বেড়েছে বাল্যবিয়ে, শিশুশ্রম, অনলাইন গেইমসের আসক্তি

সৈয়দ মিঠুন, ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধিঃ টাঙ্গাইলের ঘাটাইলেও সারাদেশের মতই করোনায় স্কুল বন্ধ। স্বচ্ছল পরিবার গুলো হঠাৎ করেই অস্বচ্ছল পরিবারে রূপ নিয়েছে। অখিল চন্দ্র পাটি শিল্পের কাজ করেন। আর্থিক কষ্টে আছেন বাবা।

বিষয়টি খেয়াল করে অষ্টম শ্রেণিতে পড়–য়া মেয়ে দ্বীপা। পাটি বুননের কাজ কিছুটা শেখা
ছিল দ্বীপার। টানাটানির সংসারের অভাব দূর করতে দ্বীপা কোমল হাতে শুরু করল পাটি বুননের
কাজ।

শফিকুল ইসলাম ছেলে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র সাজ্জাদ। তিনি জানান, মাস ছয়েক ধরে তিনি খেয়াল করতে ছিলেন শার্টের পকেট থেকে টাকা খোয়া যাচ্ছে। প্রথম দিকে বিষয়টি আমলে না নিলেও যেদিন সাড়ে নয় হাজার টাকা খোয়া যায় সেদিন ছেলেকে ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলেন
বাবা। ছেলের মুখ থেকে গড়গড় করে বেড়িয়ে আসে নয় হাজারের, চার হাজার টাকা খরচ হয়ে গেছে অনলাইন গেইমস ফ্রি ফায়ার খেলে। দিনমজুর বাবার মেয়ে অনিতা। এ বছর নবম শ্রেণিতে পড়েন মেধাবী ও সুশ্রী মেয়ে অনিতা।

ওর স্কুলের শিক্ষকরা জানান, অনিতা ও ক্লাসের কয়েক বান্দবী মিলে শপথ করেছিল, কখনো বাল্য বিয়ে
করবে না তারা। লেখাপড়া করে বড় হওয়ার স্বপ্ন ছিল তাদের। অনিতার বাবা আজমত আলী জানালেন
লেখাপড়া চলবে, এ শর্ত দিয়েই নাকি মেয়েকে তুলে নিয়েছেন বর পক্ষ কিন্তু শর্ত ভেঙ্গে গেছে আর হয়নি লেখাপড়া। দ্বীপা, সাজ্জাদ ও অনিতাদের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ভিন্ন ভিন্ন গ্রামে।

করোনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় কিভাবে শিক্ষার্থীদের সময় কাটছে; শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকরা জানালেন সেসব কথা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও সরকারি নির্দেশনায় চালু রয়েছে অনলাইন ক্লাস। লেখাপড়া ঠিক
রাখাতে অনেক অভিভাবক সন্তানকে স্মার্টফোন কিনে দিয়েছেন।

উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, ব্রিজ-কালভার্ট স্কুল কলেজের বারান্দায় ১০-১২ জন গ্রæপ করে মোবাইল হাতে নিয়ে বসে থাকে। মাঝে মাঝে আবার একা একা কি যেন বলে। তাদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানায়,
গেইমস খেলার এ আড্ডা চলে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। অনলাইনে এ খেলা ভালো পারেন কলেজ পড়–য়া মুক্ত।

তিনি জানান, এই গেইমস খেলতে গেলে ডায়মন্ড কিনতে হয়। পাঁচশ ডায়মন্ডের দাম সাড়ে তিনশ টাকা। খেলার একটি অংশ টপ-আপ। এর পেছনে অনেক খরচ হয়। এটা খুবই
মারাত্মক নেশা, অনেকেই আছে যারা প্রতিদিনই এই টপ-আপ করে থাকে।

উপজেলার হাজিপাড়া ফুলমালিরচালা গ্রামের আয়শা বেগম জানান, তার ছেলে রিফাতের হাতে সবসময় মোবাইল থাকে। ছেলে কি করে তা তিনি বুঝেন না। একই গ্রামের আমির আলী বলেন, এর আগে প্রশাসন থেকে চাপ দিয়ে গেইমস খেলা বন্ধ করা হয়েছিল। আবারও বন্ধ করা দরকার।
ছেলেগুলো বিপথে যাচ্ছে। অপরদিকে করোনায় কর্মহীন হয়ে পড়েছেন অনেক অভিভাবক। সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে অনেক শিক্ষার্থী রাজমিস্ত্রীর সহকারি হিসেবে কাজ করছেন। কেউ কেউ আবার মাসিক বা দিনমজুর হিসেবেও কাজ করছেন।

বন্ধের এই দেড় বছরে অনেক ছাত্রী বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছেন। মাদ্রাসা ও স্কুলের দশজন প্রতিষ্ঠান
প্রধানের সঙ্গে কথা হলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এভাবে চলতে থাকলে ঝরে পড়বে বহু শিক্ষার্থী। এরই মধ্যে অনেকে বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে। উপজেলার আথাইল শিমুল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বাবুর হোসেন চৌধুরী বলেন, বইয়ের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের তেমন
সম্পর্ক নেই। অনলাইনে ক্লাসও তারা দেখে না। এমবি কেনার নামে টাকা নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা পাবজি ও ফ্রি ফায়ার নামক গেইমস খেলায় মশগুল থাকে। করোনার এই বন্ধে শতকরা প্রায় বিশ জন ছাত্রী বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে। অনলাইন ক্লাস উপকারের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হচ্ছে।

উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, করোনার এই সময় সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রতিষ্ঠান প্রধানদের নিয়ে জুম মিটিং করা হচ্ছে এবং কাজ করতে বলা হচ্ছে। শিক্ষকদের শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে নিয়মিত যোগাযোগ করতে বলা
হয়েছে।

অনলাইনে গেইমস খেলে বিপথে যাওয়াকে সামাজিক অবক্ষয় হিসেবে উল্লেখ করে ইউএনও অঞ্জন
কুমার সরকার বলেন, এটা রোধ করতে সমাজ ও পরিবারকে এগিয়ে আসতে হবে।