মুজিবনগর সরকার ইংরেজী ভাষাতেও পত্রিকা প্রকাশ করেছিল, নাম ছিল বাংলাদেশ

প্রফেসর ডা. মাহবুব হোসেন মেহেদী
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তানের গণমাধ্যমে স্বাধীনতাকামী কোটি জনতার আকাঙ্খাারা প্রতিফলনের কোন সুযোগ ছিল না। ২৫ মার্চের কালরাতেই ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম সারির একাধিক সংবাদপত্র অফিস পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হামলার শিকার হয়। পরবর্তীতে হানাদার বাহিনী নিয়ন্ত্রিত রেডিও পকিস্তান, পাকিস্তান টেলিভিশনসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রকে ব্যবহার করা হয় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী প্রচার ও প্রকাশ মাধ্যম হিসেবে। এ অবস্থায় পাকিস্তানী অপপ্রচারের বিরুদ্ধে এবং দেশ ও দেশের বাইরে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয় মুজিবনগর সরকার। সেই লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১১ মে মাসে মুক্তিকামী জনতার মুখপত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা।
মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে দেশে-বিদেশে জনমত গড়ে তুলতে সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’ পত্রিকা রাখে অসামান্য ভূমিকা। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে মুক্তাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সীমিত প্রচার সংখ্যায় প্রায় শতাধিক পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু সেগুলোর প্রকাশনা ছিল অনিয়মিত। এদিক থেকে সাপ্তাহিক জয় বাংলা ব্যতিক্রম। ১৯৭১ সালের ১১ মে থেকে ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৪টি সংখ্যার প্রতিটি প্রকাশ হয় নিয়মিতভাবেই। ওই বিরুদ্ধ সময়ে মুক্তিকামী জনতার কণ্ঠস্বরে পরিণত হওয়া আট পৃষ্ঠার পত্রিকাটির প্রচার সংখ্যা ছিল ৩০ হাজার পর্যন্ত। মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর, সাবসেক্টর, মুক্তাঞ্চল এবং ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলোতে ‘জয় বাংলা’ পাওয়া যেত। এমনকি পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের মানুষও ‘জয় বাংলা’ পড়তেন। বাংলাদেশের পত্রিকা হিসেবে তাদের কাছে এটির আলাদা কদর ছিল। আবার প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে নিবন্ধনপ্রাপ্ত প্রথম পত্রিকাও এটি, যার নম্বর-১। সে হিসেবে ‘জয় বাংলা’ই সরকার অনুমোদিত বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা।
তবে, তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত মুজিবনগর সরকার যেসব ঐতিহাসিক কাজ করে, তার একটি ছিল তথ্যপত্র প্রকাশ ও বিশ্বজনমত সৃষ্টি। প্রচারমাধ্যমে প্রেস রিলিজ প্রেরণ এবং বহির্বিশ্ব প্রচার বিভাগ (external publicity division) থেকে জার্নাল প্রকাশ ছিল মুজিবনগর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এক কাজ। ওই সব প্রেস রিলিজ এবং জার্নাল থেকে মুজিবনগর সরকারের কর্মকাণ্ডের নানা পরিচয় পাওয়া যায়। কলকাতার ৯ নম্বর সার্কাস এভিনিউ থেকে বাংলাদেশ মিশনের মাধ্যমে প্রেস রিলিজগুলো পাঠানো হতো পত্রিকায়। ১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল প্রেরিত এক প্রেস রিলিজে সোভিয়েত সরকারের কাছে মওলানা ভাসানীর সহযোগিতার আবেদন সম্পর্কে জানানো হয় :

‘In a telegram sent fo the USSR President Podgormy, Prime Minister Kosygin and Secretary General Brezhnev, National Awami Party President, Maulana Abdul Hamid Khan Bhasani appealed to raise their voice against the barbarities Committed by Pakistan Army in Bangladesh and urged the Russian Government to give immediate recognition and all possible help to the Government of Bangladesh.’

মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বৃদ্ধি এবং জনমত গড়ার ক্ষেত্রে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ পালন করে ঐতিহাসিক ভূমিকা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে মুজিবনগর সরকারের সদস্যরা মাঝেমধ্যে বক্তৃতা দিয়ে দেশবাসীকে মুক্তিযুদ্ধে অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করতেন। ১৯৭১ সালের ১০ মে প্রচারিত এমন একটি প্রেস রিলিজে দেখা যায়, গণপ্রতাজন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এক ভাষণ দেন। ওই প্রেস রিলিজে বলা হয় : Syed Nazrul Islam, Acting President of People’s Republic of Bangladesh in his address to the People of Bangladesh from the Swadhin Bangla Betar Kendra’s today commended the role of Mukti Fouz. He expressed his strong hope that present phase of the struggle for liberation would very soon bring home the recognition of Bangladesh Government by many of the foreign countries. He further added, ‘we have crossed the darkest period of our struggle and heading towards down’.

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মিশন থেকে প্রেরিত প্রেস রিলিজে দেখা যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ভারতের সরকার ও জনগণের অসীম সহযোগিতার চিত্র। কলকাতার বাংলাদেশ মিশনে ভারতীয় জনসাধারণ যে অর্থসাহায্য করেন, একাধিক প্রেস রিলিজে তাদের নামের তালিকা প্রকাশিত হয়। জনৈক মি. বি. গাঙ্গুলি মাত্র এক টাকা সাহায্য করেন, তাও প্রেস রিলিজে উল্লেখ করা হয়।

১৯৭১ সালের ১৩ জুন পাঠানো এক প্রেস রিলিজে জাতির উদ্দেশে তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণের সংবাদ জানা যায়। ওই ভাষণে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক পরিস্থিতি তিনি বিশদভাবে তুলে ধরেন। আসন্ন বিজয়ের আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন :

‘….be kind and helpful to fellow-suffers in the common struggle, be on your guard against enemy agents seeking to disturb communal and sectional peace, and finally, have faith in the justness and invincibility of your cause. Our victory in assured.’

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছে, অস্ত্রসহ নানাভাবে সাহায্য করেছে পাকিস্তান সরকারকে। মুজিবনগর সরকার বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের এ আচরণের প্রতিবাদ জানিয়েছে, পত্রিকায় পাঠিয়েছে প্রেস রিলিজ। ১৯৭১ সালের ২৩ জুন পাঠানো এমনি এক প্রেস রিলিজে দেখা যায় অস্থায়ী সরকারের একজন প্রতিনিধির সংবাদ সম্মেলনের তথ্য :

‘He added that Government of Bangladesh would appeal to the Government of USA (i) to call back the ships now Carrying arms to Pakistan, (ii) Freeze stock of all US arms in Pakistan, and (iii) stop forthwith all further shipment of arms, equipment and supplies to Pakistan so as not to be a vital and continuing accessory to Pakistan so as not to be a vital and continuing accessory to genocide and uprooting of more millions of innocent defenseless people and want on destruction and devastation.’

মুজিবনগর সরকার মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে এবং জনমত সৃষ্টির জন্য ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি জার্নাল প্রকাশ করে। ১৯৭১ সালের ৩০ জুন ‘বাংলাদেশ’ শীর্ষক পত্রিকার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতি আনয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় ‘Birth of a New Democracy’ শীর্ষক রচনায় বলা হয় :

From Yahya’s latest utterance we see that the Pakistan Army has now made clear its intent to hold into power indefinitely. Democracy is dead in Pakistan and as a result, so it Pakistan itself. In its place we have put the Peoples Republic of Bangladesh which will be truly democratic both in sprit and in practice’.

‘বাংলাদেশ’ পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন তথ্য ও সংবাদ পরিবেশিত হতো। মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যাতেই এ বিষয়ে সংবাদ থাকত। ২৪ নভেম্বর পত্রিকার ২২তম সংখ্যায় দশ বছর বয়সী এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার অসীম বীরত্বের কথা প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকার ২৫তম সংখ্যা। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়লগ্নে পৃথিবীর সব প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আহ্বান জানান। পত্রিকায় এ সংবাদটি প্রকাশিত হয় এভাবে :

‘Bangladesh Prime Minister Mr. Tajuddin Ahmed has called upon all the progressive countries of the world to recognize the emergence of the independent country of Bangladesh whose objectives were peaceful coexistence, nonalignment in international politics, and opposition to colonialism and imperialism. He said, ours is a democracy@we believe in a democracy@we believe in secularism and socialism.’

৭ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক ভাষণ দেন। পত্রিকার ২৫তম সংখ্যায় ওই ভাষণের পূর্ণপাঠ মুদ্রিত হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি তাঁর ভাষণ শেষ করেন এভাবে :

‘The final hour is round the corner, every Bengali should endeavour, in his own manner, to take part in this great achievement. Inshallah, we shall soon establish our full administrative control over the capital city of Dacca and only then the dream of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman will come true.

Long live Sheikh Mujibur Rahman. Long live the struggling people of Bangladesh. Long live Bangladesh Liberation forces. Joy Bangla’.

বিজয়ের অব্যবহিত পরে ২২ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয় ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকার সর্বশেষ সংখ্যা। ওই সংখ্যায় একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়, যেখানে দেখা যায়, কোন ধরনের মার্কিন সাহায্য গ্রহণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের না-সূচক অভিমত। পত্রিকার সংবাদটি ছিল এ রকম :

‘Mr. Tajuddin Ahmed, Prime Minister of Bangladesh, Completely ruled out the possibility of seeking any economic aid from the United States for rebuilding the new nations shattered economy.’

বিশ্বজনমত গড়ে তোলার উদ্দেশ্য নিয়ে ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকা প্রকাশিত হতো ইংরেজি ভাষায়। পত্রিকার শিরোনামটিও ছিল ইংরেজিতে—‘Bangladesh’।

মুজিবনগর সরকারের কর্মকাণ্ড কিভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে, সে সম্পর্কে তথ্যনিষ্ঠ সংবাদ জানার জন্য সে সরকারের প্রেস রিলিজ ও পত্রিকা আমাদের কাছে সরবরাহ করতে পারে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ওই সব তথ্য পর্যালোচনা করলে দূর হতে পারে অনেক বিভ্রান্তি।

লেখক ও সংগ্রাহক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, অর্থপেডিক স্পাইন এন্ড ট্রমা সার্জারী বিভাগের অধ্যাপক এবং সাবেক অধ্যক্ষ, চুয়াডাঙ্গা জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক, দৈনিক এই আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদকমন্ডলীর সভাপতি।