নাটোরে ঔষধি গ্রামে বছরে আয় ১৫ কোটি টাকা

সালাহ উদ্দিন, নাটোর :
উত্তরবঙ্গের রাজশাহী বিভাগের ছোট্ট একটি জেলা নাটোর। নাটোর জেলার সদর উপজেলা ৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে গঠিত। মাত্র ২২৭ বর্গকিমি আয়তনের এই সদর উপজেলার কৃষি কর্মকান্ড বৈচিত্রে ভরা। কেননা এই উপজেলার জলবায় ও মাটি বিভিন্ন ধরণের শাকসবজি,ফলমূল ও ঔষধিগাছ চাষের জন্য অত্যন্ত উপযোগী। আবার নাটোর সদর উপজেলার একটি ইউনিয়ন হল লক্ষিপুর-খোলাবাড়িয়া। এই ইউনিয়নটি ইতোমধ্যেই খ্যাতি পেয়েছে দেশের একমাত্র ঔষধি গ্রাম হিসেবে। প্রায় ২২ হাজার মানুষের বসবাস এই ইউনিয়নে। গ্রাম ১৫টি। এক সময় এই এলাকার মানুষ কৃষি কাজ করে অতি কষ্টে দিনাতিপাত করলেও মাত্র ২৬ বছরে পাল্টে গেছে এলাকার চেহারা। পরিবর্তন এসেছে বাড়ি-ঘর,এলাকার রাস্তাঘাট আর মানুষের জীবনধারায়। আর এর প্রধান কারণ ভেষজ সামগ্রী উৎপাদন ও বিক্রি ।

চাষাবাদের জমি থেকে শুরু করে গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আনাচে-কানাচেই এখন চাষ হচ্ছে ঔষধি গাছ। মোড়ে মোড়ে ওই ভেষজ সামগ্রী বিক্রির দোকান। প্রতিদিনই গ্রামে ভীর করছে ফরিয়া,পাইকারী আর খুচরা ক্রেতা-বিক্রেতা। আসছে ট্রাক। প্রতিদিন কিনে নিয়ে যাচ্ছে এ্যালোভেরাসহ বিভিন্ন ভেষজ সামগ্রী। শুরুতে গ্রামের মানুষ নিজেরাই জমিতে শ্রমিকের কাজ করলেও এখন তারা জড়িত ওই সব ভেষজ সামগ্রী উৎপাদন আর বাজারজাত করণে। আর তাদের জমিতে প্রতিদিন কাজ করতে আশে-পাশের এলাকা থেকে আসছে প্রায় ৪শ শ্রমিক। জেলা কৃষি বিভাগের হিসেবমতে, এই এলাকার উৎপাদিত ভেষজ সামগ্রী বিক্রি করে স্থানীয় কৃষকরা প্রতি বছর আয় করছেন প্রায় ১৫ কোটি টাকা।

গ্রামবাসীরা জানান,১৯৯৫ সালের দিকে আফাজ পাগলা নামে এই গ্রামের এক অধিবাসী ভেষজ সামগ্রী দিয়ে কবিরাজি চিকিৎসা করতেন। সুনাম ব াড়ার সাথে সাথে চিকিৎসার চাহিদা বেড়ে যাওয়া আর দূর-দূরান্ত থেকে ভেষজ সামগ্রী নিয়ে আসার ঝামেলা এড়াতে তিনি বাড়ির আশে পাশে নিজ প্রয়োজনেই চাষাবাদ শুরু করেন বিভিন্ন ভেষজ সামগ্রী। এক পর্যায়ে চিকিৎসার প্রয়োজন মিটিয়ে তিনি ওই অতিরিক্ত ঔষধি গাছ,লতা,শেকর ইত্যাদি বিক্রি করে বাড়তি আয় করতে থাকেন। তার দেখা-দেখি ও উৎসাহে স্থানীয় কৃষকরাও শুরু করেন ভেষজ গাছ উৎপাদন আর বাজার জাত করণ। ধানসহ বিভিন্ন কৃষি ফসলের তুলনায় অধিক মুনাফা হওয়ায় ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ভেষজ উৎপাদনকারী কৃষকের সংখ্যা। কালক্রমে এখন পুরো লক্ষিপুর-খোলাবাড়িয়া ইউনিয়নের খোলাবাড়িয়া,কাঁঠালবাড়িয়া,গাজীপুর,চৌরী,ইব্রাহিমপুরসহ ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামেই এখন চাষাবাদ হচ্ছে বিভিন্ন ধরণের ভেষজ উদ্ধিদ।

সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের তথ্যমতে,এই এলাকায় বর্তমানে প্রায় ১৪০ প্রজাতির ভেষজ উদ্ধিদের চাষাবাদ করা হয়। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হল,ঘৃতকুমারী,শিমুল মূল,অশ্বগন্ধা,মিশ্রিদানা,শতমূল,কালোমেঘ,হস্তীপলাশ,আমলকী,হরিতকি,বহেরা,ওলটকমল,অর্জুন,বেল,ভুঁইকুমড়া,আলকুচী,পিপলটি,দাওদমণি,সোনাপাতা,ডালমূল,কস্তরীদানা,শিলাজত,তেঁতুল ও ঘৃতকা ন,ভাই চন্ডাল,পাথর কুচি,রক্ত চন্ডাল,লজ্জাবতী,আকন্দ,আলকুশি,স্বর্ণগন্ধা,শংখমুল,ঈশ্বরমূল,তেজবল,আপাং ও অনন্তমূল।

সরেজমিনে ওই ঔষধিগ্রাম ঘুরে দেখা যায়,রাস্তার উভয়পাশে বাড়ির আনাচে-কানাচে শোভা পাচ্ছে এ্যালোভেরা,শতমূল,লজ্জাবতি,নিমসহ নানা গাছ। তবে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও বেশি চাষাবাদ দেখা গেছে এ্যালোভেরা।
স্থানীয় কৃষকরা জানান, প্রতি বছর ডিসেম্বর থেকে ফেব্রæয়ারী মাস পর্যন্ত রোপন করা হয় এ্যালোভেরা। এক বিঘা জমিতে প্রায় ১২ হাজার চারা রোপন করা হয়। ৩ মাস পর থেকেই শুরু হয় পাতা সংগ্রহ।চাষাবাদ,পরিচর্যা আর সেঁচ দিতে বিঘাপ্রতি বছরে প্রায় ১শ শ্রমিক প্রয়োজন হয়। এ্যালোভেরা চাষে জৈব সার ছাড়াও পরিমাণমত

ইউরিয়া,টিএসপি,এমওপি,জিপসাম,দস্তা ও বোরিক এসিড দেয়া হয়। এছাড়া পাতার কালোদাগ দূর করতে দেয়া হয় চুন।কীটনাশক হিসেবে টাইকোডার্মা ও সেক্স ফেরোমেন ব্যবহার করেন তারা।
কৃষক আবুল জানান, এক বিঘা জমিতে শিমুল চাষ করতে তাদের গড়ে খরচ হয় ১৫-১৬ হাজার টাকা। উৎপাদিত মূল বিক্রি হয় বাজার দামের তারতম্যভেদে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা। এছাড়া এক বিঘা এ্যালোভেরা চাষ করতে তাদের খরচ হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা। উৎপাদিত পাতা বিক্রি হয় দেড় লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকা। সকল খরচ বাদে বিঘাপ্রতি ভেষজ চাষে তাদের গড়ে প্রায় /৮০-৯০ হাজার টাকা লাভ হয় বলেও দাবী করেন তিনি।

ঔষধিগ্রামের হেকিম তথা কবিরাজ শামসুজ্জামান বলেন,ঘৃতকুমারী গাছের পাতার শাস বলকারক,শক্তিবর্ধক ছাড়াও সর্দি নিবারকে ব্যবহৃত হয়। শিমুল পাতা,মূল ও আঠা বলকারক ও ফুল শ্বেতপ্রদাহে ব্যবহৃত হয়। মিশ্রিদানা গ্যাষ্ট্রিক আমাশয় নিবারণ করে,বাসক পাতার রস খেলে সর্দি,কাশি ও জ্বর ভাল হয়। গন্ধভাদাল পাতা ও কান্ড হজমকারক ও পেটের পীড়ায় কাজ করে,তুলসী পাতা জ্বর ও সর্দি সাড়াতে কাজ কওে, পিপুল পাতা প্রস্রাবের জ্বালা কমায় ছাল দিয়ে হালুয়া তৈরী হয়,পাথরকুচি আমাশয় ও বদ হজমে কাজ করে,ডুমুর ফল ডায়াবেটিক নিবারক,তেঁতুল রক্তের কোলস্টেরল কমায় ,অর্জুন পাতা ও ছাল হার্টের রোগ সারায় এছাড়া নিম পাতা,ছাল ও বীজ কৃমি নাশক,পচড়া নিবারক ও রক্ত পরিস্কারক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

ঔষধিগ্রাম সম্পর্কে জানতে চাইলে, নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক(ভারপ্রাপ্ত) ইয়াছিন আলী বলেন,ঔষধিগ্রামে গাছ উৎপাদক রয়েছেন ৯৫০ জন। এছাড়া বীজ সরবরাহকারী ১৫ জন,চারা উৎপাদক ও সরবরাহকারী ৯ জন,ঔষধিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকারী ১২ জন,মজুদকারী ৩২ জন,পাইকারী ও খুচরা বিক্রেতা ২২ জন,হকার বা ফড়িয়া ২৫০ জন ছাড়াও কবিরাজ রয়েছেন ১৭ জন।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো জানান,প্রতিবিঘা জমিতে ঘৃতকুমারী চাষ শেষে উৎপাদিত অংশ বছরে বিক্রি হয় প্রায় ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা,শিমুল ১ লাখ টাকা,মিশ্রিদানা ৫৬ হাজার টাকা ও অশ্বগন্ধা ৬৪ হাজার টাকা।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,২০১৯ ও ২০২০ সালের হিসেব মতে ওই গ্রামে ঘৃতকুমারী চাষ হয়েছে ৬৫ হেক্টর জমিতে। গড় ফলন ২০২ মেটন হিসেবে মোট উৎপাদিত হয়েছে ১৩ হাজার ১শ ৩০ মেটন যার বাজার মূল্য ৮ কোটি ৭৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা।৫৩ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে শিমুল মূল। গড় ফলন ২৪ মেটন হিসেবে মোট উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ২শ ৭২ মেটন যার বাজার মূল্য ৩ কোটি ৯৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা। ১০ হেক্টর জমিতে চাষাবাদ হয়েছে অশ্বগন্ধা। গড় ফলন ১.৮ মে.টন হিসেবে মোট উৎপাদন হয়েছে ১৮ মে.টন যার বাজার মূল্য ৪৮ লাখ টাকা। ৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে মিশ্রিদানা। গড় ফলন ১০ মে.টন হিসেবে মোট উৎপাদন হয়েছে ৫০ মে.টন যার বাজার মূল্য ২১ লাখ টাকা। এছাড়া অন্যান্য ভেষজ উদ্ভিদ চাষাবাদ হয়েছে ৭ হেক্টর জমিতে। গড় ফলন ২০ মে.টন হিসেবে মোট উৎপাদন হয়েছে ১৪০ মে.টন যার বাজার মূল্য প্রায় দেড় কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বছরে ওই গ্রামে আয় হয়েছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা।ভেষজ উদ্ভিদ চাষাবাদ খরচ বাদ দিলে যে মুনাফা বা লাভ হয় তা যে কোন ফসলের তুলনায় ৮-১০ গুণ বেশি বলেও দাবী করেন তিনি।

ঔষধি গ্রামখ্যাত লক্ষিপুর-খোলাবাড়িয়া ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, এলাকার চারটি স্থানে গড়ে উঠেছে প্রায় ৩০টি ভেষজ সামগ্রী বিক্রির দোকান। দোকানগুলোতে এ্যালোভেরা চারা ছাড়াও বিভিন্ন পাতা,মূল,বীজ,ছাল ও গুঁড়া ভেষজ বিক্রি করছেন দোকানীরা।
লক্ষিপুর-খোলাবাড়িয়া মোড়ের বনলতা ভেষজের দোকানী জানালেন, তাদের কাছ থেকে হামদর্দছাড়াও আরো কয়েকটি কোম্পানী এ্যালোভেরাসহ বিভিন্ন ভেষজ কিনে নেন। তবে সবচেয়ে বেশি এ্যালোভেরা কেনেন ময়মনসিংহের ভালুকা এলাকার বিদেশী প্রতিষ্ঠান তাইওয়ান সিন লিন এন্টারপ্রাইজ। এছাড়া প্রতিদিন ট্রাকে করে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে এ্যালোভেরাসহ বিভিন্ন ভেষজ যায়। এর পাশাপাশি পাইকারী ও ফড়িয়া ছাড়াও খুচরায় বিভিন্ন ভেষজ বিক্রি হয় বলে দাবী করেন তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রতিদিন সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে লক্ষাধিক টাকার সামগ্রী বিক্রি হয় প্রতিটি দোকানে। ব্যবসায়ী জয়নুল আবেদীন বলেন,প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় এ্যালোভেরা। এর প্রধান কারণ এ্যালোভেরা পাতা সরবত থেকে শুরু করে প্রসাধনী সামগ্রীতে পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়। এজন্য এলাকার প্রায় সকল কৃষকই অন্যান্য ভেষজের সাথে চাষাবাদ করেন এ্যালোভেরা।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,এ্যালোভেরাসহ অন্যান্য ভেষজ সামগ্রীর চাষাবাদ পদ্ধতি মূলত তারা পরিবার থেকেই শেখেন। এছাড়া কৃষি ও সমবায় বিভাগ থেকে তাদেরকে বিভিন্ন সময় প্রশিক্ষণ দিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে লাভজনকভাবে ঔষধ সামগ্রী চাষাবাদে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। চাষাবাদের প্রয়োজনে অনেকেই সরকারসহ বিভিন্ন এনজিও থেকে ঋণ নিতে পারেন বলেও দাবী করেন তিনি।

স্থানীয় কৃষক ও ব্যবসায়ী আফজাল বলেন,বর্তমানে প্রতিকেজি এ্যালোভেরা তারা বিক্রি করছেন ১৫ টাকায়। কিন্তু স্থানীয়ভাবে এ্যালোভেরা সংরক্ষণের কোন সুযোগ নাই। এই সুযোগ থাকলে বা এলাকাতে এ্যালোভেরা ব্যবহার সংশ্লিষ্ট কোন ইন্ডাষ্ট্রি গড়ে উঠলে ওই এ্যালোভেরাই তারা দ্বিগুণ টাকা দামে বিক্রি করে আরো লাভবান হতে পারতেন। সৃষ্টি হত অনেক মানুষের কর্মসংস্থান। একইভাবে অন্যান্য ভেষজ সামগ্রীও সংরক্ষণের অভাব ও স্থানীয়ভাবে ইন্ডাষ্ট্রি গড়ে ওঠার অভাবে প্রতিটি উৎপাদিত সামগ্রী তাদের তুলনামূলকভাবে কম দামে বিক্রি করতে হয় দাবী করেন তিনি। এব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে তিনি সরকারসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আশু পদক্ষেপ কামনা করেন।