পদ্মা সেতু এবং খুলনার মানুষের গল্প

আলী কদর পলাশ

আচ্ছা, খুলনার মানুষের সবচেয়ে বড় কষ্ট্ কী?

হেলাল হাফিজ হলে বলতেন – ’লাল কষ্ট নীল কষ্ট, কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট, পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট, আলোর মাঝে কালোর কষ্ট’। কিন্তু কাব্য দিয়ে তো খুলনার মানুষের কষ্টের সংজ্ঞা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। তাদের হৃদয়ে যে গভীর দীর্ঘশ্বাস। বেদনার বাতাস। নি:শ্বাসে প্রশ্বাসে সেই কষ্ট থেকে শুধুই বের হয়ে আসে -পদ্মার উপর সেতু। স্বপ্নের পদ্মা সেতু।

দৈনিক জন্মভূমি পত্রিকা অফিসের পাশের মুদি দোকানী সামাদ মিয়া সেদিন সে কথাই বলছিলেন। ক’দিন আগে জরুরী কাজে ঢাকায় যেতে তার লেগেছে ২২ ঘন্টা। আটকে ছিলেন মাওয়া ফেরিঘাটে। শুধু খুলনা নয়; দক্ষিণবঙ্গের ২১টি জেলার মানুষের এই একই কষ্ট। কিন্তু সেই কষ্টের সকল কল্পনা-জল্পনা আর হতাশার অবসান ঘটিয়ে পদ্মার বুক চিড়ে যেদিন সত্যি সত্যিই মাথা তুলে দাঁড়ালো স্বপ্নের সেতু, সেদিন তাদের চোখে যে আনন্দের আলোকরেখা তা কি দেখেছেন কেউ?

দিনটি ছিল ৩০ সেপ্টেম্বর শনিবার। সূর্য মাথার ওপর উঠার আগেই শরীয়তপুরের জাজিরায় পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্য দিয়ে সকল দুঃসপ্নের অবসান হল। সেদিন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্ব ব্যাংক অর্থায়ন আটকানোয় অনিশ্চয়তায় পড়েছিল পদ্মা সেতু। নিজস্ব অর্থায়নে কাজ শুরুর পর সেই সেতুর প্রথম স্প্যান বসানোর খবর শুনে আনন্দে কেঁদেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার আদরের ছোট বোন রেহানা।

এই কান্নার পেছনের কথাগুলো আমাদের বড় বেশি মনে রাখা দরকার। অবহেলিত জনপদের উন্নয়নের মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে একদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন পদ্মা নদীর উপর একটা সেতু বানাবেন। কিন্তু টাকা কোথায়? ছোট্ট দেশের নিজস্ব অর্থায়নে এত বড় একটা সেতু নির্মাণ করা তো সম্ভব নয়। তারপরও তিনি স্বপ্ন আর সাহস নিয়ে পথে নামলেন। আড়ালে থেকেই যেন মহামতি পিতা তাঁকে সাহস দিচ্ছিলেন। পিতা যেমন নিরন্ন-নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র হওয়ার মন্ত্রে দীক্ষা দেন, স্বাধীনতার আকাঙ্খায় উজ্জীবিত করেন, অনেকটা তেমন।

সে সময় প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন ভাষণ ও বক্তৃতা শুনে, বিভিন্ন লেখা পড়ে আমরা সহজেই অনুধাবন করতে পারি, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর আপসহীন লড়াই-সংগ্রাম, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মত্যাগ এবং পিতার মতো জনগণের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসাই তাঁর সব কাজের মূল প্রেরণা, এবং সততা তাঁর প্রধান শক্তি। সেই শক্তিতেই পদ্মা সেতু হবে– নিজেদের অর্থের সঙ্গে বৈদেশিক ঋণসহায়তা যুক্ত করে। বিশ্বব্যাংকসহ আরও কয়েকটি দাতা সংস্থা পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়নে প্রবল আগ্রহে এগিয়ে আসে। ঋণচুক্তি হয় যথা নিয়মে। প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রারম্ভিক কাজও পুরোদমে শুরু হয়।

অবিরাম গতিতে প্রস্তুতিমূলক কাজ প্রায় শেষ। এমন সময়ে সংবাদ রটানো হল পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে। যে প্রকল্পে দুর্নীতি হয় সে প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করে না। চমৎকার সব নাটকীয় কাহিনির জন্ম। বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। বিশ্বব্যাংক ঋণ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। সরে দাঁড়ায় অন্য সংস্থাগুলোও। ‘ছিঃ ছিঃ’ রব চারিদিকে। মুখ দেখানো যেন মুশকিল। সরকারবিরোধী কতিপয় সুশীল মৌ-লোভী আর মিডিয়াবাজ বুদ্ধিজীবী রীতিমতো হুমড়ি খেয়ে পড়লেন। পারলে সরকারের ১২টা বাজিয়ে ছাড়ে!

কিন্তু কালের পরিক্রমায় আজ প্রকৃত সত্য বেরিয়ে এসেছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনো দুর্নীতি হয়নি কিংবা দুর্নীতির প্রয়াস ছিল না। এটা ছিল ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সেই পুরনো শকুন স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের এক গভীর ষড়যন্ত্র। আনন্দের বিষয় যে, কিছুদিন আগে কথিত ভুয়া দুর্নীতির অপমানজনক অপবাদ থেকে বাংলাদেশ সরকার তথা এ দেশের জনগণ মুক্ত হয়েছে। কানাডিয়ান আদালত খালাস দিয়েছে তিন কথিত অভিযুক্তকে। আর দুর্নীতি তদন্তে যিনি ছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান সেই ওকাম্পোর বিরুদ্ধেই ফাঁস হয়েছে প্রায় ৪০ হাজার দুর্নীতির নথি। তাই শুধু কাঁদেন নি হাসিনা-রেহানা, কেঁদেছে খুলনার মানুুষ। গোটা বাঙলার মানুষ।

বাঙালির এক অবিস্মরণীয় জয়ের নাম পদ্মা সেতু, বিশেষ করে খুলনাসহ দক্ষিণবঙ্গের ২১টি জেলার জনগোষ্ঠীর কাছে। বলা যায় হাজার বছরের স্বপ্ন -পদ্মা সেতু। আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতে বঙ্গবন্ধু সেতু কি কি ভূমিকা রাখছে তা আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। সকলের কাছে আজ প্রমাণিত। কাজেই যমুনা নদীর উপর নির্মিত বঙ্গবন্ধু সেতুর মতোই পদ্মা নদীর উপর নির্মিতব্য পদ্মা সেতু হলে জনজীবনে কী উন্নয়ন হবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

দেশের দক্ষিণবঙ্গের যোগাযোগ ব্যবস্থা এক মহা বিড়ম্বনার শিকার বহুকাল ধরে। যারা বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি পড়েছেন। তারা সহজেই অনুধাবন করতে পারবেন সেই বিড়ম্বনার ব্যাপ্তি ও গভীরতা। ’মাদার অব হিউম্যানিটি’ জননেত্রী শেখ হাসিনা, তিনি শুধু দেশের প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি জাতির পিতার কন্যা, দেশরতœ শেখ হাসিনা। যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মুক্তি কিভাবে সম্বভ তাঁর চেয়ে বেশি কে আর হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারেন!

রাজধানী ঢাকা আসতে-যেতে খুলনার মানুষের যাত্রাপথে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে কেবল পদ্মা পার হতেই। উৎসব-পার্বণের সময় ফেরি নষ্ট যানজটসহ তাদের ভোগান্তির কোন শেষ নেই। প্রায়ই নদী পার হওয়ার সময় লঞ্চডুবিতে মারা যায় মানুষ। পারাপারের ভাড়া নিয়ে চলে নৈরাজ্য, ঘাটে ঘাটে হতে হয় নিগৃহীত। নানা ধরনের হয়রানিতে মানুষ হয়ে পরে পুরোপুরি জিম্মি। এসব হয়রানির শিকার মানুষদের প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ‘পদ্মা সেতু হোক, তারপর…….। সেই বেদনার রঙে নীল হয়ে য্ওায়া মানুষের মনে আজ সত্যিই আশার সঞ্চার হয়েছে।

আর তো মাত্র বছর তিনেক। তারপর। তারপর খুলনাসহ দক্ষিণবঙ্গের অর্থনীতির সূচক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেই হিসেব কষবেন অর্থনীতিবীদরা। মোটাদাগে আমরা বলতে পারি ৪২ টি পিলারের ওপর ভর করে নিশ্চয়ই বদলে যাবে খুলনার জীবন। বাংলাদেশের মানুষের জীবনমান। ড: আকবর আলী খানের অর্থনীতির এই সাহিত্য নিয়ে অর্থনীতিবিদরা আড্ডা জমাবেন। তাদের সেই সাহিত্যে খুলনার মানুষের কাহিনী কতোটুকু জায়গা পাবে জানি না। তবে খুলনার একেবারে কাছে এসে যাবে রাজধানী ঢাকাসহ গোটা বাংলাদেশটা। কিন্তু সম্পর্ক নদীর জলের মতো বাঁক নেয়, তাই আগামীতে কোনদিকে বাঁক নেবে সে কথা জানাবে ভবিতব্য। তবে পদ্মা সেতুর নিচে যে জল বইছে সেটা যেন স্বাতীনতা বিরোধী চক্রের কারণে ঘোলা না হয়ে যায় তার দিকে খেয়াল রাখা দরকার। ’একখানি ছোটো খেত, আমি একেলা, চারি দিকে বাঁকা জল করিছে খেলা।’

প্রথম প্রকাশের তারিখ : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৭,

** (পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানোর দিন দৈনিক জন্মভূমির নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন করাকালীন বিশেষ সম্পাদকীয় হিসেবে এটি প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়)

**দৈনিক এই আমার দেশ পত্রিকার ২৪/২৪ দিলকুশা, মতিঝিল অফিসে সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে ছবিটি তোলা। ছবিটি তুলেছেন ফটো সাংবাদিক ফাহাদ হোসেন

দৈনিক এই আমার দেশ পত্রিকার ২৪/২৪ দিলকুশা, মতিঝিল অফিসে সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকালে ছবিটি তোলা। ছবিটি তুলেছেন ফটো সাংবাদিক ফাহাদ হোসেন