বঙ্গবন্ধুর সমাজ ভাবনা”

গোপালগন্জের টুঙ্গিপাড়ায় এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ ও বেড়ে উঠা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শৈশব থেকেই ছিলেন জনদরদী,কৃষকদের দুঃখ -কষ্ট খুব কাছ থেকে দেখা ও উপলব্দি  করার সুযোগ হয়েছিল তাঁর। মা,মাটি ও এ’ মাটির মানুষ কে তাঁর ভাবনা তৈরি হয় শৈশব ও কৈশোরেই- এ’ কৃষি কে কেন্দ্র করেই পরবর্তী তে তাঁর  সমাজ ও  রাষ্ট্র চিন্তা গড়ে উঠে। কৈশোরে ছেলে শেখ মুজিবুর রহমানের মানবপ্রেম ও জনদরদী  ভাব গভীরভাবে লক্ষ্য করতেন পিতা শেখ লুতফুর রহমান এবং খুশি হতেন। একবার দেশে খুব খাদ্য সংকট, তখন কিশোর শেখ মুজিব রাতের  আঁধারে লুকিয়ে নিজেদের বাড়ির গোলার সমস্ত ধান বিলিয়ে দেন এলাকার দুঃস্ব,অসহায় ও গরীব মানুষের মাঝে। মানুষের দুঃখ- কষ্ট গভীরভাবে নাড়া দিতো তাঁর হৃদয়ে – মানুষের অধিকার সংরক্ষণ ও আদায়ে সোচ্চার ছিলেন ছোট বেলা হতেই, স্কুল জীবনে গরীব,দুঃখী বন্ধু দের মাঝে নিজের টিফিন  প্রায়শই বিলিয়ে দিতেন, স্কুলের বিভিন্ন যৌক্তিক দাবি আদায়ে সোচ্চার ছিলেন তিনি।মানবতা,মানবিকতা ও পরোপকারীতার আদর্শ কে ধারণ করেই আস্তে আস্তে  টুঙ্গীপাড়ার শেখ মুজিব একসময়   হয়ে উঠেন বাংলার কিংবদন্তি ছাত্রনেতা,সফল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব,একটি জাতির স্বপ্ন দ্রষ্টা ও ইতিহাসের প্রবাদ পুরুষ। সারা জীবন সাধারণ মানুষের কথা ভাবতেন  জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাদের নিকট দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন,সমাজে শ্রেণি বৈষম্য  দূরীকরণে তাঁর চিন্তা ছিলো সুদূরপ্রসারী। বাংলার মানুষের রাজনৈতিক,সামাজিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির পাশাপাশি তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নেও ছিলেন আপোষহীন।সাধারন ও খেটে খাওয়া  মানুষের যৌক্তিক দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ ও দাবি আদায়ে সর্বাগ্রে ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র থাকাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবির প্রতি সমর্থন ও নমনীয়তার  কারনে বিশ্ববিদ্যালয় হতে আজীবনের জন্য বহিষ্কৃতও হতে হয়েছিল তাঁকে,তবুও  মাথা নত করেন নি অন্যায়,অবিচার ও অসত্যের পক্ষে,কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়াকালীন সময়েও  সমসাময়িক বিভিন্ন দাবির প্রশ্নে ছিলেন অবিচল -এ’ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিলো মহাত্মা গান্ধীর ‘ অহিংস ও সত্যাগ্রহ নীতি’ প্রভাবিত হয়েছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু দ্বারাও- বলা হয় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন,চিন্তা ও তাঁর কর্ম বৈজ্ঞানিক ভাবে আরও শ্রেষ্ঠতর ছিলো।১৯৪৭ সালের ১৫ আগষ্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্মের পর হতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর পূর্ব বাংলা ( পূর্ব পাকিস্তান)  শুরু থেকেই থেকেই ছিলো অবহেলিত ও বঞ্চিত-ভাষা- সংস্কৃতি, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সুযোগ ও অধিকার- সবদিক দিয়ে সংখ্যা লঘু পশ্চিম পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠী কতৃক উপেক্ষিত ছিলো – ১৯৪৮- ৫২ পর্যন্ত মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা, ‘৫৪ এর সাধারণ নির্বাচনে জয় কেড়ে নিতে না পেরে যুক্তফ্রন্ট সরকার কে মাত্র ১ বছর ২ মাসের মাথায় বরখাস্ত করা,’৬২ এর বৈষম্য পূর্ণ শিক্ষা নীতির প্রতিবাদ অস্ত্রের মুখে স্তব্ধ করে দেওয়া, ‘৬৬ তে বাঙ্গালি দের বাচার ও  প্রাণের দাবি ৬ দফাকে অস্বীকার, ‘৬৯ তে বঙ্গবন্ধু সহ বাংলার দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার দায়ের করে মৃত্যু দন্ড কার্যকরের হীন চেষ্টা, সর্বোপরি ‘৭০ এর ঐতিহাসিক সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলার মানুষের নিরংকুশ ম্যান্ডেট ছিনিয়ে নেওয়া,সরকার গঠন করতে না দিয়ে তালবাহানা সৃষ্টি সবই করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের জান্তা সরকার, বাঙ্গালির দাবিয়ে রাখার অপকৌশলে ছিলো তাদের ২৩ বছরের শাসনামলে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর অন্যায়,অবিচার ও শোষণ- বঞ্চনার বিরুদ্ধে ছিলেন বজ্রকন্ঠ,গর্জে উঠেছেন,হুংকার ছুঁড়েছেন, বাঙ্গালির অধিকার আদায় করতে গিয়ে বারংবার জেলে কাটাতে হয়েছে তাঁকে – পাকিস্তান রাষ্ট্রের ২৩ বছরের শাসনামলে ১২ বছরই জেলে কাটাতে হয়েছে বঙ্গবন্ধু কে।অবশেষে  পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক সরকার, বর্বর হানাদার ও তাদের এ’ দেশীয় দোসরদের বিরুদ্বে দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয় স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের দেশ।শুরু হয় যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন প্রক্রিয়া – কৃষি কে ভিত্তি  করেই আবর্তিত হয় তাঁর সমস্ত চিন্তা-চেতনা,তাঁর সমাজ পরিবর্তনের ভাবনা।সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর প্রথম মনোযোগ  ছিলো কৃষির প্রতি,যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের মানুষের মুখে দু’বেলা দুমুঠো অন্ন তুলে দেওয়ার প্রয়াসে খাদ্যের যোগান দেওয়া ছিলো জাতির পিতার প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ!  সেজন্য তিনি শুরু হতেই নানা মুখী পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।১৯৭২ সালে রাষ্ট্রপতির বিশেষ আদেশে পরিবার প্রতি জমির মালিকানা ৩৭৫ বিঘা হতে কমিয়ে ১০০ বিঘায় নামিয়ে আনা,২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করার সিদ্ধান্ত নেন জাতির পিতা। কুক্ষিগত জমির মালিকানা মুষ্টিমেয় শ্রেণির হাত থেকে ভূমিহীন, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করেন তিনি,তাদের অনুকূলে বরাদ্দ দেন খাস জমি ও মওকুফ করেন খাজনা।তাঁর আদেশই ব্যবস্থা করা হয় সমবায় পদ্ধতি তে কৃষক দের মাধ্যমে জমি বন্দোবস্তের,কৃষির সমৃদ্ধির  মধ্য দিয়েই তিনি চিন্তা করেন সমৃদ্ধ সোনার বাংলার।বঙ্গবন্ধু আধুনিক ও প্রযুক্তি নির্ভর  কৃষি যন্ত্রপাতি বিদেশ হতে আমদানি ও তা নামমূল্যে কৃষকদের মাঝে বিতরণের ব্যবস্থা করেন,কৃষি উপকরণের দাম সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আনার নির্দেশ দেন।জাতির  পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন প্রজ্ঞাবান রাজনৈতিক – তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলায় মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন, শোষণ ও বঞ্চনামুক্ত ও ন্যায় বিচার ভিত্তিক  ঐক্যবদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলেন আমৃত্যু। ১৯৭২ সালে গঠন করেন।বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, গ্রহণ করেন প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ( ১৯৭৩-‘৭৮)।এ’ পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনার আলোকে দেশে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য হ্রাস এবং মোট দেশজ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেন,কুমিল্লা সমবায় পদ্ধতি কে অনুসরন করে চলতে থাকে তাঁর অনুসৃত নীতির বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া। ১৯৭৫ সালের ২১ জুন রাষ্ট্রপতির আদেশের মাধ্যমে ১৯ টি জেলাকে ভেঙে ৬১ টি জেলা গঠন এবং সেগুলো তে একজন করে গভর্নর নিয়োগ দেন জাতির পিতা। বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু মূলতঃ তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লব তথা দেশের বহুমাত্রিক উন্নয়নের ছক নির্ধারণ করেন। সমাজ ও রাষ্ট্রে সমতা,ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা এবং শোষণ ও বঞ্চনার  বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন জাতির পিতা, কৃষি ও সমবায়ে যুগান্তকারী ও বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনে দেশবাসীকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে শুরু হয়ে যায় তাঁর দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মযজ্ঞ। গঠন করেন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন ( বিএডিসি), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর,  টিসিবি র মতো প্রতিষ্ঠান। কৃষি, সমবায় ও শিল্প বিপ্লব তড়ান্বিত করতে সব জাতীয় করনের ঘোষণা দেন জাতির পিতা। আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষার জন্য গঠন করেন কুদরতে খুদা শিক্ষা কমিশন,সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয় করন করেন,একে একে রাষ্ট্রের সব কাঠামো কে এক ছাদের নীচে নিয়ে এনে দেশের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে এগুতে থাকেন জাতির পিতা,কিন্তু  স্বাধীন বিরোধী চক্র ও দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে ‘৭৫  এর ১৫ আগষ্টে সপরিবারে জাতির পিতা কে নির্মমভাবে হত্যার পর থমকে দাড়ায় বাংলার মানুষের ভাগ্য  বদলের চাকা। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে একটি শোষণমুক্ত,শ্রেণিবৈষম্যহীন,সমতাভিত্তিক ও দরদী সমাজ গঠন এবং ক্ষুধা-দারিদ্র‍্য মুক্ত আধুনিক কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে স্বপ্নের সোনার বাংলা কে গড়তে প্রয়াসী ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

গাজী এমদাদ,

সদস্য, কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক উপ কমিটি,

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাবেক ছাত্রনেতা,

সাংবাদিক, কলামলেখক ও গবেষক।