কৃষির উন্নয়নে বীজই প্রধান ও মুখ্য উপকরণ

ডেস্ক রিপোর্ট: কৃষির উন্নয়নে বীজই প্রধান ও মুখ্য উপকরণ। বীজ ভালো না হলে অন্যান্য উপকরণের ব্যবহার ফলপ্রসূ হয় না, কখনও কখনও একেবারেই অপচয় হয়। এটা পরীক্ষিত যে, মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহারে শতকরা ১৫-২০ ভাগ উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব। সুতরাং মানসম্পন্ন বীজকে কেন্দ্রবিন্দু ধরেই স্থিতিশীল খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা অর্জনের কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

কৃষি উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিতে উন্নত জাত ও মানের বীজের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই দেশে মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানসম্পন্ন বীজের গুরুত্ব অনুধাবন করে এবারের জাতীয় বীজ মেলা ২০১৯-এর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রাখবে মানসম্পন্ন বীজের ব্যবহার’।

বাড়ছে মানুষ; কিন্তু বাড়ছে না জমি। মানুষের খাদ্য চাহিদা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। বর্ধিত জনসংখ্যার স্থিতিশীল খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা বর্তমান সময়ে কৃষির মূল চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যা প্রায় ১৬০.৭৫ মিলিয়ন, ধারণা করা হচ্ছে ২০২০ সালের মধ্যে তা বেড়ে গিয়ে হবে ১৭০ মিলিয়ন। এ অবস্থায় স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে ২০২১ সালের মধ্যে অতিরিক্ত ৫-৬ মিলিয়ন টন খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে হলে দরকার বীজ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ।

কম জমিতে অধিক ফলন পেতে হলে সব চাষের জমিতে পর্যায়ক্রমে মানসম্মত বীজ ব্যবহারের প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। বাংলাদেশ এখন নিু আয়ের দেশ থেকে নিুমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। ফলে দ্রুত গতিতে আমাদের শিল্পেরও উন্নতি হচ্ছে। অন্যদিকে কৃষিতে নানাবিধ প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে উৎপাদনশীলতা পূর্বের তুলনায় বহুগুণ বেড়েছে এবং কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে। অর্থাৎ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়ে যাওয়ায় কৃষি কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা কমে গেছে।

বীজ প্রযুক্তির ব্যবহার : পৃথিবীর অনুন্নত, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে বীজ কর্মসূচি রয়েছে, যা থেকে কৃষিতে ভালো বীজের ব্যবহার হচ্ছে। বীজ ব্যবহারের পরিমাণ ও মান নির্ভর করে সে দেশে ব্যবহৃত বীজ প্রযুক্তির উৎকর্ষের ওপর। যে দেশ যত উন্নত, সে দেশে ভালো বীজের ব্যবহারও তত বেশি।

কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বীজ ব্যবসার জন্য ৩২,০০০ বীজ ডিলারকে নিবন্ধন প্রদান করা হয়েছে। প্রায় ৯০,০০০ চুক্তিবদ্ধ চাষীর মাধ্যমে সারা দেশে সরকারি ও বেসরকারি সেক্টরে বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে। ফলে প্রত্যন্ত অঞ্চলের চাষীদের হাতের নাগালে এখন উন্নত জাত ও মানের বীজ পাওয়া যাচ্ছে। বর্তমান বাংলাদেশেও হাজার হাজার টন বীজ ব্যবহার হচ্ছে, অনেক বড় বড় দেশীয় ও বহুজাতিক কোম্পানি বীজ ব্যবসা করছে। বীজ ব্যবসার সফলতার মূল ভিত্তি হল ‘বীজ প্রযুক্তির সফল বাস্তবায়ন’।

বীজকে নিয়ে এখন শিল্প গড়ে উঠেছে। এ শিল্পের উৎপাদিত পণ্য হচ্ছে ভালো বীজ। বীজ প্রযুক্তি প্রয়োগ করে ভালো বীজ পাওয়া যায়। তাই বীজ শিল্পের অন্তর্নিহিত চালিকাশক্তি হচ্ছে বীজ প্রযুক্তি। বিভিন্ন ফসলের বীজে বীজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বীজ শিল্পের জন্য ভালো বীজ উৎপাদন করা হচ্ছে। সভ্যতা শুরুর আদি প্রযুক্তি হচ্ছে বীজ প্রযুক্তি। সভ্যতার সময় বিকাশের সঙ্গে বীজ তথা বীজ প্রযুক্তির অবস্থান অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং সুদৃঢ় হয়েছে। উদ্যান সভ্যতার উন্নততর হতে উন্নততর স্তরে নিয়ে বীজ প্রযুক্তি বিষয়ক নব নব আবিষ্কার বীজ প্রযুক্তিকে উন্নত হতে উন্নততর স্তরে নিয়ে যাচ্ছে। তাই বীজ প্রযুক্তির ব্যবহার আগামীতে সভ্যতার স্তরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখেই বেড়ে চলবে।

ফসল চাষের জন্য ব্যবহৃত গাছের যে কোনো অঙ্গকে সাধারণভাবে কৃষিকাজে বীজ হিসেবে ধরে নেয়া হয়। যেমন ধান বা গমের দানা, গোল আলু, আদা, রসুন, কচুর কন্দ, কলা গাছের গুঁড়ি ইত্যাদি। প্রকৃতপক্ষে এর সব ক’টিই বীজ নয়। ধান বা গমের দানা প্রকৃত বীজ। অন্যগুলো রূপান্তরিত কাণ্ড বা মূল। এ পরিপ্রেক্ষিতে কৃষিকাজে ব্যবহৃত বীজকে বীজ না বলে কৃষিবীজ বলা যেতে পারে। দেশের বীজ আইনেও বীজকে সংজ্ঞায়িত করে দেয়া হয়েছে।

ফসল উৎপাদনের পরিমাণ ও মান বৃদ্ধির জন্য ভালো বীজ ব্যবহার করার এবং ভালো বীজের ব্যবহার বৃদ্ধি করার গুরুত্ব দিন দিন বেড়েই চলেছে। ভালো বীজ ব্যবহার করা এবং ভালো বীজের ব্যবহার বৃদ্ধি করার জন্য গৃহীত সমুদয় কাজকে একত্রে বীজ প্রযুক্তি বলা যেতে পারে। বীজের বিভিন্ন গুণ ও গুণাবলি সংরক্ষণ সম্পর্কিত জ্ঞান এবং ভালো বীজ ব্যবহার বৃদ্ধির জন্য গৃহীত কার্যক্রম নিয়ে বীজ প্রযুক্তি।

প্রক্রিয়াজাতকরণ : পরিবর্ধিত বীজের মধ্যে নানারকম খড়কুটো, অবীজ, চিটা, পোকা ইত্যাদি থাকতে পারে। তাই পরিবর্ধিত বীজ সরাসরি চাষে ব্যবহারের যোগ্য হয় না। তাছাড়া বীজ সংগ্রহের পর পরবর্তী ফসল চাষের মৌসুম পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে হয়। বীজ পরিষ্কার করা, সংরক্ষণ করা, প্যাকিং করা ও শোধন করা এ কাজগুলো একত্রে বীজ প্রক্রিয়াজাতকরণ।

মান নিশ্চিতকরণ : বীজমান নিশ্চিত করতে না পারলে সে বীজ ভালো বীজ হয় না। তাই মান নিশ্চিতকরণ বীজ প্রযুক্তির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এজন্য বীজ ফসলের মাঠ পরিদর্শন এবং পরিবর্ধিত বীজ গবেষণাগারে পরীক্ষা করা হয়। এসব পরীক্ষার মাধ্যমে মান নিশ্চিত করা হয় এবং নিু মানসম্পন্ন বীজ বিপণন করা হয় না। মান নিশ্চিতকরণের কাজ বীজ প্রযুক্তির অন্তর্গত কাজগুলোর সব ক’টিতে প্রয়োগ করতে হয়। বীজের মান নিশ্চিতকরণের জন্য বীজ ফসলের মাঠমান এবং বীজ সংরক্ষণাগারে বীজের বীজমান বজায় রাখতে হয়।

বীজ বিপণন : বীজ প্রযুক্তি সিঁড়ির শেষ ধাপ হচ্ছে বীজ বিপণন। বীজ বিপণনের মাধ্যমে কৃষক ভালো বীজের সরবরাহ পায় এবং ফসল উৎপাদনের জন্য কৃষক তা ব্যবহার করে থাকে। বীজ বিপণন সুষ্ঠু না হলে ভালো বীজ সঠিক সময়ে, সঠিক মোড়কে, সঠিক মূল্যে কৃষকের কাছে সরবরাহ সম্ভব হয় না। অন্যান্য কার‌্যাবলি ফলপ্রসূ করতে বীজ বিপণন অপরিহার্য। বর্ণিত কার‌্যাবলি ধারাবাহিকভাবে সম্পন্ন করতে হয়।

জাত না পেলে যেমন অন্যান্য ধাপের প্রয়োগ সম্ভব নয়, তেমনি সরাসরি বীজ বিপণন করা সম্ভব নয় যদি ভালো বীজ পরিবর্ধন বা প্রক্রিয়াজাতকরণ না করা যায়। আবার মান নিশ্চিতকরণ ধাপ পালিত না হলে অন্যান্য ধাপ কোনো কাজে আসে না। তাই কাজগুলো শুধু সম্পাদন করা নয় ধারাবাহিকভাবে করলে ফলপ্রসূ হয়।

বীজ ব্যবস্থাপনা : বাংলাদেশে বীজ উৎপাদন ও সরবরাহের সর্ববৃহৎ সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন (বিএডিসি)। এ সংস্থাটি ১৯৬২-৬৩ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন মাত্র ১৩ টন বীজ সরবরাহের মাধ্যমে বীজ কর্মসূচি শুরু করে। পরবর্তীতে ক্রমান্বয়ে চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে বীজ উৎপাদন ও সরবরাহের পরিমাণ বেড়ে যায়। তখন বীজের গুণগতমান রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পায়। এ পরিপ্রেক্ষিতে বীজের মান নিয়ন্ত্রণ ও প্রত্যয়নের জন্য ১৯৭৪ সালে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি প্রতিষ্ঠা করা হয়।

বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি জাতীয় বীজ বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত মাঠমান ও বীজমান অনুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে উৎপাদিত নিয়ন্ত্রিত ফসলের (ধান, গম, আলু, পাট, মেস্তা ও কেনাফ) বীজের মাঠ ও গুদাম পরিদর্শন করে প্রজনন, ভিত্তি ও প্রত্যয়িত শ্রেণির বীজের প্রত্যয়ন করে। মানঘোষিত শ্রেণির বীজ উৎপাদক নিজেই প্রত্যয়িত মানের প্রত্যয়ন দিয়ে থাকে।

এক্ষেত্রে বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সির প্রত্যয়নের প্রয়োজন হয় না। বর্তমানে আনুষ্ঠানিক বীজ ব্যবস্থাপনা থেকে সব ফসলের গড়ে ২৬ শতাংশ গুণগতমানসম্পন্ন বীজ সরবরাহ করা হয়। উপ-আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা থেকে ৩৬ শতাংশ এবং অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ কৃষকের নিজস্ব উৎপাদিত বীজ গড়ে ৩৮ শতাংশ ব্যবহার করা হয়।

বাংলাদেশের দ্রুত ধাবমান কৃষি প্রযুক্তির যুগে বীজ প্রযুক্তিও কোনো ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই; সার্কভুক্ত দেশের মধ্যে বাংলাদেশের চাষীরা বেশি মাত্রায় গুণগতমানসম্পন্ন বীজ ব্যবহার করছে। তিন মৌসুমে ধান চাষ করা হয়। আউশ মৌসুমে প্রায় ৬০ শতাংশ মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহার করা হয়, আমনে ৩০ শতাংশ এবং বোরো মৌসুমে ১০০ শতাংশ মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহার করে চাষীরা। গম বাংলাদেশের দ্বিতীয় ফসল; এক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ বীজ মানসম্পন্ন।

ভুট্টার ক্ষেত্রে ৯৮ শতাংশ জমিতে আমদানিকৃত হাইব্রিড ভুট্টা বীজ ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও পাটের ক্ষেত্রে ৯৩ শতাংশ মানসম্পন্ন বীজ ব্যবহার করা হয়। আলু বীজের ক্ষেত্রে চাষীরা ১৩ শতাংশ মানসম্পন্ন প্রত্যয়িত বীজ ব্যবহার করে। সবজি বীজের ক্ষেত্রে ৮৫ শতাংশ জমিতে চাষীরা হাইব্রিড সবজি বীজ ব্যবহার করে।