তাহিরপুরের যাদুকাটায় কয়লা কুড়িয়ে জীবন চলে নারী ও শিশুর

সুনামগঞ্জঃ প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ও পর্যটন এলাকা খ্যাত সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে সীমান্ত ঘেষা নদী যাদুকাটা। প্রকৃতি তার অকৃপণ হাতে যাদুকাটা নদীকে সম্পদে, প্রাচুর্যে, রূপে-গুণে সাজিয়ে দিয়েছে যেন শিল্পীর সুনিপুণ কারুকাজ। প্রকৃতির নান্দনিক রূপে সজ্জিত এ নদীকে সম্পদের শ্রম ও সমৃদ্ধির নদীও বলা হয়ে থাকে। এ যাদুকাটা নদীকে কেন্দ্র করে প্রতিদিন বালি-পাথর-কয়লা আহরন করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন তাহিরপুর উপজেলা ও পার্শ্ববর্তী বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার প্রায় ২০ হাজার নারী, পুরুষ ও শিশু। যারা এ শ্রমে নিয়োজিত রয়েছে তাদের মধ্যে একটি বিরাট অংশ হলো নারী ও শিশু। যাদুকাটার স্বচ্ছ নীলাভ সাদা পানির নিচে বালির সাথে মিশে থাকা কয়লা (ছোট আকারের ছাকুনির জাল) ঠ্যালা জালিতে ছেকেঁ বালি হতে আলাদা করে বস্তায় ভরে স্থানীয় পাইকারদের কাছে বিক্রি করে থাকেন শ্রমিকদের একটি অংশ। এসব কয়লা শ্রমিকদের বেশির ভাগই আবার নারী ও শিশু শ্রমিক। এসব নারী শ্রমিকদের মধ্যে কেউ কেউ স্বামী পরিত্যাক্তা কেউ আবার বিধবা কিংবা হতদরিদ্র পরিবারের স্ত্রীরা স্বামীর সাথে কাজ করে সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার জন্য যাদুকাটার ঠান্ডা পানিতে নেমে কয়লা উত্তোলনের কাজে জীবন যুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, যে বয়সে একজন শিশু স্কুলগামী হবার কথা সে সয়মটাতে সে মা-বার সাথে জীবন যুদ্ধে নিজেকে নিয়োজিত করে কয়লা উত্তোলন করছে। আর এই কয়লা উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত এসকল শিশুর অধিকাংশদের বয়সই ৯ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। এসকল শিশুদের মাঝে কিছু অংশ রয়েছে যারা স্কুলে অধ্যয়নরত রয়েছে, স্কুল শেষে যতোটা সময় পায় তারা মা-বাবার সাথে কয়লা উত্তোলনের কাজে নিজেদের জড়াচ্ছে, আবার কখনও দেখা যায়, স্কুলে না গিয়ে সে শ্রমে নিয়োজিত করছে নিজেকে বাবা-মা’র তাগিদে। অথচ যাদুকাটায় শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুরা, দেশে বিদ্যমান শিশুশ্রম নিষিদ্ধ আইনের ব্যাপারে নুন্যতম ধারণা নেই। অজ্ঞাত রয়েছে শিশুদের অভিভাবকরাও। হতদরিদ্র মা-বাবাকে কাজে সহায়তা করে সংসারের আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া এসব শিশুদের মুখাবয়বে রয়েছে পরিশ্রম আর দারিদ্রতার ছাপ! তবুও তারা সুখী, কারন কম করে হলেও ওই সব শিশু শ্রমিকরা সহসাই প্রতিদিন ১বস্তা কয়লা উত্তোলন করতে পারে এবং উত্তোলিত কয়লা স্থানীয়ভাবে প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করে থাকে ৪০০-৪৫০ টাকা দামে। আর তাতেই মিটছে ওদের তিন বেলা খাবার, লেখাপড়ার খরচ আর ভাল জামা কাপড়ের নিশ্চয়তা। মেঘালয় পাহাড়ের পাদঘেঁষে প্রবাহিত সীমান্তবর্তী এ নদীতে বর্ষায় পানির স্রোতের সাথে গড়িয়ে আসা কয়লা মিশ্রিত বালি বাংলদেশ অংশে প্রবেশের পর শ্রমিকরা পানি কমার সাথে সাথে কাজে নেমে পড়ে। বছরের ৫-৬ মাস কাজ করে প্রতিজন নারী শ্রমিক গড়ে ৪০-৫০ হাজার টাকা রোজগার করে থাকেন। এতে করে সংসারের আর্থিক অনটন ঘুছানোর পাশাপাশি ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ যোগাতেও পারছেন অনায়াসে। তাহিরপুর উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বৃহৎ একটি জনগোষ্ঠীর নারী শ্রমিকরা এ কয়লা কুড়ানোর কাজে নিয়োজিত রয়েছে। শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এ সকল শিশু শ্রমিকদের পাশাপাশি স্কুলগামী শিশুরাও কয়লা কুড়ানোর শ্রমে নিয়োজিত হয়ে সংসারের আর্থিক অনটন যেমন ঘুচাচ্ছে তেমনি অনেকে নিজের লেখাপড়ার খরচ নিজেই বহন করছে। এ অঞ্চলের কয়লা কুড়ানোর শ্রমে নিয়োজিত হয়ে অনেক হতদরিদ্র পরিবারের দিন বদলিয়েছে, ছাউনি ঘর থেকে টিনসেড ঘর নির্মানের পাশাপাশি গবাদি পশু কিনে তা আবার বিক্রি করে মুনাফাও পাচ্ছে অনেকে। এরকম জীবন সংগ্রামে বাঁচার তাগিদে এমন নানান বিচিত্র দৃশ্যের অবতারণা ঘটছে যাদুকাটার তীরবর্তী বসবাসকারী মানুষদের জীবনমানে। পাওয়া না-পাওয়ার হিসেব না কষে পেটপুরে ৩বেলা খাওয়াটাই এসব শ্রমিকদের কাছে জীবনের মানে হয়ে দাড়িয়েছে।