বড়ো ছাড় আসছে ভ্যাট-ট্যাক্সে


বাজেটে আয়কর ও ভ্যাট খাতে বেশকিছু পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার। মূলধনী যন্ত্রপাতি ও কাঁচামালে নতুন করে আরোপ হওয়া অগ্রিম কর (অগ্রিম ভ্যাটের আদলে) প্রত্যাহার হচ্ছে। রডসহ স্টিল পণ্যে নতুন করে আরোপ হওয়া ভ্যাট ও করহার কমতে পারে। রড ও স্টিল পণ্যের ভ্যাট-ট্যাক্স নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে উদ্বেগ রয়েছে। অন্যদিকে কোম্পানির অবণ্টিত মুনাফায় (রিটেইন্ড আর্নিংস) আরোপ হওয়া ১৫ শতাংশ করের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দেওয়া হলেও পুরো প্রত্যাহার না-ও হতে পারে। এতদিনের যে পুঞ্জিভূত অবণ্টিত মুনাফা রয়েছে— তা করের আওতায় আসবে না। নতুন অর্থবছর থেকে অবণ্টিত মুনাফার একটি অংশের উপর হ্রাসকৃত হারে কর আরোপ হবে মর্মে সংশোধনী আসতে পারে। শেয়ারবাজারে স্টক ডিভিডেন্ডের উপর আরোপ হওয়া করেও ছাড় আসতে পারে। এর বাইরে ই-কমার্সসহ আরো কিছু খাতে কর প্রত্যাহার কিংবা কিছুটা ছাড় আসতে পারে।
আগামীকাল রবিবার সংসদে বাজেট পাশ হচ্ছে। এর আগে আজ শনিবার সংসদে অর্থবিল পাশ হবে। অর্থবিলে এসব সংশোধনী আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দিতে পারেন বলে বাজেট সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, ব্যবসায়ীদের ট্রেড লাইসেন্সের বর্ধিত ফিও কিছুটা কমতে পারে। ট্যাক্স বারের সদস্য হওয়া ছাড়াই অবসরপ্রাপ্ত কর কর্মকর্তাদের আয়কর আইনজীবী হওয়ার প্রস্তাবও বাতিল হচ্ছে।

তবে সঞ্চয়পত্রের মুনাফায় করহার ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ করা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও শেষ পর্যন্ত তা বাতিলের পক্ষে নয় এনবিআর। বিদ্যুত্ সংযোগে সিটি করপোরেশনসহ পৌরসভা পর্যায়ের গ্রাহকের টিআইএন (কর শনাক্তকরণ নম্বর) নেওয়া বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাবটি বাতিলের জন্য বিদ্যুত্ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। এটিও বাতিলের পক্ষে নয় কর বিভাগ। এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ও দিক-নির্দেশনার অপেক্ষায় রয়েছেন বাজেট সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাজেটে কী ধরনের পরিবর্তন আনা যায়, তা নিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বাজেট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে সম্প্রতি বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী। ওই বৈঠকে ব্যবসায়ীদের বেশকিছু দাবি নিয়ে আলোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। এর মধ্যেই গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে বাজেটে পরিবর্তনের দাবির একটি বিশাল ফর্দ তুলে ধরে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। ওই আলোচনা শেষে এফবিসিসিআই নেতৃবৃন্দ তাদের দাবির তালিকা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়েছেন বলে জানা গেছে। বাজেটে সব ধরনের আমদানির উপর ৫ শতাংশ অ্যাডভান্স ট্যাক্স আরোপ করে এনবিআর। অবশ্য এটি রিটার্ন দাখিল করে ফেরত বা সমন্বয় করা যাবে। আগে কেবল বাণিজ্যিক আমদানি পণ্যে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর দিতে হতো। নতুন এ সিদ্ধান্ত বাজেট ঘোষণার দিন থেকেই কার্যকর হয়। এর ফলে বন্দরে পণ্য ও যন্ত্রপাতি ছাড়ে জটিলতা তৈরি হয়। যন্ত্রপাতি আমদানিতে ১ শতাংশ শুল্কের বাইরে আরো ৫ শতাংশ অ্যাডভান্স ট্যাক্স ছাড়া পণ্য খালাস করা যাচ্ছিল না। কেবলমাত্র রপ্তানির কাঁচামাল (বন্ডের আওতায়) আমদানিতে তা অব্যাহতি ছিল। এতে হয়রানি ও ব্যবসায়ের খরচ বাড়ার শঙ্কায় আমদানিকারকদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে মূলধনী যন্ত্রপাতিসহ বেশ কয়েকটি খাতে অ্যাডভান্স ট্যাক্স প্রত্যাহার হতে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অবশ্য এনবিআর একটি নির্দেশনার মাধ্যমে অগ্রিম কর ছাড়াই এসব পণ্য প্রত্যাহারের সুযোগ করে দিয়েছে।

এছাড়া বাজেটে রড ও স্টিলের পণ্য বিক্রিতে বিভিন্ন ধাপে কর ও ভ্যাট আরোপের ফলে এসব খাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যেও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। রডের কাঁচামাল স্ক্র্যাপ বিক্রিতে টনপ্রতি তিনশ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫ শতাংশ ভ্যাটের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিলেট বিক্রিতে টনপ্রতি ৪৫০ টাকার স্থলে ২ হাজার টাকা ছাড়াও উত্পাদন পর্যায়ে প্রতি টন রডে ৪৫০ টাকার পরিবর্তে ২ হাজার টাকা এবং খুচরা পর্যায়ে রড বিক্রিতে প্রতি টনে ২০০ টাকার পরিবর্তে ৫ শতাংশ ভ্যাট নির্ধারণের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্ক্র্যাপ, বিলেট ও রড বিক্রিতে টনপ্রতি ৩ শতাংশ অগ্রিম আয়কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।

বাংলাদেশ স্টিল মিল্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মনোয়ার হোসেন সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, প্রস্তাবিত বাজেটের এই কর ও ভ্যাট বাস্তবায়ন হলে প্রতিটন রডের দাম ১২ হাজার ৩০০ টাকা বৃদ্ধি পাবে। ফলে খুচরা পর্যায়ে রডের দাম টনপ্রতি বিদ্যমান ৬২ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৭৫ হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকতে পারে। এর ফলে সব ধরনের অবকাঠামোসহ সরকারের উন্নয়ন কাজ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সূত্র জানিয়েছে, রড ও স্টিল জাতীয় পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে ভ্যাট ও করের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হতে পারে।

এফবিসিসিআইয়ের দাবিসমূহ

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই বাজেটে পরিবর্তনের জন্য যেসব দাবি জানিয়েছে, সেগুলো হলো: কোম্পানির কর্পোরেট করহার আড়াই শতাংশ কমানো, গার্মেন্টসহ সব রপ্তানি খাতে একই ধরনের সুবিধা দেওয়া, নগদ প্রণোদনার করহার ১০ শতাংশ থেকে তিন শতাংশে নামিয়ে আনা, রিটেইনড আর্নিংস ও স্টক ডিভিডেন্ডে আরোপিত ১৫ শতাংশ কর সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করা, ট্রেড লাইসেন্স নবায়নে অগ্রিম কর মূল্যস্ফীতির বিবেচনায় নির্ধারণ করা, শিল্পের কাঁচামালের উপর অগ্রিম আয়কর (এআইটি) ৫ শতাংশ থেকে তিন শতাংশে নামিয়ে আনা, মূলধনী যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার, সব ধরনের রপ্তানিতে উেস আয়কর ০.২৫ শতাংশ বহাল রাখা, কর সংক্রান্ত বিরোধের আপিলে দাবিকৃত অর্থের জরিমানার হার কমিয়ে ১০ শতাংশ করা ইত্যাদি।