয়েছিল। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নাম পরিবর্তন করে ফারমার্স থেকে পদ্মা হয়েছে ব্যাংকটি। আইন ও রীতিনীতি পরিপালনে ব্যাপক ছাড়ও পেয়েছে ব্যাংকটি। তার পরও পদ্মা ব্যাংক নিয়ে সরকারের বিব্রতকর পরিস্থিতির শেষই হচ্ছে না। উল্টো সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সংকট বাড়ছে পদ্মা ব্যাংক ঘিরে।

সরকারি ব্যাংক ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার আমানত পদ্মা ব্যাংকে আটকে আছে পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে। দফায় দফায় তাগিদ দেয়ার পরও এ আমানত ফেরত দিতে পারেনি পদ্মা ব্যাংক। এ আমানতের সুদও সময়মতো পায়নি প্রতিষ্ঠানগুলো। উল্টো সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতকেও মূলধনে রূপান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে ব্যাংকটি।

ধারাবাহিকভাবে গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭ সালে ফারমার্স ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুনর্গঠন করা হয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। অপসারণ করা হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। তারপর প্রায় চার বছর পেরিয়ে গেলেও ব্যাংকটির দৃশ্যমান কোনো উন্নতি হয়নি। নজিরবিহীন নীতিছাড় পেয়েও ঘুরে দাঁড়াতে ব্যর্থ পদ্মা ব্যাংক এবার রাষ্ট্রায়ত্ত কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। অভিনব প্রস্তাবটি নিয়ে তোলপাড় চলছে দেশের আর্থিক খাতে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে পদ্মা ব্যাংকের ৬৮ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা নিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। বিনিময়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে জোগান দিতে হয়েছে ৭১৫ কোটি টাকার পুঁজি। ২০১৮ সালে দেয়া এসব পুঁজির বিপরীতে এখন পর্যন্ত এক টাকাও মুনাফা পায়নি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। উল্টো ধারাবাহিক লোকসানের কারণে পদ্মা ব্যাংকে মূলধন হিসেবে জোগান দেয়া অর্থও প্রায় শেষ। সর্বশেষ গত জুন শেষে প্রায় ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে পড়েছে ব্যাংকটি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী সিআরআর ও এসএলআর সংরক্ষণেও ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থ হচ্ছিল পদ্মা ব্যাংক। সম্প্রতি ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর থেকে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসএলআর সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা থেকে ব্যাংকটিকে মুক্তি দেয়া হয়। ফলে ৮৯ কোটি টাকার জরিমানা মওকুফও পেয়েছে ব্যাংকটি।

ফারমার্স ব্যাংকের জন্ম হয়েছিল ৩৯ জন ব্যক্তি উদ্যোক্তা ও ১০ জনের প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগে। পুনর্গঠনের পর অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে কেবল ব্যাংকটির অডিট কমিটির সাবেক চেয়ারম্যান মাহাবুবুল হক চিশতী ও তার ছেলে কারাভোগ করেছেন। দুদকের মামলায় আসামি হয়েছেন ব্যাংকটির কয়েকজন কর্মকর্তা। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ফারমার্স ব্যাংক কেলেঙ্কারির বেশির ভাগ কুশীলবই এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গিয়েছেন। অন্যদিকে নানা ছাড় ও সহায়তা দিয়েও সংকট কাটানো যাচ্ছে না পদ্মা ব্যাংকের।

অন্যের অপকর্মের দায় রাষ্ট্র কেন নিজের ঘাড়ে তুলে নিচ্ছে, সেটি বোধগম্য নয় বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ফারমার্স ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে। ব্যাংকটিতে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে উদ্যোক্তা ও কর্মকর্তারা জড়িত। ব্যাংকটির বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে যথাযথ নিরীক্ষা করতে হবে। এক্ষেত্রে হিসাব নিরীক্ষার পাশাপাশি ব্যবস্থাপনা নিরীক্ষাও করা দরকার। অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনলে সেটি দৃষ্টান্ত হতো। কিন্তু আমরা তেমনটি দেখিনি। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো ফারমার্স ব্যাংকের মালিকানা নিয়েছে। এখন ব্যাংকটির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সঙ্গে মার্জারের আবদার করা হচ্ছে। এর আগে দেয়া ছাড়ের কারণেই পদ্মা ব্যাংক এমন আবদার করার সাহস পেয়েছে।