যে দাঙ্গায় হিন্দু-মুসলমান ছিল একপক্ষে, অন্যপক্ষে কারা ছিলেন?

নিউজ ডেস্ক
ভারতের ইতিহাসে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার অনেক নজির থাকলেও ঠিক একশ বছর আগে ঔপনিবেশিক বোম্বেকে (এখনকার মুম্বাই) কাঁপিয়ে দিয়েছিল অন্যরকম এক দাঙ্গা।

সেবার হিন্দু-মুসলমান একপক্ষে লড়েছিল, একসঙ্গে হয়ে পিটিয়েছিল অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষজনকে। ১৯২১ সালের ওই দাঙ্গা পরে ‘প্রিন্স অব ওয়েলস দাঙ্গা’ নামে পরিচিতি পায়।

বিবিসি লিখেছে, এখনকার মুম্বাই বিভেদের সেই সময়ের কথা ভুলে গেলেও দাঙ্গাটির ইতিহাস ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হাজির করছে বলে মত ইতিহাসবিদ দিনিয়ার প্যাটেলের।

শতবর্ষ পুরনো ওই ইতিহাসের ঘটনার ঝাঁপি খুললে যত নাম বের হবে, তার মধ্যে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক মহাত্মা গান্ধী আর পতনের মুখে থাকা অটোমান সুলতানের নাম যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি মিলবে ব্রিটিশ রাজা অষ্টম এডওয়ার্ডের নামও, সেসময় তিনি ছিলেন প্রিন্স অব ওয়েলস, গিয়েছিলেন ভারত সফরে।

যেসব ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ আর লক্ষ্য ওই সংঘাতকে উসকে দিয়েছিল, তার মধ্যে স্বরাজ, স্বদেশী, সত্যাগ্রহ আর প্যান-ইসলামিজমের কথাও আসবে।

সেবার, ১৯২১ সালের নভেম্বরে, প্রিন্স অব ওয়েলস যিনি ভবিষ্যতে রাজা অষ্টম এডওয়ার্ড হিসেবে পরিচিতি পাবেন, তার রাজকীয় সফরকে কেন্দ্র করেই বেঁধেছিল গোল।

ভারত তখন গান্ধীর ডাক দেওয়া অসহযোগ আন্দোলনে টগবগ করে ফুটছে; এ সেই আন্দোলন যা ১৮৫৭ এর বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছিল।

‘হিন্দু-মুসলমান একতা’র ব্যানারে গান্ধী ঐক্যবদ্ধ হন ভারতীয় মুসলমানদের খেলাফত আন্দোলনের সঙ্গে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হেরে অটোমান সাম্রাজ্য তখন ধুঁকছে, ভারতের মুসলমানদের আশঙ্কা- যুদ্ধে জেতা ব্রিটিশরা সুলতানকে গদিচ্যুত করবে, যে সুলতান তাদের দৃষ্টিতে ইসলামী দুনিয়ার বৈধ খলিফা।

ভারতের ইতিহাসে হিন্দু-মুসলমানের এই একতা, সাম্প্রদায়িক ভ্রাতৃত্বের অসাধারণ এক মুহূর্ত হিসেবে হাজির থাকলেও সেসময় তা সংখ্যালঘু খ্রিস্টান, শিখ, পার্সি ও ইহুদিদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে উঠেছিল।

গান্ধী অবশ্য তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন; বলেছিলেন, “হিন্দু-মুসলমান মৈত্রীর অর্থ এই নয় যে বড় সম্প্রদায়গুলো ছোট সম্প্রদায়গুলোর উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে।”

প্রিন্স অব ওয়েলস আশা করেছিলেন, তার ভারত সফরে রাজভক্তির জোয়ার বইবে, গান্ধীর আন্দোলনও নিস্তেজ হয়ে যাবে।
বেচারার কপাল খারাপ। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস তাকে বোম্বেতে স্বাগতই জানাল হরতাল ডেকে, বিদেশে বানানো কাপড় পুড়িয়ে। এই বিদেশে বানানো কাপড়কে তখন দেখা হয়েছিল ব্রিটেনের অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যের প্রতীক হিসেবে।

বিবিসি লিখেছে, ১৯২১ সালের ১৭ নভেম্বর, বোম্বের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাসিন্দা হরতাল উপেক্ষা করে জাহাজে চেপে আসা প্রিন্স অব ওয়েলসের শহরে নামা প্রত্যক্ষ করতে ছোটেন। এদের মধ্যে বেশিরভাগই ছিল পার্সি, ইহুদি ও অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান।

সেই সময়ের তরুণ প্রত্যক্ষদর্শী, পরে ভারতের প্রথম নারী আলোকচিত্র সাংবাদিক হওয়া হোমাই ভায়ারাওয়ালা বলেছিলেন, গান্ধী অহিংস উপায়ে আন্দোলন চালানোর নির্দেশনা দিলেও প্রিন্সের আগমন উপলক্ষে পার্সি, ইহুদি আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের আগ্রহ কংগ্রেস ও খেলাফত কর্মীদের ক্রুদ্ধ করে তুলেছিল।

২০০৮ সালে দিনিয়ারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হোমাই বলেন, প্রিন্স অব ওয়েলসকে স্বাগত জানাতে সেদিন পার্সি স্কুলছাত্রীরা মঞ্চে ঐতিহ্যবাহী নৃত্য পরিবেশন করে। আর তার পরের দিনগুলোতে বোম্বের রাস্তায় রাস্তায় সংঘর্ষ দেখা যায়।

দাঙ্গাকারীরা সোডার বোতল আর মার্বেলকে অস্ত্র বানিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। হামলার শিকার হয়েছিল পার্সি মালিকানাধীন বিভিন্ন মদের দোকান। পাথর ছুড়ে, জ্বালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে দোকান বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হয়েছিল অনেককে।

বোম্বের মদের ব্যবসার সিংহভাগের নিয়ন্ত্রণ তখন পার্সিদের হাতে। গান্ধী চেষ্টা করেছিলেন, তারা যেন স্বেচ্ছায় দোকান বন্ধ রাখে, বুঝিয়ে শুনিয়ে সেই ব্যবস্থা করতে।

বোম্বেতে সেবারের সহিংসতায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গাকারীদের মূল ‘টার্গেটে’ পরিণত হয়েছিল মদের দোকানগুলো। এ দোকানগুলোকে তারা পার্সিদের অর্থনৈতিক আধিপত্য ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিরোধিতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করছিল।

তারা একবার পার্সি অধ্যুষিত একটি আবাসিক ভবনও পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। ওই ভবনের নিচতলায় ছিল মদের দোকান। দোকানদার তার স্টক খালি করে রাস্তায় সব মদ ঢেলে দিলে সে যাত্রা ভবনটি রক্ষা পায়।

সেবার পার্সি আর অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা কেবল মারই খেয়েছেন, ব্যাপারটা এমনও নয়। অনেকেই বাঁশের লাঠি, বন্দুক হাতে রাস্তায় নেমে পড়েছিলেন, গান্ধী সমর্থক খাদি পরিহিতদের ধরে ধরে পিটিয়েছেন। ‘গান্ধী টুপি নিপাত যাক’ স্লোগানও দিয়েছিলেন।

সবচেয়ে বেশি বিপদে ছিল কংগ্রেস সমর্থক পার্সি ও খ্রিস্টানরা, তারা উভয়পক্ষের আক্রমণের শিকার হয়েছিল।

সহিংসতা বন্ধের তড়িৎ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন গান্ধী, শান্তি প্রতিষ্ঠায় সব সম্প্রদায়ের নেতাদের একত্রিত করেছিলেন তিনি।

সেবছর ১৯ নভেম্বর তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে প্রথম অনশন করেন; সহিংসতা না থামা পর্যন্ত খাবার বা পানি স্পর্শ না করার অঙ্গীকার করেন।

তার কৌশল কাজে লেগেছিল। ২২ নভেম্বরই তিনি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের পাশে নিয়ে তার অনশন ভাঙেন।

কিন্তু এই ‘প্রিন্স অব ওয়েলস’ দাঙ্গা তার মনকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়। তার স্বগতোক্তি ছিল, “আমরা স্বরাজের নমুনা দেখলাম।”

সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ নিয়ে সংখ্যালঘুদের ভয়ের যে ভিত্তি আছে, দাঙ্গা যে তা-ই দেখিয়েছে, কষ্ট নিয়েই তা স্বীকার করতে হয়েছিল গান্ধীকে।

এ কারণেই বোম্বে যখন দাঙ্গার তাণ্ডব পেরিয়ে ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করল, গান্ধীকে তখন দেখা গেল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জনে দৌড়ে বেড়াতে।

তিনি কংগ্রেস ও খেলাফত কর্মীদেরকে সংখ্যালঘুদের অধিকারের গুরুত্ব এবং ভুলের প্রায়শ্চিত্ত নিয়ে কাজ করার নির্দেশনা দিলেন।

গান্ধী বললেন, সংখ্যালঘুদের সম্পদ ‍সুরক্ষিত রাখা সংখ্যাগরিষ্ঠদের ‘পবিত্র দায়িত্ব’।

বিভিন্ন বৈঠক এবং কংগ্রেসের প্রকাশনাগুলোতে সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিদের গুরুত্ব দেওয়া শুরু হল। নেতারা গান্ধীবাদী কৌশল সম্পর্কে ভুল ধারণা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদ নিয়ে সন্দেহের ব্যাপারগুলো তুলে ধরতে লাগলেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, গান্ধী তার ‘হিন্দু-মুসলমান একতা’ স্লোগান বদলে ফেলে তুললেন ‘হিন্দু-মুসলিম-শিখ-পার্সি-খ্রিস্টান-ইহুদি একতা’র কথা।

খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও এই স্লোগানে কাজ হয়েছিল; সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আশ্বস্ত হয়েছিল, স্বাধীন ভারতেও তাদের জায়গা থাকবে।

সেবারের দাঙ্গা অন্তত ৫৮ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল, বোম্বের প্রতি ছয়টি দোকানের মধ্যে অন্তত একটি হয়েছিল হামলার শিকার।

আর প্রিন্স অব ওয়েলসের জন্য সেই দাঙ্গা এসেছিল অশুভ সংকেত হয়ে। এরপর ভারতের যেখানেই তিনি গেছেন, পেয়েছেন হরতাল কিংবা হুমকি।

গান্ধীর ওই তড়িৎ পদক্ষেপের কারণেই ১৯২১ এর ওই দাঙ্গা এখন বিস্মৃতির অতলে চলে গিয়েছে। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদের অপচ্ছায়াকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, নিশ্চিত করেছিলেন দাঙ্গা যেন বোম্বেতে স্থায়ী দাগ না ফেলে।

শতবর্ষ আগেই তিনি দূরদর্শী এক সতর্কবাণী দিয়ে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠরা যদি আজ অন্যদের নিপীড়ন করতে একত্রিত হয়, তাহলে কাল সেই ঐক্য লোভ-লালসার কারণে বা মিথ্যা ধর্মান্ধতায় ভেঙে যাবে।