সংকটেই তৈরি রাজনীতির ঐক্য

বিশেষ প্রতিনিধি : বাংলাদেশের রাজনীতির রয়েছে অনেক সমলোচনা। বলা হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে রয়েছে বিভক্তির বলিরেখা। যে বিভক্তির বলিরেখা কখনো উৎপাটিত হয় না। প্রধান দুই প্রতিপক্ষের মধ্যে রাজনীতির বিরোধ এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে তাদের মধ্যে মুখ দেখাদেখিও বন্ধ। এমনকি তাদের মধ্যে আত্মীয়তার সম্পর্ক হয় না, এক অনুষ্ঠানে যদি বিএনপির নেতারা যান, সেখানে আওয়ামী লীগের নেতারা যান না। আবার বিএনপির নেতাদের আচরনেও এমনটা ঘটে। রাজনীতিতে এই বিভক্তি ও পরস্পরের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুড়ির কারণেই বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে অগণতান্ত্রিক শক্তি স্থান করে নিয়েছে। এই বিভক্তির কারণেই এক শ্রেনীর মানুষ রাজনীতিকে নানাভাবে কলুষিত করার চেষ্টা করছে। বলা হয় এই বিভক্তির কারণেই বিভিন্ন সময় রাজনীতি মানুষের কোন কল্যাণ করতে পারে না, রাজনীতির কাছে শিক্ষণীয় কিছু নেই এমন কথা ওঠে। এই বিভক্তির কারণেই তরুন প্রজন্মের একটি বড় অংশ রাজনীতি বিমুখ।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের সঙ্গে আলাপরত বিএনপি মহাসবিচ ফখরুল ইসলাম। পাশে স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান।

কিন্তু রাজনীতিতে যে শুধু বিভেদ তা নয়। নানা সংকটে, দুর্যোগে রাজনীতিবিদরা যে দলমতের পার্থক্য ভুলে একাত্ম হতে পারেন, তার উদাহরণ রয়েছে। তাদের মধ্যে যে আবেগ, ভালোবাসা সহানুভূতি রয়েছে, সেটার প্রমান মিললো আরেকবার। রবিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের অসুস্থ হয়ে পরেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ছিলেন মুখরা। বিরোধী দলের যে কোন কথাই মাটিতে পড়ার আগে তিনি তার জবাব দিতেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে তার বাহাস ছিল আলোচিত। এটা নিয়ে অনেকে হাস্যরসও করতেন। বিএনপির যেকোন কাজ এবং বক্তব্যের তাৎক্ষনিক সমলোচনা দেওয়ার জন্য তিনি আলোচিত এবং সমলোচিতও ছিলেন। দুজনের মধ্যে কথার বাহাস উত্তল রাজনীতিতে ছিল একটা বড় উপাদেয়। কিন্তু যখন ওবায়দুল কাদের অসুস্থ হয়ে গেলেন, তখন সারাদেশের মানুষ, ওবায়দুল কাদেরের যারা কট্টর সমলোচক ছিলেন, তাকে নিয়ে রঙ্গরস করতেন, প্রত্যেকটা মানুষ তার মঙ্গল কামনার জন্য প্রার্থনা করেছেন। এমনকি বাংলাদেশের রাজনীতির এই দুর্যোগের মধ্যেও একটা ইতিবাচক ঘটনা ঘটেলো যে, আওয়ামী লীগের বর্তমান সময়ের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি নেতারা ওবায়দুল কাদেরের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে গিয়েছিলেন এবং তারপর তার সুস্থাস্থ্য কামনা করেছেন। তার আশু রোগ মুক্তির জন্য দোয়া করেছেন।

প্রতিপক্ষ রাজনীতির সঙ্গে তাদের বিরোধ ছিল আদর্শিক বিরোধ। সেই বিরোধের জেরে জনসভায় বক্তৃতায় বা বিবৃতিতে বা সংসদে নিশ্চয়ই প্রতিপক্ষের সমলোচনা বা দোষত্রুটির ব্যাপারে নির্দয় কথাবার্তা ব্যবহার করা হবে। কিন্তু যখন কেউ দুর্যোগে দুর্দিনে পড়বেন, তখন তার জন্য সহানুভূতি দেখানো। তার জন্য ছুটে যাওয়াই হলো রাজনীতির সবচেয়ে বড় উদারতা।।

ওবায়দুল কাদেরের এই অসুখ বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলকে এক কাতারে দাঁড় করিয়েছে। সেই জায়গাটার নাম হলো সহমর্মিতা, সহানুভূতিতা এবং ভালোবাসা। এটাই বাংলাদেশের রাজনীতির বড় শক্তি। শুধু এটা নয়, আমরা যখন দেখলাম মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের মা মারা গেলেন। তখন ওবায়দুল কাদের শোকবার্তা পাঠিয়েছিলেন। ওবায়দুল কাদেরের মায়ের মৃত্যুতেও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শোক জানিয়েছিলেন। এইটাই হলো বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ, সুশীল সমাজ এবং প্রশাসনের পার্থক্য। বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ যখন দশটাকা উপার্জন করেন, তখন আট টাকাই কিন্তু তার কর্মী এবং মানুষের জন্য খরচ করেন। কিন্তু আমাদের যারা সুশীল আছেন, তাদের উপার্জিত অর্থের দশ টাকার দশ পয়সাও কারো জন্য খরচ করেন না। আমাদের প্রশাসনিক যারা ব্যাক্তি রয়েছেন, তারা উপার্জনের দশ পয়সাও কারো জন্য খরচ করেন না।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান রাজনীতিতে এই সহমর্মিতার ধারাটি প্রবর্তন করেছিলেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন স্বাধীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেশ পরিচালনা করলেন, তখন অনেক স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে তিনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। তাদেরকে গ্রেপ্তার করেছিলেন, জেলে দিয়েছিলেন। আবার তাদের পরিবার যেন অভাব অনাটনে না থাকে, সে ভিত্তিতে মাসিক ভাতাও দিয়েছেন। ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক বিরোধ ছিল। বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক অবস্থান নীতির তীব্র সমলোচনা করতেন। কিন্তু তার সঙ্গে তার পারিবারিক সম্পর্ক অটুট ছিল। এইটা বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে মাঝখানে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিষ্ণুতা এবং পরস্পরের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এটা হয়েছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্টের পর থেকে। বাংলাদেশে যে রিবাজনীতিকরণের ধারা, সেই বিরাজনীতিকরণে রাজনীতিকে কলুষিত করার জন্য এটা করা হয়েছিল। কিন্তু জাতির পিতার কন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আস্তে আস্তে রাজনৈতিক সেই শিষ্টাচারগুলো এবং রাজনীতির সেই ভালোবাসাগুলো ফিরে আসছে এবং ওবায়দুল কাদেরের ঘটনাটা হলো তারই একটি বড় উদাহরণ।

আর আজ তৈরি হলো নতুন এক রাজনৈতিক ঐক্য। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার দাবি নিয়ে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল আজ মঙ্গলবার সচিবালয়ে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বিএনপি নেতারা সাক্ষাতের পর বলেছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার জন্য আদালতের নির্দেশে যে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছিল, সেই বোর্ডের চিকিৎসকরা গত ২৪ ফেব্রুয়ারি কারাগারে গিয়ে তাকে দেখে এসে কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষার কথা বলেছেন।

“পরীক্ষা নিরীক্ষা করার জন্য তারা আবারও বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে তাকে প্রেরণের কথা বলেছেন।… বোর্ড যেভাবে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, সেই সিদ্ধান্ত আমরা বাস্তবায়ন করার ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা প্রয়োজনে আবারও তাকে বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে পাঠিয়ে দেব তার চিকিৎসার জন্য।”

কবে নাগাদ খালেদাকে বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে নেওয়া হতে পারে- সেই প্রশ্নে মন্ত্রী বলেন, “আমরা শিগগিরই পাঠাব। আইজি প্রিজন্সকে আমরা বলে দেব, যে রকমভাবে বোর্ড বলেছে, ঠিক সেইরকমভাবে তাকে যেন বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে পাঠানো হয়।”

ফখরুল আরো বলেছেন, ফখরুল বলেন, “আমরা মনে করি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার কথা রাখবেন এবং তিনি দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সর্বোচ্চ চিকিৎসার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।”