‘প্রাকৃতিক নিয়মে সুস্থ থাকার উপায়’ শীর্ষক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ আমরা চাইলে নিজেরাই নিজেদের সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারি। কিন্তু তা না করে যথেচ্ছাচার জীবনযাপনে অভ্যস্থ আমরা উল্টাপাল্টা খাবার খেয়ে দেহের বারোটা বাজাই। তারপর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে বলি- ‘ডাক্তার সাহেব, বাঁচান!’ চিকিৎসক তখন কিছু টেস্ট করতে বলেন আর ওষুধের নাম লিখে দেন। আমরা তখন সেগুলো কিনে গোগ্রাসে গিলি আর মনে করি- এতেই বোধহয় সুস্থ হয়ে যাবো। ক’দিন বাদে একটু সুস্থতা অনুভব করলে আবার আগের মতোই আজেবাজে খাবার গলধঃকরণ করতে থাকি। আমরা যদি যার যার মুখের লাগাম টেনে ধরতে না পারি, তাহলে পৃথিবীর কোনো হাসপাতাল বা চিকিৎসক আমাদের সুস্থতা নিশ্চিত করতে পারবেন না!

উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন লেখক ও সুস্বাস্থ্য গবেষক রাজিব আহমেদ। তিনি গত সোমবার (১৭ মে) সকালে দামুড়হুদা হাট সংলগ্ন ডায়াবেটিক হাসপাতাল চত্বরে “প্রাকৃতিক নিয়মে সুস্থ থাকার উপায়” শীর্ষক মুক্ত আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন। পারস্পরিক শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে সুস্বাস্থ্যের বিধি-বিধান মেনে আয়োজিত এই সভায় সভাপতিত্ব করেন দামুড়হুদা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শরীফুল আলম মিল্টন, প্রধান অতিথি ছিলেন দামুড়হুদা উপজেলার প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান মো. ফজলুর রহমান আর বিশেষ অতিথি ছিলেন এখলাছ উদ্দিন সুজন।

রাজিব আহমেদ তাঁর সুদীর্ঘ আলোচনায় মানুষের নিতান্ত অবহেলায় অসুস্থ হওয়ার কারণ ও প্রাকৃতিক নিয়মে সুস্থ থাকার উপায় বাৎলে দেন। তিনি বলেন, এক সময় এই দেশে এতো ডাক্তার, হাসপাতাল, ক্লিনিক কিছুই ছিল না। তবু মানুষ বেশিদিন বাঁচতেন; গড় আয়ু ছিল ১০০-এর কাছাকাছি। কারণ তাঁরা জানতেন কম, কিন্তু মানতেন বেশি। আর এখন জ্ঞান-বিজ্ঞান উন্নত হওয়ার ফলে আমরা অনেক বেশি জানি, কিন্তু সেই তুলনায় মানি খুবই কম। ফলে গড় আয়ু ৭০-এর নিচে নেমে এসেছে। আরো নির্মম সত্য হচ্ছে, ৪০-এর পর থেকেই বাকি জীবনটুকু কাটছে ওষুধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে।

রাজিব আহমেদ বলেন, পবিত্র কোরআন-এর একাধিক আয়াতে মানুষের খাদ্যের সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। পবিত্র কোরআনে মানুষের খাবার হিসেবে পানি, দুধ, মধু, মাছ (তাজা, নরম, মাংসল), নানা রঙের সুস্বাদু ফলমূল (খেজুর, আঙুর, জলপাই, ডালিম, জলপাই, কুল, কলা), বীজ, নানা ধরনের খোসা আবৃত শস্যদানা, সুগন্ধি লতাগুল্ম, নানা বর্ণের ফসল (তৃণলতা, শাকসবজি ও তরকারি, শসা, গম, রসুন, ডাল, পেঁয়াজ) এবং আল্লাহ্’র নামে জবাই করা তৃণভোজী সকল গবাদি পশু ও পাখির মাংস-এর কথা উল্লেখ রয়েছে। আবার মৃত প্রাণী (বিশেষ পরিস্থিতিতে ব্যতিক্রম আছে), রক্ত, শুকর, মদ ও মাদকদ্রব্য কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ঘুম থেকে জেগে প্রথমেই বাসীমুখে দুই গ্লাস হালকা কুসুম গরম পানি (লেবুর রস ও সামান্য মধু মিশিয়ে নিলে আরো ভালো) পান করুন। তারপর মেডিটেশন/প্রাণায়াম করুন। দমচর্চা বা হলো মস্তিষ্কের ‘কুলিং সিস্টেম’আর মন-এর ‘ক্লিনিং সিস্টেম’। প্রতিদিন অন্তত ১০ মিনিট হাঁটবেন, ১০ মিনিট দৌড়াবেন এবং ১০ মিনিট শরীরে সূর্যের আলো/তাপ লাগাবেন। নাস্তার টেবিলে ভরপেট খান। তবে ভাত, রুটির বদলে দেশীয় মৌসুমী ফলমূল দিয়ে পেট ভরার চেষ্টা করুন। নাস্তার পরে/ফাঁকে এক কোয়া রসুন, একটু কাঁচা হলুদ, এক টুকরো আদা আর সামান্য কালোজিরা খেতে ভুলবেন না।

কোনো অবস্থাতেই তেল, চিনি খাবেন না। টিনজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার, মিষ্টি, বিশেষত রঙ দেওয়া মিষ্টি এবং টেস্টিং সল্টযুক্ত খাবার সম্পূর্ণ বর্জন করুন। বাড়িতে প্রেসার কুকার আর মাইক্রোওভেন থাকলে আজই বাতিল করে দিন। বাসী খাবার খাবেন না। যতবার পানি পান করবেন, অবশ্যই পরিষ্কার ফুটানো পানি বসে পান করতে হবে। কখনোই ঠান্ডা পানি পান করবেন না। খুব ভালো হয় সব সময় সহনশীল মাত্রার কুসুম গরম পানি অথবা স্বাভাবিক তাপমাত্রার পান করতে পারলে।

যখন যে ফলের মৌসুম, অবশ্যই সেই ফল একটিবারের জন্য হলেও খাবেন। আল্লাহ্ এমন কোনো রোগ সৃষ্টি করেননি, যার প্রতিষেধক নেই। মানুষের কাজ সেটা খুঁজে নেওয়া (পৃথিবীতে যে ফল শরীরের যে অঙ্গের মতো দেখতে, সেই ফল সেই অঙ্গের হেফাজতকারী)! আম, কাঁঠাল, আনারস, চালতা, জাম্বুরা, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, বেল, জাম, জামরুল, শরিফা, কলা, লিচু, আমড়া, কামরাঙ্গা, আমলকি অর্থাৎ দেশি মৌসুমী ফল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

দুধ পৃথিবীর সবচেয়ে পুষ্টিকর খাবার। প্রতিদিন এক গ্লাস দুধ পান করুন। মুসা নবীর প্রশ্নের জবাবে আল্লাহ্ সুবহানুতায়ালা দুধ পানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। চিনি ছাড়া টক দইও খেতে পারেন। পুষ্টির জন্য নিয়মিত একটি বা দু’টি ডিম সিদ্ধ করে খান।

বিজ্ঞাপনযুক্ত খাবার পরিহার করে বিজ্ঞানসম্মত খাবার খান। যখনই খাবেন, পাকস্থলীর কিছু অংশ যেন ফাঁকা থাকে। মহানবী (সা.) খাদ্য গ্রহণকালে পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ পানীয় দ্বারা পূর্ণ করে এক-তৃতীয়াংশ শক্ত খাবার এবং বাকি এক-তৃতীয়াংশ খালি রাখতেন। খাবার গ্রহণের ২০ মিনিট আগে প্রথমে পানি পান করে নিন এবং খাওয়ার ২০ মিনিট পরে লেবুর রসসহ পানি পান করুন।

প্রতিদিন সালাদ খান। সালাদ-এ লেটুস, টমেটো, গাজর, শসা, ক্যাপসিকাম, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা, লাল বাঁধাকপি ব্যবহার করুন। শীতকালে নিয়মিত পালং শাক, ব্রোকোলি ও গাজর খাবেন। সালাদে অবশ্যই সিরকা (ভিনেগার) মিশিয়ে নেবেন। প্রতিদিন ডাল রান্না করুন। সম্ভব হলে মসুরি ডাল, মুগ, মাষকলাই, বুট, মটর, অড়হর ডাল একসঙ্গে মিশিয়ে রান্না করুন। যখনই কিছু খেতে মন চাইবে, গরম মশল্লা (দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, গোলমরিচ) চিবুবেন।

সপ্তাহে দু’দিন শুধু নিরামিষ খান; মাংস মাসে চারদিনে সীমিত রাখতে সচেষ্ট থাকুন। গরু-ছাগলের মাংস খাওয়া বাদ দিয়ে গরু-ছাগল যা কিছু খেয়ে বেঁচে থাকে, আপাতত আপনিও সে রকম শাক-সবজি, লতা-পাতা খেয়ে জীবনধারণ করুন। তবে ক্ষুধা না লাগলে খাবেন না আর কিছুটা ক্ষুধা অবশিষ্ট থাকতেই খাদ্যগ্রহণ শেষ করবেন!

দাঁতের কাজ পাকস্থলীকে দিয়ে করাবেন না। কমপক্ষে দশবার চিবিয়ে প্রতি লোকমা খাবার খান, হজম প্রক্রিয়া সহজতর হবে! সব সময় খাবার খাবেন পান করে আর পানি খাবেন চিবিয়ে! মানে খাবারকে চিবাতে চিবাতে মুখের মধ্যেই তরল বানিয়ে ফেলেবেন।