মক্কা-মদিনাতেও হাজিদের সঙ্গে প্রতারণা

নিজস্ব প্রতিবেদক: গত দশ দিন হলো দেশে ফিরছেন হাজিরা। এই হাজিদের অনেকেই পবিত্র মক্কা-মদিনায় অসাধু হজ এজেন্সি ও স্থানীয় মোয়ালে­মদের চরম অব্যবস্থাপনা ও প্রতারণার যে বর্ণনা দিচ্ছেন তা রীতিমত মর্মস্পর্শী। কেউ কেউ এয়ারপোর্টে নেমে রীতিমত কেঁদে ফেলছেন। তারা প্রতারক এজেন্সিগুলোর বিচার দাবি করছেন। উন্নত মানের বাসা,স্বাস্থ্যসম্মত ভালো খাবার ও গাইড খরচের নামে এজেন্সিগুলো নানা কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিলেও কাঙ্ক্ষিত সেবা পাননি হাজিরা। তাদেরকে জিম্মি করে চরম দুর্ভোগে ফেলা হয়।

অভিযোগ উঠেছে, চিকিৎসা ও পরিবহন সুবিধাসহ যেসব সুযোগ-সুবিধা হাজিদের দেওয়ার কথা ছিলো তা দেওয়া হয়নি। তাদের যে ধরনের বাড়িতে রাখার প্রতিশ্রুতি ও প্রলোভন দিয়ে সৌদি আরবে নেওয়া হয়,বাস্তবে তা হয়নি। রাখা হয় অত্যন্ত নিম্নমানের ঘরে গাদাগাদি করে। পবিত্র কাবা শরিফের কাছাকাছি বাড়ি ভাড়ার কথা বলে তাদের রাখা হয় ৫-১০ কিলোমিটার দূরবর্তী স্থানে। গাড়ির কথা বললেও সেখানে গাড়ি দেওয়া হয়নি। গাইডের অভাবেও অপরিচিত জায়গায় হাজিদের অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। আবার কিছু এজেন্সির বিরুদ্ধে হজ যাত্রীদের খাবার না দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এজেন্সিগুলো খাবার সরবরাহ বাবদ মোটা অংকের অর্থ নিলেও হাজিদের নির্ভর করতে হয়েছে বাইরে থেকে কিনে আনা খাবারের ওপর। আবার অনেকে দেশ থেকে নেওয়া চিড়া মুড়ি খেয়েই দিন পার করেছেন।কেউ কেউ সৌদি আরবে বাংলাদেশ দূতাবাস ও মক্কায় বাংলাদেশের হজ অফিসে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি।

বাংলাদেশ থেকে যে সব কর্মকর্তা হাজিদের সেবার কথা বলে সৌদি আরব গিয়েছিলেন তাদেরও খোঁজ পাননি কোন হাজি। মক্কা বাংলাদেশ হজ মিশনের তথ্যমতে,এ বছর বাংলাদেশ থেকে মা আম্বিয়া ও এম তাইব্যা ট্যুরস এন্ড ট্রাভেলসের মাধ্যমে হজে যাওয়া ৪১৬ জন হাজি সৌদি আরবের মক্কায় সীমাহীন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। গতকাল পর্যন্ত ৫৬ টি বেসরকারি হজ এজেন্সির বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ হজ মিশন। ৫৬ টি বেসরকারি এজেন্সির ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে যৌথ ব্যবস্থা নিচ্ছে সৌদি-বাংলাদেশ সরকার। হজ পালন করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে ৯৪ জন বাংলাদেশি ইন্তেকাল করেছেন।

রবিবার ও গতকাল সোমবার বিমান বন্দরে সাংবাদিকদের সাথে দুর্ভোগের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন কয়েকজন হাজি। খুলনা,হবিগঞ্জ,চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীর একাধিক হাজি বলছিলেন তাদের দুর্ভোগের কথা। তারা বলেন,প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি অধিকাংশ এজেন্ট।কাবা থেকে বহু দূরে নিম্নমানের হোটেলে রাখা হয় তাদেরকে। যেখান থেকে পায়ে হেঁটে মক্কায় সালাত আদায় করা অসুস্থ ও বৃদ্ধদের জন্য প্রায় অসম্ভব ছিল। পলিথিনে করে গলধ:করন অযোগ্য পঁচা-বাসি খাবার দেওয়া হয় তাদেরকে। হজ গাইড লাপাত্তা থাকায় হজের কিছু রুকন ও আহকাম প্রতিপালনে সমস্যায় পড়েন তারা। পশু কোরবানি নিয়েও ছিল অস্বচ্ছতা। পশু ক্রয়ের জন্য টাকা নিয়ে হাজিদের অজ্ঞাতে কোরবানি দেওয়া হয়েছে বলে জানান তারা। কোরবানির পশুর জন্য প্রতিজনের কাছ থেকে নেওয়া হয় ৪৯০ সৌদি রিয়াল।

কেবল বেসরকারি নয়,সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ করতে যাওয়া হাজিদের খাবার মেনুতে ছিল ‘মুলার ঝোল’,বাসি-পচা খাবার। এদিকে হাজিরা দেশের ফেরার জন্য শিডিউল বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন। একটি বিমান যান্ত্রিক ক্রুটির কারণে গ্রাউন্ডেড হওয়ায় দুর্দশায় পড়েছেন সেই বিমানের সব হাজি। তারা কবে দেশে ফিরতে পারবেন তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।বাংলাদেশের মহিলা হাজি আমেনা খাতুন বলেন, আমরা মক্কায় এসে পৌঁছানোর পর প্রতিশ্রুতির অনেক কিছুরই মিল খুঁজে পাইনি। আমাদের পবিত্র কাবা শরীফের পাশে রাখার কথা বলেছিল কিন্তু আল্লাহর ঘর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে আমাদের রাখা হয়। পবিত্র হারাম শরীফ গিয়ে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করতে খুবই কষ্ট হয়। খাবারের মান এতো নিম্ন বলার অপেক্ষা রাখে না, আরো কষ্ট হয়েছে আমাদের যে বিল্ডিং এ রাখা হয় সেখানে অনেক সময় পানি ছিল না।

বৈশাখী টেলিভিশনের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক টিপু আলম মিলন তার দুর্ভোগের চিত্র তুলে ধরে ইত্তেফাককে বলেন,বাংলাদেশ সরকার সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে পবিত্র হজ পালনের জন্য প্রতিবছর নানা পদক্ষেপ নিলেও কিছু হজ এজেন্সির প্রতারণা,অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে হজযাত্রীদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। পবিত্র কাবা শরীফের খুব কাছে থাকার ব্যবস্থা করে দিবে ফাইভ স্টারের মতো হোটেলে রাখা হবে,কিন্তু বাস্তবে কাবা থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে নিম্নমানের হোটেলে রাখা হয়। কাউকে কাউকে রাখা হয় পাহাড়ের ওপরে।দুই জনের ধারণক্ষমতা সম্পন্ন হোটেল কক্ষে গাদাগাদি করে রাখা হয় ৮-১০ জনকে। খাবার দেওয়া হয় পলিথিনের প্যাকেটে করে। যে খাবার খুবই নিম্নমানের। দুর্গন্ধময় বাথরুমে লাইন ধরে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে। ডায়াবেটিস রোগী ও বয়োবৃদ্ধরা বাথরুম ব্যবহার করতে না পেরে ভয়াবহ সমস্যায় পড়েন। খাওয়ার পানি ছিলো না. বাথরুমে টিস্যু ছিলো না। রুমের ভেতর দুর্গন্ধ।

টিপু আলম মিলন বলেন,কোরবানির পশু নিয়ে সবচেয়ে অস্বচ্ছতার আশ্রয় নিয়েছেন হজ এজেন্টরা। আমাদের কাছ থেকে পশু ক্রয়ের টাকা নিয়ে আদৌ তারা কোরবানি দিয়েছেন কি না তা নিশ্চিত নই আমরা। কারণ তারা ছবি দেখিয়ে বলেছেন পাহাড়ে ছাগল রাখা আছে। আমরা সেই পশু দেখতে যেতে চাইলে তারা নানা টালবাহানা করেছেন।

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের হাজী আবদুর রহমান বলেন,আমরা হারাম শরীফ মসজিদে রাত কাটিয়েছি। মিনা যেতে হাজিদের কষ্টের শেষ ছিলনা । হাজি রহিমা খাতুন কান্না জড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, তাদের যেখানে রাখা হয়েছিলো সেটা ছিলো খুবই নোংরা ভবন। কাফেলার হাজিদের ডায়রিয়া হয়েছিলো। তাদের কয়েকজনকে আবার রাখা হয় একটি ভবনের আন্ডার গ্রাউন্ডে। যেখানে কোনো বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা ছিলো না। এমনকি মোবাইলের নেটওয়ার্কও ছিলো না। বৃদ্ধ হাজি আবদুল কুদ্দুস বলেন, পলিথিনে দেওয়া হয় খাবার। অনেক সময় পচা ও দুর্গন্ধযুক্ত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

হাজী রহমত উল্লাহ বলেন, বাংলাদেশ দূতাবাস ও মক্কা হজ অফিসে লিখিত অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।বেসরকারি ব্যবস্থাপনার মতোই সরকারি ব্যবস্থাপনায় যারা হজে গিয়েছেন তাদের দুর্ভোগও ভয়াবহ। এ বছর বাংলাদেশ থেকে মোট ৭ হাজার ১৯৮ জন সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ পালন করতে সৌদি আরবে যান।হজের সময়ে মক্কায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় যাওয়া ‘এ’ ক্যাটাগরির হাজিদের জন্য সরবরাহকৃত খাবারের মান নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন দেশে ফেরা কয়েকজন হাজি। প্রতিদিন দুপুরে একবেলা খাবারের জন্য হাজিদের কাছ থেকে সৌদি ১৪ রিয়াল (বাংলাদেশি টাকায় ৩১৫ টাকা) নেওয়া হলেও চাহিদামতো খাবার পাননি কোন হাজি।

বাংলাদেশ বিমানের বিজি ৩৫০৬ নং ফ্লাইটে আসা ঠাকুরগাঁয়ের ইমরান হোসেন ক্ষোভের সাথে বলেন, মূলার ঝোল আর অর্ধসিদ্ধ করলা কোনো জনমেই খাইনি। দুর্গন্ধযুক্ত গোস্ত খেয়ে অনেকে অসুস্থও হয়েছেন। এদিকে জেদ্দায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফিরতি হজ ফ্লাইটের শিডিউল বিপর্যয়ের পর হাজারো বাংলাদেশি বিপাকে পড়েছেন। জেদ্দা বিমানবন্দরে তাদের রাত কাটছে নির্ঘুম। প্রচণ্ড গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনেকে। সঙ্কট কাটাতে শিডিউল ফ্লাইট বাদ দিয়ে ’এয়ার এশিয়া’র ভাড়া (লিজ) করা বিমানে কিছুসংখ্যক হাজিকে দেশে পাঠানো গেলেও আসনসংখ্যা কম হওয়ায় নতুন সমস্যা দেখা দেয়। গতকালও ঢাকা-জেদ্দা ও ঢাকা-রিয়াদ রুটে হজ এবং শিডিউল ফ্লাইট নির্ধারিত সময়ের অনেক দেরিতে ছেড়ে গেছে।

এদিকে বাংলাদেশের ধর্ম মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বুলেটিনে জানানো হয়, ২৫ আগস্ট পর্যন্ত পবিত্র হজ পালন শেষে ৩৮ হাজার ৬১৬ জন হাজি দেশে ফিরেছেন। মোট ১০৬টি ফ্লাইটে তারা দেশে ফেরেন। এর মধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ৪৫টি ও সৌদি এয়ারলাইন্সে ৬১টি রয়েছে।

চলতি বছর সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ১ লাখ ২৬ হাজার ৯২৩ জন হজে যান। গত ১০ আগস্ট পবিত্র হজ অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ আগস্ট থেকে ফিরতি হজ ফ্লাইট শুরু হয়েছে। চলবে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।