গো-খাদ্যের তীব্র সংকটে: বিপাকে সুনামগঞ্জের খামারি-গৃহস্থরা

মাহফুজুর রহমান, সুনামগঞ্জ প্রতিনিধিঃহাওরাঞ্চল খ্যাত সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলায় দেখা দিয়েছে গো-খাদ্যের তীব্র সংকটে: এতে বিপাকে তাহিরপুরের ক্ষুদ্র খামারি ও সাধারণ গৃহস্থরা(কৃষক)। বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাসের কারণে বিগত ৯ মাস ব্যবসা বাণিজ্যসহ সব কিছুই স্তবির হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে আবার কয়েক দফা বন্যার পানিতে মানুষের ঘর-বাড়িসহ গবাদিপশুর খাদ্য(খড়) ডুবে গিয়ে পচে নষ্ট হওয়ার ফলে এখন গো-খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উজান এলাকায় সবাই দ্রæত আমন ধান চাষবাদ করে ফসল ফলানোই ব্যাস্ত। এমিন অবস্থায় একদিকে বন্যার পানি অন্যদিকে আমন চাষিরা আমন ধান চাষাবাদ করায় ফাঁকা কোনো গো-চারণ ভূমিও নেই।এমতাবস্থায় হাওরাঞ্চলের মানুষে জীবন চালানোই যেখানে তাদের খেতে হচ্ছে হিমসিম। আবার অনেকে জীবনের তাগিদে ছোটছেন শহর মুখি। সেখানে তাদের গৃহপালিত গরু, ছাগল, ভেড়াসহ গবাদিপশুর চড়া দামে খাদ্য জোগাতে অনেকেই পড়েছেন বিপাকে। অনেকেই গৃহপালিত পশু খাদ্য জোগাতে চড়াসুদে মহজনদের কাছ থেকে টাকা এনে আবার অনেকেই অগ্রীম মহাজনেদের কাছ থোক বোর ধানের উপর কম দরে টাকা নিয়ে তাদের গো খাদ্য কিনতে হচ্ছে। জানাযায়, হাওরাঞ্চল খ্যাত তাহিরপুর উপজেলার প্রায় ৯০% মানুষ কৃষি নির্ভর হওয়ায় প্রায় সাবাই গরু, মহিষ সহ সব ধরনের গবাদিপশুর লালন পালন করতে হয়। যারফলে চরম ভোগান্তি আর বিপাকে পড়েছেন তাদের গবাদিপশু নিয়ে খামারি ও সাধারণ গৃহস্থরা(কৃষকরা)। যে খড়ের (ঘাসের) আঁটি অন্য বছর ১ টাকায় বিক্রয় করতে দেখা গেছে এ বছর তার দাম ৪/৫ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে। তাহিরপুর উপজেলার উত্তরাঞ্চলের আগাম আমন ধান চাষিদের। গত কয়েক দফা বন্যায় তাহিরপুর উপজেলার বেশিরভাগ গৃহস্থের খড়ের চালা ডুবে গিয়ে পচে নষ্ট হওয়ার কারণে এবছর সে খড়ের (আমন ধরনের ঘাসের) ১টি আঁটি বিক্রি করছেন ৮থেকে ১০ টাকা দরে। যে খড় ছিল ৩/৪ শত টাকা মন , সেটি খড়েই এখন কিনতে হচ্ছে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকা মন। বাজারে খড়ের দামের পাশাপাশি তারা ঘাস, খড় ও ভুসিসহ সব কিছুই অতিরিক্ত দামে কিনে গরু লালন-পালন করছেন। অনেকের হাতে টাকা নেই। কেউ কেউ খড়ের পরির্বতে গো-খাদ্য হিসেবে কচুরিপানা, লতাপাতা, তরকারির খোসা, বেঁচে ফেলে দেয়া শাক ও বাজারের ফেলে দেয়া তরিতরকারি কুড়িয়ে এনে খাওয়াচ্ছেন। জানা গেছে, এবার বন্যা শুরুর পর থেকেই সুনামগঞ্জ জেলাসহ গোটা দেশের ৩৮টি জেলায় বন্যা উপদ্রæত এলাকায় গো-খাদ্যের সংকট দেখা দেয়। এখন এ সংকট এখন আরও তীব্র হয়ে উঠেছে । কারণ বন্যায় ঘাসের জমি, আউশ, বোনা আমন সব ডুবে গেছে। বোরো ধানের খড় এমনিতেই কম হয়। এই খড় গো-খাদ্যের চাহিদা মেটাতে পারে না। ফলে গৃহস্থরা সারা বছর আমনের খড় দিয়েই চাহিদা মেটান। এবার বোরো ধান কাটার সময় বৃষ্টিতে অনেকের খড় পচে গেছে। তাছাড়া বন্যায় অনেকের খড় ডুবে পচে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এমন অবস্থা তাহিরপুর উপজেলাসহ সুনামগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায়ও। সেখানে গো-খাদ্যের তীব্র সংকট চলছে। আজ ৮ নভেম্বর রবিবার তাহিরপুর উপজেলার বৃহৎ বাদাঘাট বাজারে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় বেশ জমে উঠেছে গো খাদ্যের বাজার। খড়ের বেশি দাম পাওয়ায় তাহিরপুর উপজেলার উত্তর বাদাঘাট ইউনিয়নে ও উত্তর বড়দল ইউনিয়নের বিভিন্ন হাওরে আগাম জাতের আমন ধান কেটে ধান মাড়াই শেষে তারা ডেংগা আঁটি হিসেবে (খড়ের আঁটি) বিক্রি করছে বাজারে। এসময় বিভিন্ন উপজেলা থেকে বাদাঘাট বাজাওে খড় কিনতে আসা কৃষকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, একদিকে করোনাভাইরাস এর কারণে সকল কাজকর্ম সহ ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ ছিল দীর্ঘ ৬/৭ মাস। এরপর আবার কয়েক দফা বন্যা। এমনিতেই জীবন জীবিকা বাচাঁতে হাওরাঞ্চলে মানুষের অর্ধাহারে অনাহারে কোন রকম দিনাতিপাত করছে। এখন আবার গৃহপালিত পশুর খাবার জোগাতে হচ্ছে চড়া দামে। এ যে তাদের মরার উপর খাড়ার ঘায়ে পরিনত হয়েছে। এ সময় কথা হয় তাহিরপুর উপজেলার উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের শিবরামপুর গ্রামের গৃহস্থ(কৃষক) নজরুল ইসলাম (৪০) এর সাথে , তিনি জানান তার ছোট বড় মিলিয়ে ৫ টা গরু। বৈশাখে নিজের জমির আর কিছু অন্যের কাছ থেকে বন( খড়) কিনে সারা বছরের গরুর খাবার রাখছিলেন। কিন্তু গরীবের কপালে কি সুখ সয়। গত ৪/৫ বারের বন্যায় সব বনলাছ (খড়ের ছালী) ডুবে পচে নষ্ট অইয়া গেছে। ২ মাস যাবৎ প্রতি বাজারেই ১০০ গল্লা কিনতে হয় ১০০০ টাকা দরে । এক বাজারে ১০০ গল্লা(খড়ের আঁটি) ১০০০টাকা আবার আরেক বাজারে ৮০০ টাকায় এভাবেই ২ মাস ধরে কিনে গরুর খাদ্য জোগাচ্ছেন। বাজার থেকে এই গল্লার আঁটি বাড়িত নিতে নৌকা ভারা লাগে আরও ৩০০ টাকা। তিনি আরও বলেন, আগে (গতবছর) এই গল্লা কিনতাম পারছি আমার ৩০০ বা ৪০০ টাকা দিয়ে। বন্যার কারণে এবার দ্বিগুণ দাম। এই ১০০ গল্লা ৫ টি গরুকে ৮/১০ দিন খাওয়াইতে পারি। একই ইউনিয়নের গোলাকপুর গ্রামের কৃষক সামসু মিয়া (৪৫) জানান, তার ৩ টা গরু। এই বাজারে ১৫০ টি গল্লা(আঁটি) কিনেছেন ৮০০ টাকায়। ১৫০ টি গল্লা তার ৩ টি গরুকে এক সপ্তাহ খাওয়াতে পারবে। এর রকম আরও ৩ মাস খাওয়ানো লাগবে। পানি সরে গিয়ে কান্দা(বোর জমির আঙ্গীণা) না ভাসা পর্যন্ত। বাদাঘাট ইউনিয়নের লাউড়েরগর গ্রামের রাব্বি ডেইরি এন্ট ফ্যাটেনিং র্ফাম এর মালিক ফরিদ আহমেদ বলেন, আমার র্ফামের ১৭টি গরুর প্রতি মাসে খড়সহ সব খাবার মিলিয়ে ৪০ হাজার টাকা খরছ লাগে। বন্যায় খড়ের দাম ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি এর সাথে সাথে গবাদিপশুর সব খাবারেরই দাম দ্বীগুণ। তাই এবার লাভের চেয়ে লোকসানের মুখ দেখতে হবে। দক্ষিণ বড়দল ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রানের কৃষক কুদ্দুস মিয়া(৫৮) বলেন, বন্যা আসার আগে আমার ৫ টি গরু আছিন। বন্যায় সব পচে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বনের কারণে(খাড়ের কারণে) ২ টা বিক্রি করেছি। কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে একদিকে চালের দাম যেম তেমনি বন্যার কারণে খেড়ের (খড়ের) দাম আরও বেশি। তার নিজের খানি(খাবার) ও গরুর খানি জোগাতে তার অনেক কষ্ট হয়। তাই তিনি বাধ্য হয়েই গরু বিক্রি করেছি। উত্তর বড়দল ইউনিয়নের খড় বিক্রেতা মানিগাও গ্রামের কৃষক তানজিল (৪০) জানান, এবার তিনি ১০ কেয়ার(৩০ শতাংশ এক কেয়ার) আমন করেছেন। তার গত ২০/২৫ পূর্ব থেকে তার ধান কাটা লাগছে। এবার তিনি ধান করে লাভবান। জানতে চাইলে কিভাবে। উত্তরে তিনি বলেন, এবার ধানের দামও বেশি খেড়ের(খড়ের) দামও বেশি। ধানের পাশাপাশি আমি খেড়ের ১০০ গল্লা(আঁটি) বিক্রি করছি ১০০০ টাকায়। প্রতি কেয়ারে আমার ১২০০ থেকে ১৩০০ গল্লা বিক্রি করে বেস্থি (অতিরিক্ত) পাচ্ছি ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা। এবার আমি ৫ কেয়ার জমির খেড় ৭০ হাজার টাকা বিক্রি করেছি। বাকী খেড়(খড়) আমার গরুর জন্য রেখে দিয়েছি।