ডার্ক নেটে দেশে ৮ মাদক বেচাকেনা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যুর পর আলোচনায় আসে নতুন মাদক এলএসডি (লাইসার্জিক এসিড ডাই-ইথাইলামাইড)। গত বছর ১৫ মে ওই ঘটনার পর পুলিশ ও র‌্যাব অভিযান চালিয়ে বেশ কয়েকজন তরুণকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের একজন নাজমুল ইসলাম বিশ্বাস চার মাস পর জামিনে ছাড়া পান। তিনি ফের যুক্তরাষ্ট্র থেকে পার্সেলে এলএসডির চালান নিয়ে আসেন।

গত ৫ জুলাই রাজধানীর বারিধারা থেকে ১৩৮টি এলএসডি ব্লটসহ দ্বিতীয় দফায় নাজমুলকে গ্রেপ্তার করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)। গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদে নাজমুল জানান, ডার্ক নেটে সহজে বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ডিজিটাল কারেন্সিতে (বিটকয়েন) মূল্য পরিশোধ করেন তিনি। এরপর আন্তর্জাতিক কুরিয়ার সার্ভিসের পার্সেলে ১৪০টি ব্লট চলে আসে তাঁর দেওয়া ঠিকানায়।

গত দুই বছরে পুলিশ, র‌্যাব ও ডিএনসির নজরদারিতে এভাবে আটটি নতুন ধরনের মাদক ডার্ক নেটে বিক্রির তথ্য মিলেছে। এলএসডি ছাড়া অন্যগুলো হলো—নিউ সাইকোঅ্যাক্টিভ সাবসটেনসেস (এনপিএস) বা খাত, ক্রিস্টাল মেথ (আইস), কোকেন, সিউড্রোএফিড্রিন ও অ্যামফিটামিন (কাঁচামাল), ডাই মিথাইল ট্রিপ্টামিন (ডিএমটি), ব্রোলঅ্যামফিটামিন বা ব্রোমো-ডিএমএ (ডিওবি) ও ম্যাজিক মাশরুম (সিলোসাইবিন)। ডার্ক নেটে যোগাযোগ করে ফরমায়েশ দেওয়ার পর নজরদারিতে কারবারিরা ধরাও পড়ছেন। তবে বেশির ভাগ অধরাই থাকছেন। ক্ষতিকর এসব মাদকের অনলাইন কারবার ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। সাইবার জগতে মাদক কারবার নজরদারির জন্য নেই আলাদা কোনো ইউনিট। বন্দরে বিদেশি পার্সেল যাচাই করার আধুনিক স্ক্যানারও নেই। এই সুযোগ নিচ্ছেন মাদক কারবারিরা।

নতুন মাদকসংক্রান্ত মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, উচ্চবিত্ত পরিবারের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মাদকসেবীরা ইউরোপ ও আমেরিকায় প্রচলিত মাদকে উৎসাহী হয়ে উঠছেন। অনেকে বিদেশে পড়তে বা বেড়াতে গিয়ে প্রথম এসব মাদক সেবন করেছেন। পরে নিজেরাই অনলাইনে ফরমায়েশ দিয়ে আনিয়ে নিচ্ছেন। এই কারবারে নজরদারির জন্য এরই মধ্যে জাতীয় টেলিযোগাযোগ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে (এনটিএমসি) ডিএনসির কর্মকর্তারা যুক্ত হয়েছেন। অন্য সংস্থার মতো ডিএনসির ‘সাইবার শাখা’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে অর্গানোগ্রামে। সাইবার জগতে নজরদারি বাড়ানো না গেলে নতুন মাদকের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ডিএনসির তথ্যানুযায়ী, সব সংস্থা মিলে (ডিএনসি, পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও কোস্ট গার্ড) ২০২১ সালে প্রায় ৩৭ কেজি আইস জব্দ করে। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৬৮ কেজি আইস জব্দ করা হয়েছে। পাঁচ মাসেই গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ আইস জব্দ করা হয়েছে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে এলএসডির ২০টির বেশি চালান জব্দ করা হয়েছে। গত বছরের মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২টি চালানের ৬৭৫টি ব্লট জব্দ করা হয়। এই চালানগুলো এসেছে ডার্ক নেটে ও অ্যাপে যোগাযোগের মাধ্যমে।

গত বছর ২২ নভেম্বর খুলনা থেকে ডিএনসি কর্মকর্তারা আরেকটি নতুন মাদক ডিওবিসহ গ্রেপ্তার করেন আহমেদ শুভকে। বন্ধু অর্নব কুমার শর্মাকে সঙ্গে নিয়ে দেশে ডিওবি এনে কুরিয়ার পার্সেলে কারবার করছিলেন তিনি। তদন্তকারীরা জানান, শুভ ডার্ক নেটে যোগাযোগ করে পোল্যান্ড থেকে ২০০ ব্লট ডিওবি আনেন। এর জন্য ক্রিপ্টোকারেন্সিও সংগ্রহ করেন অনলাইনে। তাঁর কাছ থেকে ৯০টি ডিওবি উদ্ধার করা গেছে। এই চক্র এলএসডির চালানও এনেছে।

ডিএনসির পরিচালক (অপারেশন্স) কুসুম দেওয়ান বলেন, ‘ভৌগোলিক কারণে মাদকের গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল, গোল্ডেন ওয়েজ, গোল্ডেন ভিলেজ ও গোল্ডেন ক্রিসেন্ট এলাকাগুলোর জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে বাংলাদেশ। আবার সাইবার জগতের গোপন কিছু জায়গাও ব্যবহার করেন কারবারিরা। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সচেতনতার বিকল্প নেই। আমাদের নজরদারিও আছে। ’

পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে ডিএনসির কর্মকর্তারা বলছেন, নেট দুনিয়া সবখানে উন্মুক্ত। তাই প্রযুক্তিতে আমাদেরও দক্ষতা বাড়াতে হবে। এখন যোগাযোগের একটি পর্যায় নজরদারি করে আমরা ধরতে পারি। তবে অনেকটাই থেকে যাচ্ছে বাইরে। সক্ষমতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য বন্দরের সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোতে ভালো মানের স্ক্যানার এবং ড্রাগ ডিটেক্টর না থাকায় মিথ্যা ঘোষণার নতুন মাদকের চালান ধরা পড়ছে না।

২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর জিগাতলার একটি বাড়িতে অভিযান চালিয়ে ডিএনসি কর্মকর্তারা দেশে প্রথম আইস উদ্ধার করেন। পরে গ্রেপ্তার করা হয় ল্যাবের মালিক হাসিব মুয়াম্মার রশিদকে। ওই অভিযান পরিচালনাকারী ডিএনসির উপপরিচালক খোরশিদ আলম জানান, ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান হাসিব সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে মালয়েশিয়ায় যান। সেখানে বিদেশি বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে আইস সেবন করেন তিনি। এরপর দেশে ফিরে ল্যাবে নিজেই আইস তৈরি শুরু করেন। ডার্ক নেটে আইসের কারবার চলছে বলেও জানান হাসিব।

দেশে এলএসডি প্রথম উদ্ধার হয়েছিল ২০১৯ সালের ১৫ জুলাই। পাঁচ মিলিগ্রাম তরল ও ৪৬টি এলএসডি স্ট্রিপসহ ইয়াসের রিদওয়ান আনান ও সৈয়দ আহনাদ আতিফ মাহমুদ নামের দুই তরুণকে গ্রেপ্তার করে ডিএনসি। তদন্তকারী সূত্র জানায়, কানাডায় পড়তে যাওয়া এক বন্ধুর মাধ্যমে এলএসডি আনেন ওই দুই তরুণ।

গত বছর ২৬ জুন র‌্যাব তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থেকে আরেকটি নতুন মাদক ডিএমটিসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তদন্তকারীরা জানান, তাঁদের মধ্যে সৈয়দ মঈন উদ্দিন আহমেদ ওরফে শাদাব পাঁচ বছর আগে বিবিএ পড়তে থাইল্যান্ড যান। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে এলএসডি ও ডিএমটিতে আসক্ত হন শাদাব। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী আব্রাহাম জোনায়েদ তাহের এমবিএ পড়তে যান ইংল্যান্ডে। সেখানে আসক্ত হয়ে দেশে এসে অনলাইনে সংগ্রহ করেন।

গত বছর ৬ জুলাই হাতিরঝিল এলাকায় নতুন মাদক ‘ম্যাজিক মাশরুম’সহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তদন্তকারীরা জানান, কানাডায় গিয়ে নাগিব হাসান অর্নব ম্যাজিক মাশরুম সেবন ও কারবারে জড়ান। তিনি বাল্যবন্ধু তাইফুর রশিদ জাহিনকে এই নতুন কারবারে সম্পৃক্ত করেন।

ঢাবি ছাত্র হাফিজুর রহমানের মৃত্যুর পর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তাঁর তিন বন্ধুকে গ্রেপ্তারের পর বিদেশ থেকে এলএসডি এনে ফাঁদ পেতে তরুণদের সিন্ডিকেটে নেওয়ার তথ্য মেলে। তাঁদের কাছে চালান আসে নেদারল্যান্ডস থেকে। তিম নামের একজন পার্সেলে মাদক পাঠায় বাংলাদেশে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘বেশ কিছু পশ্চিমা মাদকের আবির্ভাব হলেও সেগুলো বাজার দখল করতে পারেনি। তরুণদের প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমাদের নজরদারি আছে। নতুন মাদকের ব্যাপারে অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে। কারণ এগুলো প্রচলিত মাদকের মতো দেখায় না। ’

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘এলএসডি, ডিএমটি ও ম্যাজিক মাশরুমের মতো নতুন মাদকে আসক্তরা অনলাইনে সংগ্রহ করে ক্লোজ গ্রুপে কারবারও করছে। আমরা এমন তথ্য পেয়ে নজরদারি বাড়িয়েছি। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক, শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সবাইকে আরো সচেতন হতে হবে। ’