নিক্সনের চায়ের দাম

Razibul Bari Palash

এত সুন্দর চায়ের কাপ তিনি আগে কোনোদিন দেখেননি। দেখবেন কীভাবে? আমেরিকান। – তাও আবার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে দেয়া চা। ভালোই হল; ব্রেইনে কিছু ক্যাফেইন আর গ্লুকোজ চালান দিলে সব কথা গুছিয়ে বলা যাবে। চায়ে চুমুক দিলেন তিনি। মজাটাও সেইরকম। শীতাতপ কক্ষ। তবু ঘামছেন সর্দার শরণ সিং। আলাপ শুরু হবার পরে কখন শেষ হল তা তার মনে নেই। শুধু মনে হচ্ছে ‘আলোচনা সফল’।
.
শরণ নাকি মরণঃ
সফর শেষে পালাম বিমানবন্দরে ভারতের মাটিতে পা ছোঁয়ালেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সংবাদ সম্মেলনে ‘আলোচনা সফল’ বলার সাথেসাথেই মুখে উন্নত কাঠ-পোড়ানো আমোচনীয় একগাদা ছাই লেপে দিলেন এক সাংবাদিক। চোখের সামনে তুলে ধরলেন গতকালের নিউইয়র্ক টাইমস। তাতে লেখা এই তো সেদিন পাকিস্তানের পতাকাবাহী বড় দুইটি অস্ত্রভর্তি কার্গো অ্যামেরিকার বন্দর ছেড়েছে। আলোচনা যদি সফলই হবে তবে আপনি সেখানে থাকা অবস্থায় কীভাবে অস্ত্রচালান রওনা দেয়?! শরণ সিং কিছু আর স্মরণ করতে পারছিলেন না। পায়ের জুতা ঢিল ঢিল লাগছিল।
.
অ্যামেরিকায় ভারতের রাষ্ট্রদূতকে খবর নিতে বললেন। (এনার সম্পর্কে সেদিন পার্লামেন্টে বিরোধী দলের রাজনারায়ণ বাবু বলেছেন ‘শুধু ভালো খাওয়া আর ভালো নৃত্য জানেন বলেই নাকি উনি অ্যামেরিকার রাষ্ট্রদূত হতে পেরেছেন’)। শরণ শিং এর মেজাজ খারাপ।
নিউজটা জুনের ২২ তারিখের। ২৩ তারিখ জানা গেল ইউ এস সরকার বলেছে চুক্তি অনুযায়ী ২৫ মার্চের পরে পাকিস্তানের কাছে কোন অস্ত্র তারা বিক্রি করেনি। তাহলে এগুলো? উত্তরে তারা বলে – ‘এগুলো ২৫ তারিখের আগের অর্ডার দেয়া।’ তারা আরও যোগ করেন, ‘এখানে ৮ টা যুদ্ধবিমানও ছিল যা পত্রিকায় লেখেনি।’ সাবাস অ্যামেরিকা, সাবাস কূটনীতি।


.
শোনা খবরঃ
সন্ধ্যায় পার্লামেন্টে গেলেন শরণ সিং। জানিনা আজ বিরোধীদল কীভাবে কানের ময়লা পরিষ্কার করবে। সামুরাই নিয়ে শুরু করলেন বিরোধী দলের সদস্য শ্রী চিত্তরঞ্জন বসু। জানালেন মার্চ পর্যন্ত আমেরিকান এয়ারফোর্স ও নেভি পাকিস্তানের কাছে প্রায় ৪৮ মিলিয়ন ডলার সমমানের অস্ত্র সাপ্লাই দিয়েছে। এগুলো সবই ২৫ মার্চের বাংলাদেশের ক্র্যাক ডাউনের জন্য বরাদ্দ ছিল। অথচ আমরা ২৩ জুন পর্যন্ত তার কিছুই জানিনা!!
.
কাগজের হিসাবঃ
তর্কে তর্কে জানা গেল মার্কিন সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ বলেছেন যে, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের আদেশে আরও ৩ কোটি ৫৫ লক্ষ ডলার মূল্যের সমরাস্ত্র পাকিস্তানে পাঠানো হচ্ছে। ৮ জুলাই পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র বলেছেন, “গত পাঁচ অর্থবছরে গড়ে প্রতিবছর ১০ মিলিয়ন ডলারের অস্ত্র অ্যামেরিকা থেকে পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে। সবাইকে সমর্থন দিয়ে শরণ সিং নিজেও যোগ করেন ১৯৫৪ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত অ্যামেরিকা ১৭০০ থেকে ২০০০ কোটি ডলার মূল্যের অস্ত্র সরঞ্জাম পাকিস্তানে পাঠিয়েছে।
.
ঐকিক নিয়মঃ
মুখ খুললেন আরেক তুখোড় বক্তা শ্রী কুলকার্নি। তিনি জানালেন এপর্যন্ত ১ কোটি শরনার্থির জন্য মাত্র ১২ কোটি রুপি বিদেশী সাহায্য পাওয়া গেছে – এ দিয়ে কয় বেলা খাওয়ানো সম্ভব? ভারতের জনগণের উপর ৫% করারোপ বাড়ানো হয়েছে। এভাবে চললে ভারতের অর্থনীতি শেষ হয়ে যাবে। দ্রুত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিন। সরকারী দলের একজন বলেছেন নিজস্ব স্বাধীন ভূখণ্ড লাগবে। অথচ ১৯০৩ সালে অ্যামেরিকা নিজেই পানামাকে স্বীকৃতি দিয়েছিল যখন পানামার এক ইঞ্চি জায়গা তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল না। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এরকম অনেক রাষ্ট্রকে অ্যামেরিকা স্বীকৃতি দেয়।
.
যে ভুল পাকিস্তান করেনিঃ
ভারত যখন পার্লামেন্টে বসে স্বীকৃতি নিয়ে ঝগড়া করছিল পাকিস্তান তখন কি করছিল জানেন?
১। সে পূর্ব-পশ্চিমে দুইটা নতুন ডিভিশন আর্মিকে অস্ত্রসাঁজে সজ্জিত করেছে। সাথে চাইনিজ মিলিটারি হার্ডওয়্যার। এটা দ্রুততম সময়ে করার জন্য পাকিস্তান ডিভিশনগুলোকে এক তৃতীয়াংশ ট্রেইন্ড সৈন্য আর দুই তৃতীয়াংশ নতুন সৈন্য দিয়ে মিশিয়ে ফেলেছে।
২। পাকিস্তান সবচেয়ে কম সময়ের মধ্যে ফ্রান্স থেকে দুই স্কোয়াড্রন ফাইটার বোমারু বিমান পাচ্ছে।
৩। পাকিস্তান শিগগিরই তার চতুর্থ সাবমেরিন পাচ্ছে।
৪। পাকিস্তান আগামী দুই মাসের মধ্যে ন্যাটো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ইরান ও তুরস্ক থেকে অস্ত্রের শপিং সম্পন্ন করার সুযোগ পাচ্ছে।
৫। পাকিস্তান তার বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীর বাংলাদেশী অফিসার ও কর্মিদের প্রতিস্থাপন করার সময় পাচ্ছে। এদের বাদ দিয়ে এই সময়ে নিজেদের লোক বসাচ্ছে।
৬। পাকিস্তান বাংলাদেশে অবাঙালিদের মধ্যে থেকে সশস্ত্র মিলিশিয়া, প্যারা মিলিশিয়া, পুলিশ বাহিনী এবং পাল্টা গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলার জন্য সময় কাজে লাগাচ্ছে।
৭। বর্তমানে নৌপথ বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান সরবরাহ। তারা এই সময়ে রেল ও সড়ক যোগাযোগ পুনরূদ্ধারের জন্য ক্ষিপ্ত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
৮। পাকিস্তান চীন থেকে চীনা গানবোট এবং কয়লা পাচ্ছে।
৯। পাকিস্তান বাংলাদেশে মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামীর মত আরও দল তৈরি করছে যারা বাংলাদেশে তাদের পুতুল সমর্থন দেবে।
১০। তারা খাদ্য ঘাটতি বৃদ্ধি করে এবং দুর্ভিক্ষের অবস্থা তৈরি করে আরও মানুষকে বাংলাদেশ থেকে ভারতে পাঠাবার সুযোগ পাচ্ছে। এতে ভারত নিজেকে নিয়ে আরও ব্যাস্ত হয়ে পড়বে।
১১। অ্যামেরিকার ৭২ সালের জাতীয় সহায়তাদান পরিকল্পনায় ছিল প্রায় ৫২ কোটি ডলারের সমরোপকরন পাকিস্তানকে দেয়া হবে। (যদিও ততোদিনে আমরা স্বাধীন)
ভারত যখন টালমাটাল – পাকিস্তান আর অ্যামেরিকা তখন মাথা ঠাণ্ডা করে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু বীর বাঙ্গালী সেই সময় দেয়নি। দুর্ধর্ষ গেরিলা যুদ্ধ দিয়েই একটার পর একটা অঞ্চল মুক্ত করেছে। হোক না কোন অঝোর বর্ষা, লক্ষ্মীন্দর অমাবস্যা অথবা মৃত্যুশীতের কুয়াশা চাদর – বাঘের গর্জনে লড়াই করেছে আমাদের যুদ্ধপুরুষ। নিয়ে এসেছে বিজয়। আমাদের বিজয়ের কথা যদি আমরা মনে রাখতে নাও পারি; যারা হেরেছিল তারা এই বিষকামড় ভুলতে পারবেনা।
এখনো প্রতিনিধি হিসেবে গিয়ে নিক্সনের সেই সুন্দরতম চায়ের কাপে চুমুক দেয় কোন বাঙলা মায়ের সন্তান। নিক্সনের উত্তরসূরিরা সেটা যখন চেয়ে চেয়ে দেখে কেমন লাগে তাদের জানিনা – তবে সেটা কল্পনা করতেই নিজের সত্ত্বা আমি টের পাই। টের পাই দেশের জন্য যারা জীবন দিয়েছেন তাদের বিজয়োল্লাস।
জয় বাংলা।
.
Written by Razibul Bari Palash
Photo: Richard Nixon -37th US President [1969-1974] and Kissinger (National Security Advisor)