চুয়াডাঙ্গার এক ঐতিহ্যবাহী খাবারের নাম কুমড়াবড়ি

শামীম রেজা চুয়াডাঙ্গা

চুয়াডাঙ্গার এক ঐতিহ্যবাহী খাবারের নাম কুমড়াবড়ি। বিভিন্ন তরকারির সঙ্গে রান্না করে খাওয়ার প্রচলন বহু আগের। ভোজন রসিকদের খাবারে বাড়তি স্বাদ এনে দেয় কুমড়াবড়ি।

ভোজন বিলাসী বাঙ্গালী। তরকারিতে কেমন করে স্বাদ আনতে হয় এই দিক দিয়ে বাঙ্গালী গৃহিনীদের জুড়ি মেলা ভার। আস্তে আস্তে শীত পড়তে শুরু করেছে। আর শীতের আগমনে চুয়াডাঙ্গায় ঐতিহ্যবাহী কুমড়ো বড়ি বানানোর ধুম পড়ে গেছে। গ্রামের বাড়িগুলোতে চলছে কুমড়া বড়ি বানানোর আয়োজন। শীতে নদী বা বিলের পানি শুকানোর সাথে সাথে প্রতিটি জায়গায় টেংরা, গুচি, বাইম, বোয়াল থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের মাছ পাওয়া যায়। আর এই সব মিঠা পানির মাছের সাথে কুমড়াবড়ির রান্না খাবারে এনে দেয় নতুনের স্বাদ। কুমড়াবড়ির তরকারির কথা শুনলেই জিভে চলে আসে জল।

শীতকে স্বাগত জানিয়ে প্রত্যেক ঘরে ঘরে চলছে, কলাই আর চালকুমড়া দিয়ে বড়ি বানানোর মহোৎসব। বর্তমানে চুয়াডাঙ্গার গৃহবধূরা ব্যস্ত সময় পার করছেন ডালের তৈরি বড়ি বানাতে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বড়ি তৈরি প্রক্রিয়া। শীতের মধ্যে পাড়া মহল্লার গৃহিণীরা এ মজাদার খাবার তৈরিতে ব্যস্ত পার করছেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, চুয়াডাঙ্গার বিভিন্ন হাটে-বাজারে বিক্রি হচ্ছে কুমড়া বড়ি। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন দোকানে পাইকারী ও খুচরা বিক্রি হচ্ছে স্বাদের এই কুমড়া বড়ি। গ্রামে ধনী-গরীব নির্বিশেষে সব শ্রেণী-পোশার মানুষের নিত্য দিনের তরকারিতে ব্যবহার হয় কুমড়াবড়ি। যে কারনেই কুমড়াবড়ি বানানোর আয়োজনে চুয়াডাঙ্গা অন্যান্য জায়গার তুলনায় একটু বেশি।

কুমড়াবড়ি বানাতে পাকা এবং পরিণত চালকুমড়া কুড়িয়ে তার সঙ্গে মাসকালাই কিংবা কাতিকালাই বেটে কালোজিরা ও পাঁচপোড়ন দিয়ে বিশেষ কায়দায় তৈরি করা হয় চুয়াডাঙ্গার এই ঐতিহ্যবাহী কুমড়ো বড়ি। এখন অবশ্য চালকুমড়ারার বদলে পেঁপেও ব্যবহার করা হয়।

কুমড়ো বড়ি তৈরিতে বেশ পরিশ্রম করতে হয়। তাছাড়াও কুমড়োবড়ি তৈরির পর যদি, তীব্র রোদ বা তাপ না থাকে অথবা আকাশ মেঘাছন্ন থাকে, তাহলে দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম আর হারভাঙ্গা খাটুনি সবই বৃথা যেতে পারে। কারণ বড়ি বানানোর পর, যত দ্রুত তা রোদে তাপে শুকানো যায়, ততই এটি সুস্বাদু হয়। এছাড়া চুয়াডাঙ্গার কুমড়াবড়ি এখন যাচ্ছে দেশের বাইরেও। কারণ অনেক প্রবাসীরা দেশে এসে, প্রবাস জীবনে ফিরে যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে যায়,মায়ের হাতের তৈরি কুমড়াবড়ি।

আলমডাঙ্গা উপজেলার আসমান খালি বাজারের ব্যবসায়ী কিয়াম হোসেন(৩৮) বলেন,কুমড়া এবং ডালের মিশ্রণে এটি তৈরি হয় বলে এর নাম কুমড়া বড়ি। এক কালের শখের খাবার থেকে উৎপত্তি হওয়া কুমড়া বড়ি এখন শত শত মানুষের কর্মসংস্থান ও প্রান্তিক পর্যায়ের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। আমরা প্রতি কেজি কুমড়াবড়ি বিক্রি করছি ২০০-২৫০ টাকা কেজি দরে।

চুয়াডাঙ্গার এক ঐতিহ্যবাহী খাবারের নাম কুমড়াবড়ি। চুয়াডাঙ্গা আলমডাঙ্গা উপজেলা থেকে তোলা ছবি।

আলমডাঙ্গার খোরদ গ্রামের মোছাঃ আকলীমা বেগম(৪০) বলেন, ডালের বড়ি বা কুমড়াবড়ি সাধারণত বিভিন্ন তরকারির মধ্যে দিয়ে খাওয়া হয়। এটা তরকারির স্বাদ বৃদ্ধি করে আবার এটা খেতেও দারুন লাগে। আর একবার বানানো হয়ে গেলে বয়ামে ভরে সংরক্ষণ করা যায় অনেক দিন।

চুয়াডাঙ্গা সরকারি কলেজে এইচ এস সি ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী পপি খাতুন (২১)বলেন,কুমড়াবড়ি গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য,খেতে বেশ সুস্বাদু। প্রায় সব সবজির সাথে কুমড়া বড়ি রান্না করা যায়। কয়েক বছর আগেও শীতকালে গ্রামের প্রায় সব বাড়িতেই কুমড়া বড়ি বানানো হতো,তখন অনেকটা উৎসবের আমেজ বইতো। কিন্তু দিন দিন সেই প্রচলন কমে যাচ্ছে।কিন্তু,দুঃখের বিষয় নতুন প্রজন্মের মেয়েরা এসব শিখতে কিংবা বড়ি তৈরি করতে আগ্রহী না। তারা এর আওয়াজ থেকে যেভাবে পিছিয়ে পড়ছে তাতে আগামীতে এটা হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বর্তমানে বাজারের ডালের দাম বৃদ্ধি ও করোনার কারণে এখন কুমড়োবড়ির ব্যবহার অনেকটাই কমে যাচ্ছে। যেহেতু গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যবাহী একটি অংশ এই কুমড়োবড়ি। শুধু এটি ঐতিহ্যবাহী একটি অংশই নয় এটাকে এক ধরনের শিল্পও বলা হয়। শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য কুমড়াবড়ি তৈরির কারিগরদের একটি তালিকা করে তাদের উন্নত প্রশিক্ষণ স্বল্প সুদে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করলে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী টিকিয়ে রাখা সম্ভব বলে মনে হয়। বিশেষ করে নারী ক্ষুদ্র শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য অনেক ভালো হবে।
কিন্তু, বর্তমানে বাজারে ভেজাল কুমড়াবড়ির ছড়াছড়ি,তার জন্য প্রসাশনের প্রতিনিয়ত ভেজালবিরোধী অভিযান প্রয়োজন।