শ্রমিকদের স্বার্থ দেখছে না ৯৯ শতাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানই

ডেস্ক রিপোর্ট: দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর ৯৯ শতাংশই শ্রমিকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করছে বলে প্রমাণ মিলেছে। প্রতিষ্ঠান অধিদফতর দেশের ২৩ উপজেলায় ছোট-বড় মিলিয়ে এমন ২৮ হাজার প্রতিষ্ঠানের সন্ধান পেয়েছে। আইন অনুযায়ী লভ্যাংশের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের কল্যাণার্থে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে জমা দেয়ার কথা। অথচ নিয়মিতভাবে এই কাজটি করছে মাত্র ১৩০টি প্রতিষ্ঠান। আর বাকি প্রতিষ্ঠানগুলো শ্রম আইনের এই বিধানকে তোয়াক্কাই করছে না।

জাতীয় সংসদের শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে এ বিষয়টি তদন্তে গঠিত সংসদীয় সাব-কমিটির প্রথম বৈঠকে এমনই চিত্র তুলে ধরছেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মো. রেজাউল হক এবং শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. আনিসুল আওয়াল। শ্রমিক স্বার্থ ক্ষুণ্ন করার ভয়াবহ এই নজির দেখে হতবাক হয়ে গেছেন কমিটির বৈঠকে উপস্থিত সংসদ সদস্যরা। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে অনতিবিলম্বে কিভাবে এই টাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আদায় করা যায় সে বিষয়ে করণীয় নির্ধারণের তাগিদ দিয়েছেন। এদিকে সাব-কমিটিতে সরকার গঠিত শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, এই পর্যন্ত কল্যাণ তহবিলে ৩৬০ কোটি জমা হয়েছে। এর মধ্যে এফডিআর হিসেবে ৩২৯ কোটি টাকা ও মাদার অ্যাকাউন্টে ৩৩ কোটি টাকা জমা রয়েছে। আর ৯০০৯ জন অসুস্থ শ্রমিককে আর্থিক সাহায্য দেয়া হযেছে ৩০ কোটি টাকা। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকপক্ষ কর্তৃক লভ্যাংশের ৫শতাংশ দেয়ার বিষয়টি তদন্তপূর্বক ওই অর্থ আদায়ের উপায় ও লভ্যাংশের অর্থ শ্রমিকদের সঠিকভাবে সাহায্য প্রদানের জন্য করণীয় নির্ধারণে এই সাব কমিটি গঠন করা হয়।

বৈঠকের কার্যবিরণী থেকে জানা যায়, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. আনিসুল আওয়াল বৈঠকে বলেন, ২০০৬ সালের ৬ জুলাই শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের আইন কার্যকর হয়। এর চার বছর পর ২০১০ সালে এটির গেজেট নোটিফিকেশন হয়েছে। তারও পাঁচ বছর পরে ২০১৫ সালে তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে যোগদান করে একটা অর্গানোগ্রাম তৈরি করে জনপ্রশাসনের অনুমোদন করান। ১৮টি পদসহ এই অর্গানোগ্রাম অনুমোদন হয়। ২০১৭ সাল হতে এর সম্পূর্ণ কার্যকারিতা শুরু হয়। তিনি জানান, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে ২০১৬ সালে ৩৭ জনকে আর্থিক সাহায্য করতে পেরেছেন। কারণ তখন ফান্ড তেমন ছিল না। আবার শ্র্রমিক বা শ্রমিক নেতারা সাহায্য চাওয়ার পদ্ধতিটাও জানতেন না। ফলে পত্রিকা এবং টেলিভিশনে প্রচার করা হয়। ২০১৭-তে প্রচুর আবেদন আসতে থাকে। ব্যক্তিগতভাবে ডাক্তার হওয়ায় তিনি নিজে প্রেসক্রিপশন বুঝে ৯২১ জনকে, এর পরের বছর ১ হাজার ৪০৬ জনকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে পেরেছেন। বিগত অর্থবছরে ৩ হাজার ৮৩৩ জনকে এবং সব মিলিয়ে ৯ হাজার ৯ জনকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করেছেন। এ সময় তিনি কমিটিতে বিভিন্ন অর্থবছরে শ্রমিকদের যে আর্থিক সাহায্য প্রদান করা হয়েছে তার একটি তালিকাও উপস্থাপন করেন।

বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. মো. রেজাউল হক বলেন, আইন অনুযায়ী লভ্যাংশের ৫ শতাংশ আলাদা করে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে জমা দেয়ার কথা। নিয়মিতভাবে এ পর্যন্ত ১৩০টি প্রতিষ্ঠান তাদের লভ্যাংশের ৫ শতাংশ অর্থ জমা প্রদান করছেন। এ ছাড়া ১৭১টি প্রতিষ্ঠানকে এক মাসের মধ্যে জমা প্রদানের চিঠি দেয়া হয়েছে। অন্যথায় আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি জানান, প্রতিষ্ঠান অধিদফতর কর্তৃক ২৩টি জেলায় ২৮ হাজারের মতো প্রতিষ্ঠান শনাক্ত করা হলেও মাত্র ১৩০টি প্রতিষ্ঠান লভ্যাংশের অর্থ জমা দেন।

এ বিষয়ে মো. রেজাউল হক সাংবাদিকদের বলেন, মাত্র গুটি কয়েক শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের লভ্যাংশ কল্যাণ তহবিলে দিচ্ছে। কীভাবে তাদের কাছ থেকে এ অর্থ আদায় করা যায় সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সংসদীয় সাব-কমিটির আহ্বায়ককে অনুরোধ করেছি।

এদিকে বৈঠকে সাব-কমিটির আহ্বায়ক ইসরাফিল আলম বলেন, মূল টাকাতে কেউ হাত দেবেন না। লভ্যাংশের টাকা দিয়ে অন্যান্য ব্যয় করতে হবে। আর প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক এবং তার পরিবার যেন টাকাটা পায় সে বিষয়ে লক্ষ রাখার জন্য তিনি মন্ত্রণালয় এবং শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনকে পরামর্শ দেন। মহাপরিচালককে আবেদনপত্র মূল ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক বা তার স্ত্রী জমা দিচ্ছে না দালাল চক্র জমা দিচ্ছে তাও তদারক করার পরামর্শ দেন।

এ সময় মহাপরিচালক জানান, কমপক্ষে ৩০ শতাংশ আবেদন থাকে ভুয়া। কিন্তু তা প্রমাণ করা দুষ্কর। তিনি ডাক্তার হওয়ায় নিজেই বিষয়গুলো যাচাই-বাছাই করে যেটা ভুয়া মনে হয় তা ভুয়া লিখে বাদ দেন।

এ বিষয়ে সাব-কমিটির আহ্বায়ক ইসরাফিল আলম বলেন, মাত্র হাতেগোনা কয়েকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান এই আইন মানছে। যারা মানছে না তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করবে সংসদীয় সাব-কমিটি। এই টাকাগুলো অসহায় গরিব মানুষের টাকা। তাই এর সর্বোচ্চ সুরক্ষা দেয়া কল্যাণ বোর্ডের এবং ডিজির দায়িত্ব। তাই যে ব্যাংকগুলোর পজিশন সবচাইতে ভালো সেখানে টাকা জমা করার সুপারিশ করা হবে। আইন অনুযায়ী ৫০ শতাংশ সরকারি ও ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার বিধান। প্রয়োজনে এই আইন সংশোধনের জন্য সুপারিশ করবে সাব-কমিটি।