যেসব মামলা শেষ হয় না

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাংলাদেশে অনেক মামলার বিচার দ্রুত নিষ্পত্তি হয়। কিন্তু কিছু মামলা আছে যেগুলো রাজনৈতিক মামলা এবং রাজনৈতিক কাজেই এগুলো ব্যবহৃত হয় বলে অনেকে মনে করেন। সেগুলোর নিষ্পত্তি বছরের পর বছর আটকা পড়ে থাকে। রাজনৈতিক নানা হিসাব-নিকাশের বেড়াজালে এই মামলাগুলো এগোয় না এবং এগুলোর নিষ্পত্তিও হয় না। এরকম মামলাগুলোর মধ্যে কয়েকটি আলোচিত মামলা হলো:

১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আবুল মঞ্জুরকে পুলিশ হেফাজতে হত্যা করা হয়। এর ১৪ বছর পর বিএনপি আমলে ১৯৯৫ সালে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদকে প্রধান আসামী করে মামলা দায়ের করা হয়। মামলার মূল বক্তব্য ছিল, জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর চট্টগ্রামের তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল মঞ্জুর যে বিদ্রোহ করেছিলেন এবং সেসময় তিনি যখন ঢাকার দিকে এগুচ্ছিলেন তখন তাকে হত্য করা হয়। মেজর জেনারেল মঞ্জুরের কাছে সেসময় গুরুত্বপূর্ণ অনেক তথ্য ছিল বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু তারপর রাজনৈতিক বেড়াজালে মামলাটি আটকা পড়ে যায়। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৯ সাল, গত দুই যুগ ধরে মামলাটি ঝুলে আছে। এই মামলাটিকে বলা হয় এরশাদকে বশীকরণের মামলা। যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তারাই এরশাদকে বশে রাখার জন্য এই মামলাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কিছুদিন আগে এই মামলাটির রায় দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে রায় আবারও পিছিয়ে যায় এবং মামলার অধিকতর তদন্ত সাপেক্ষে শুনানীর জন্য অপেক্ষমান রাখা হয়। মনে করা হয়, এই মামলার কারণেই এরশাদ নড়াচড়া করতে পারেন না এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম আচরণ করেন।

১৯৮৬ সালে সংবিধানে অষ্টম সংশোধনী আনেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনি সংবিধানে দুটি পরিবর্তন এনেছিলেন। প্রথমটি ছিলো হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণ, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে তিনি হাইকোর্ট স্থাপন করেছিলেন। দ্বিতীয়টি ছিল, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। দুটি সংশোধনীকেই চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবীরা। এর মধ্যে হাইকোর্ট বিকেন্দ্রীকরণে অষ্টম সংশোধনী বাতিল হয়ে যায়। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংশোধনী নিয়ে করা রিট ৮৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয়নি। মামলাটি নিয়ে কেউই অগ্রসর হয় না। মামলাটি হাইকোর্টে স্তূপের নিচে পড়ে আছে।

সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে অবৈধ ক্ষমতা দখলের মামলাটি করেছিলেন জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে তিনি রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে মামলাটি করেন। মামলাটি দায়ের করাই সার। এরপর থেকে মামলাটির কোন অগ্রগতি হয়নি। মামলার বাদী ইনু এবং বিবাদী এরশাদ এখন মহাজোটের শরিক।

যুবক নামের সংগঠনটির বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আত্মসাৎ করে নিজেরা সম্পদের পাহাড় গড়েছে। অধিক মুনাফাসহ নানা রকম প্রলোভন দেখিয়ে তারা সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত যুবক নামক সংগঠনটি ফুলে ফেঁপে ওঠে। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর আবারও বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে সংগঠনটি আবারও আত্মপ্রকাশ করে। ২০০৭ সালের পর যু্বকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উদ্যোগ নেয়। রাষ্ট্রীয় নিয়ম নীতি লঙ্ঘন করে মানুষের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করা হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে মামলার কার্যক্রম অব্যাহত থাকলেও আজ পর্যন্ত মামলার কোন সুরাহা হয়নি। বিভিন্ন স্থানে যুবকের সম্পত্তিগুলো যে যার মতো দখলে নিয়েছে। কিন্তু যুবকের কাছে গচ্ছিত টাকাগুলো আজও ফেরত পায়নি সাধারণ মানুষ।

যুবকের পরপরই ২০১০ সালে এমএলএম কোম্পানি ডেসটিনির বিরুদ্ধে মামলা করে আওয়ামী লীগ সরকার। ডেসটিনির কার্যক্রম ছিল অনেকটা যুবকের অনুরূপ। মানুষের সম্পদ আত্মসাৎ করে তারাও সম্পদের পাহাড় গড়েছিল। ডেসটিনির বিরুদ্ধে মামলা হলেও আজ পর্যন্ত তার বিচারিক কোন অগ্রগতি দৃশ্যমান নেই। ডেসটিনির কর্তাব্যক্তিরা আইনের ফাঁক-ফোকর গলে বহাল তবিয়তে আছেন এবং ডেসটিনির সম্পদ-সম্পত্তি ভোগ করে যাচ্ছেন।

আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদে সবচেয়ে আলোচিত ব্যাংকিং কেলেঙ্কারী হলো হলমার্কের দুর্নীতি। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক থেকে ২০১০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ ওঠে হলমার্ক নামক একটি ভুইফোঁড় প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। সরকার দ্রুততার সঙ্গে হলমার্কের মালিকদের গ্রেপ্তার করে। কেলেঙ্কারীর সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে কয়েকজন ব্যাংক কর্মকর্তাকেও গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। কিন্তু মামলাগুলো আর আলোর মুখ দেখছে না। হল মার্কের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদ তার মুক্তির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন এবং তিনি টাকা পরিশোধ করে দেবেন বলে জানিয়েছেন

বাংলাদেশে এখন আইনের শাসন অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু আইনের শাসন পুরোপুরিভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করলেই শুধু হবে না, দ্রুত ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। বছরের পর বছর যদি মামলাগুলো বিচারের অপেক্ষায় থাকে তাহলে আইনের প্রতি মানুষের আস্থায় চিড় ধরতে পারে। একইসঙ্গে ন্যায়বিচার এবং আইনের শাসন সুদূর পরাহত হয়ে পড়ে। তাই আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই মামলা গুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন।