তিন শতাংশ প্রবৃদ্ধি যাবে ‘করোনার পেটে

চলতি অর্থবছরে প্রায় ২ দশমিক ৯৫ (প্রায় তিন) শতাংশ জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি ‘করোনাভাইরাসের পেটে’ যেতে পারে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের আশঙ্কা, বছর শেষে প্রবৃদ্ধি দাঁড়াতে পারে ৫ দশমিক ২ শতাংশ, যা গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে অর্জিত হয়েছিল ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ। এছাড়া বিনিয়োগসহ আর্থিক ১০ সূচকে বাজেটে যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল সেগুলো পূরণ হচ্ছে না।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রাক্কলন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। ‘মিডিয়াম টার্ম ম্যাক্রোইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্ক (২০২০-২১ থেকে ২০২২-২৩)’ শীর্ষক এ প্রতিবেদনটি গত ১২ মে আপডেট করা হয়েছে। এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলন হিসেবে চলতি অর্থবছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৫ শতাংশের নিচে। আজ মঙ্গলবার অনুষ্ঠেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে বিবিএসের এ প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করার কথা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সামনে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন সম্পর্কে মতামত জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সোমবার যুগান্তরকে বলেন, এটি অতিরঞ্জিত প্রাক্কলন। কেননা করোনার কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেখানে বলছে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ২-৩ শতাংশের বেশি হবে না, সেখানে ৫ দশমিক ২ শতাংশ প্রাক্কলন কীভাবে করা হয়? রফতানি ও রেমিটেন্সে ধস নেমেছে। কলকারখানা বেশ কিছুদিন বন্ধ ছিল। রফতানিমুখী অনেক পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। পরিবহনসহ সেবা খাতের সব জায়গায় জটিলতা চলছে। তাহলে এত প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন অতিরঞ্জিত ছাড়া কী হতে পারে।

সূত্র জানায়, অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে ২০০৫-০৬ ভিত্তিবছর ধরে চলতি অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু করোনার কারণে সেটি অর্জন সম্ভব হচ্ছে না। ফলে অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়াতে পারে ৫ দশমিক ২ শতাংশে। এছাড়া বাজেটের লক্ষ্য অনুযায়ী টাকার অঙ্কে প্রবৃদ্ধির আকার হওয়ার কথা ছিল ২৮ লাখ ৮৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আকার দাঁড়াতে পারে ২৮ লাখ ৫ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। ফলে করোনার কারণে টাকার অঙ্কে কমে যেতে পারে প্রায় ৮০ হাজার ১৫০ কোটি টাকা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয় যে প্রাক্কলন করেছে সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। এর চেয়ে অনেক বেশি প্রবৃদ্ধি কমে যেতে পারে। বিশ্বের অনেক দেশে এখন নেগেটিভ প্রবৃদ্ধির শঙ্কা করা হচ্ছে। সেখানে বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি যদি ১-২ শতাংশও অর্জিত হয় তাহলেও সেটি হবে বড় সাফল্য। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি মূলত নির্ভর করে রফতানি, রেমিটেন্স, ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগ এবং কৃষি উৎপাদনের ওপর। কিন্তু করোনার কারণে রফতানি, রেমিটেন্সের অবস্থা খুবই খারাপ। ব্যক্তি বিনিয়োগ নেই বললেই চলে। আর কৃষি উৎপাদন তো শুধু ধানের ওপর নির্ভর করে না। এর সঙ্গে পোলট্রি, মৎস্য, প্রাণিসম্পদসহ আরও অনেক খাত যুক্ত আছে।

যেগুলো করোনার কারণে বাজার ব্যবস্থায় মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যদি ধরেও নেয়া হয় কৃষি খুব ভালো করেছে তাহলেও কৃষিতে চার থেকে সাড়ে চার শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি হবে না। সেক্ষেত্রে ৫ দশমিক ২ শতাংশ হবে কীভাবে?

মিডিয়াম টার্ম ম্যাক্রোইকোনমিক ফ্রেমওয়ার্কে বলা হয়েছে, চলতি অর্থবছরের বাজেটে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল দুই হাজার ১৭৩ ডলার। কিন্তু করোনার কারণে সেটি কমে দাঁড়াতে পারে দুই হাজার ৭৮ দশমিক ৭০ ডলারে। এছাড়া মোট বিনিয়োগের লক্ষ্য ছিল নয় লাখ ৪৬ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। কিন্তু সেটি কমিয়ে এখন প্রাক্কলন করা হয়েছে পাঁচ লাখ ৮৩ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্য ছিল ছয় লাখ ৯৪ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। সেখান থেকে কমিয়ে ধরা হয়েছে তিন লাখ ৫৫ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। সরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্য ছিল দুই লাখ ৪৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। কমিয়ে ধরা হয়েছে দুই লাখ ২৮ হাজার ৯৪ কোটি টাকা।

এছাড়া চলতি অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় সঞ্চয় ধরা হয়েছিল নয় লাখ আট হাজার ৩০০ কোটি টাকা। সেখান থেকে সরে এসে বলা হয়েছে অর্থবছর শেষে সঞ্চয় হবে পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর মোট রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ছিল তিন লাখ ৭৭ হাজার ৮১০ কোটি টাকা। কিন্তু করোনার কারণে সেটি সম্ভব না হওয়ায় নতুন প্রাক্কলন করা হয়েছে তিন লাখ ৫৩ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্য ছিল ১৪ দশমিক ৫০ শতাংশ। কিন্তু সেটি বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১৭ দশমিক ২৪ শতাংশে। বেসরকারি খাতের ঋণের লক্ষ্য ছিল ১৬ দশমিক ৬০ শতাংশ। কিন্তু সেটি কমে হতে পারে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশে। ব্যাপক মুদ্রা সরবরাহের ক্ষেত্রে ১২ দশমিক ৫ শতাংশ রাখার লক্ষ্য ধরা হলেও সেটি বেড়ে ১৩ দশমিক ১৩ শতাংশ হতে পারে।

অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোর মধ্যে রফতানির লক্ষ্য ছিল ৪৬ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু সেটি কমিয়ে প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩৬ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। আমদানির ক্ষেত্রে ধরা হয়েছিল ৬৩ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু সেখান থেকে কমিয়ে প্রাক্কলন করা হয়েছে ৪৯ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলার। রেমিটেন্স আয়ের লক্ষ্য ছিল ১৯ বিলিয়ন ডলার। এখন সেটি কমিয়ে প্রাক্কলন করা হয়েছে ১৭ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার।