কটিয়াদীতে পুলিশের তৎপরতায় মায়ের কোলে ফিরে এলো শিশু রাবিয়া

এস কে রাজুঃ হাসপাতালের সামনে ভীড়। একজন পয়ত্রিশোর্ধ্ব মধ্য বয়স্ক লোক চিৎকার করে কাঁদছে। মানুষের ভীড় বাড়তেই আছে। কেউ জানে কেউবা জানে না। যে জানে না সে অন্যদের জিজ্ঞাসা করছে। কেউ বলছে কেউ বলছে না। অবাক বিস্ময়ে মানুষ আশ-পাশে তাকাচ্ছে। এক সময় লোকটি কান্না করতে করতে চলে যায় পাশে। ফোনে কথা বলে বাড়িতে তার স্ত্রীর সঙ্গে। ১৪ দিন বয়সের শিশু কন্যা হারিয়ে গেছে হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে এসে। অপরিচিত এক মহিলার কোলে দিয়ে সে ওয়াস রুমে গিয়েছিল। ওয়াশ রুম থেকে ফিরে আর সেই মহিলাকে খুঁজে পাচ্ছে না। নিয়ে গেছে মাত্র ১৪ দিন আগে মায়ের কোল আলো করে এসেছিল যে শিশু। হাসপাতালে প্রাচীর ছেড়ে পালিয়েছে সে মহিলা। অনেক খুঁজেও পাওয়া যায়নি তার নাম পরিচয়। শিশুটির মা খবর শুনে জ্ঞান হারিয়েছেন। তার বাড়িতে পড়েছে কান্নার রোল।

ঘটনা কিশোরগঞ্জ জেলার কটিয়াদি থানার বালিরহাটপাড় এলাকায়। রিক্সাচালক ফারুখ ভুইয়া ও রিমা খাতুনের সংসারে আগে এক মেয়ে ও এক ছেলে আছে। মেয়ে রিক্তার বয়স ১২ বছর এবং ছেলে রিফাতের বয়স ৭ বছর। অভাবের সংসারে ফারুখ রিক্সা চালিয়ে যা পায় তা দিয়ে কোন রকম দিন চলে যায়। সকালে রিক্সা নিয়ে বের হয়, ফিরে গভীর রাতে। কোনদিন চাউল আনলে রান্না হয়, না আনলে রান্না হয় না। অধিক রাতে বাড়িতে ফেরা নিয়ে ফারুখের সাথে স্ত্রী রিমা খাতুনের ঝগড়া নিত্যদিনের। যেদিন বাজার না নিয়ে আসে সেদিন ঝগড়াটা বেশি হয়। সারাদিন যদি রুজি রোজগার না হয় তাহলে এতো রাত করে বাড়িতে ফেরার কি দরকার? সকাল সকাল বাড়ি ফিরলেই হয়। এমন অভিযোগ রিমার প্রতিদিনের। অভ্যাস বদলায় না ফারুখের। বরং কোনদিন গভীর রাতে যখন বাড়িতে ফিরে তখন ছেলে মেয়েরা ক্ষুদা পেটে ঘুমিয়ে যায় বাবা আসার আগেই। ১৪ দিন আগে যখন রিমা কন্যা সন্তান প্রসব করে তখন থেকেই ফারুখের মন ভালো নেই। আদর বা অনাদরে নাম রেখেছিলেন রাবিয়া।

১৮ নভেম্বর, ২০১৯ তারিখ সকাল ১১টা বেজে ১০ মিনিট। ফারুখ আজ রিক্সা চালাতে যায়নি। সকালেই বলেছে ১৪ দিনের শিশু সন্তানকে কটিয়াদি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা করাতে হবে। স্ত্রীকে এ বলে বাড়ি থেকে রাবিয়াকে নিয়ে বের হয়। স্ত্রী রিমা খাতুনও যেতে চেয়েছে তার সাথে। কিন্তু ফারুখ অনড়, সে একাই নিয়ে যাবে রাবিয়াকে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর দুপুরের দিকে ফোন দিয়ে স্ত্রী রিমাকে বলেন যে রাবিয়াকে এক মহিলার কোলে দিয়ে ওয়াস রুমে গিয়েছিলেন ফারুখ। ওয়াস রুম থেকে ফিরে আর রাবেয়াসহ সেই মহিলাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। আশপাশে অনেক খোঁজ করেও সেই মহিলাকে পায়নি সে। হৃদয়গ্রাহী এ খবরে এলাকায় নেমে আসে শোক। মসজিদে মসজিদে মাইকে ঘোষণা দেয়া হয় শিশু রাবিয়ার হারিয়ে যাওয়ার খবর। দিশেহারা মা রাবেয়া খাতুন। দুধের শিশু মায়ের দুধ খেতে পারবে না, এ কষ্ট মেনে নিতে পারছিলেন না তিনি। তবুও খুঁজে ফিরেন এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে। আত্মীয়-স্বজন সকলের নিকট খবর পৌঁছে যায় এ ঘটনার। ফারুখ ফিরে না ঘরে। খুঁজতে থাকে কোলের শিশু কন্যাকে। ততক্ষনে এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে, এক উপজেলা থেকে অন্য উপজেলায় খবর পৌঁছে গেছে।

সে দিন এবং রাত এক হয়ে যায় রিমা খাতুনের। চোখে শুধু জল, ঘুম নেই চোখে। কান্নার জলও শুকিয়ে গেছে একসময়। তবুও নিরন্তর চেষ্টা শিশু রাবিয়াকে ফিরে পেতে। ফকির, কবিরাজ যে যেখানে বলেছে সেখানেই গিয়েছেন ছুটে। স্বামী ফারুখের মোবাইল বন্ধ। সন্তান খুঁজতে খুঁজতে হয়তো মোবাইলের চার্জ গেছে ফুরিয়ে। সারা রাত বাসায় আসেনি ফারুখ। শিশু রাবেয়াকে হারিয়েছে মা রিমা, এবার স্বামীকেও হারাতে বসেছেন। সময় যতো বাড়ে, কান্নার জল আরও বাড়তে থাকে। ১৯ নভেম্বর সকালে ফারুখ অন্য মোবাইল থেকে ফোন করে জানায় তার মেয়ে পাওয়া যাবে যদি ৬ লক্ষ টাকা দেয়া হয়। পাচারকারীরা শিশু রাবিয়াকে নিয়ে গেছে, এ টাকা দিলেই ফেরত পাওয়া যাবে তাঁকে। গরীব ঘরের মেয়ে রিমা খাতুন। লক্ষ টাকা কখনও এক যায়গায় দেখেননি। ৬ লক্ষ টাকা কোথায় পাবে? স্বামীকে বাড়িতে আসতে অনুরোধ জানালেও সে আসেনি ফিরে। বলেছে ৬ লক্ষ টাকা যেভাবে হোক যোগাড় করতে হবে। না হলে পাওয়া যাবে না মেয়েকে। রিমা খাতুন আর পারেননি ধৈর্য্য ধারণ করতে। ছুটে আসেন কটিয়াদি থানায়। বিস্তারিত ঘটনা খুলে বলেন ওসি সাহেবের নিকট। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অভিজ্ঞ ওসির বুঝতে সমস্যা হয়নি একটুও। অফিসারদের নিয়ে তাৎক্ষণিক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন শিশু রাবেয়াকে উদ্ধার করার জন্য।

তদন্তকারী অফিসার এসআই গোলাম মোস্তফা-সহ অন্যান্য অফিসারকে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা প্রদান করে বের করে এলাকায়। তথ্য প্রযুক্তি এবং বিভিন্ন কৌশল ও সোর্সের তথ্যের ভিত্তিতে আটক করেন শিশু রাবেয়ার পিতা ফারুখকে। সারারাত না ঘুমিয়ে চোখ লাল হয়েছে তার। জিজ্ঞাসায় জানান সারারাত মেয়েকে খুঁজতে খুঁজতে চোখ লাল হয়ে গেছে। কিন্তু পুলিশের চোখ বলছে অন্য কথা। পুলিশের নিকট যে তথ্য আছে তার সাথে মিলে না ফারুখের দেয়া তথ্য। একটি সত্য গোপন করতে হাজারো মিথ্যা তথ্যে পুলিশের চোখ তখন লাল হয়ে যাচ্ছে রাগে এবং ক্ষোভে। ততক্ষণে ওসি সাহেব এবং তদন্তকারী অফিসার পেয়ে গেছেন ফারুখের অনেক অজানা অধ্যায়। নিবিড় জিজ্ঞাসাবাদে ঠিকই একসময় স্বীকার করেন ঘটনার আদ্যোপান্ত।

ফারুখের আশা ছিল স্ত্রীর কোল জুড়ে আসবে একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তান। কিন্তু মেয়ে সন্তান আসায় সে খুশি হতে পারেনি। প্রতিদিন যা রোজগার করতো তার বেশিরভাগ হেরে যেতো রাতের আঁধারে জুয়া খেলে। যে কারনে অনেক রাতে বাসায় ফিরলেও ছেলে মেয়ের মুখে অন্নের ব্যবস্থা করতে পারতো না। বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল। শিশু মেয়েকে তার মা ছাড়া হাসপাতালে নেয়ার কোন যৌক্তিক কারণ বলতে পারে না পুলিশের নিকট। বরং বিভিন্ন সময় দিতে থাকে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য। একসময় স্বীকার করে সে তার নিজের ১৪ দিনের শিশু সন্তানকে ৭০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছে অন্য এক মহিলার নিকট। প্রথমে মহিলার পরিচয় গোপন করার চেষ্টা করলেও একসময় তার পরিচয় দেয় পুলিশকে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৬ ও ৩৮ ধারায় কটিয়াদি থানার মামলা নং- ২৩, তারিখ- ১৯/১১/২০১৯ খ্রিঃ রুজু হয়। গ্রেফতার করা হয় সে মামলায় আসামি ফারুখকে। তাঁকে নিয়ে পুলিশ দল ছুটে যান কটিয়াদি থানার বেতাল এলাকায়। আটক করা হয় শিশুটিকে ক্রয় করা ফারুখের পূর্ব পরিচিত জাকিয়া আক্তার(২৮) কে। তার হেফাজত থেকে উদ্ধার করা হয় ১৫ দিনের শিশু কন্যা রাবিয়াকে।

তদন্ত এখানেই শেষ নয়। জাকিয়া আক্তারের ছেলে মেয়ে থাকতে কেন কিনলেন এ শিশু কন্যাকে। প্রশ্ন থেকেই যায়। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় জাকিয়া আক্তারের বোন রোকেয়ার দীর্ঘদিন বিয়ে হলেও নেই কোন সন্তান। নিঃসন্তান রোকেয়ার জন্যই ফারুখের নিকট থেকে এ শিশুটিকে কিনে নেন তিনি। শিশু রাবেয়ার জন্ম হওয়ার পর থেকে ফারুখ খুঁজছিলেন এমন সুযোগ। মামা বাড়ির এলাকার জাকিয়া আক্তারের সাথে ছিল তার পূর্ব পরিচয়। সেই সূত্রে ফারুখ জানতো বোন রোকেয়ার জন্য একটি শিশু সন্তান কিনতে খুঁজছেন জাকিয়া আক্তার। তবে শিশু কন্য বিক্রি করা ৭০ হাজার টাকা কোথায় গেল তা বলতে নারাজ ফারুখ। দীর্ঘদিনের রাতজাগা অভ্যাস ফারুখ জুয়ার আসরে যে এক রাতেই সন্তান বিক্রি করা ৭০ হাজার টাকা খুইয়েছেন তা অবশ্য পুলিশ আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। এবার ফারুখের মুখ থেকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসে সে অবাক করা তথ্য। ২০ নভেম্বর কিশোরগঞ্জ বিজ্ঞ আদালতে আসামি ফারুখ ও জাকিয়া আক্তারকে পুলিশ রিমান্ডের আবেদন সহ পাঠানো হয়েছে। জেল হাজতে আছে তারা, রিমান্ডের শুনানী মূলতবী আছে আদালতে। বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে শিশু রাবিয়াকে দেয়া হয়েছে মা রিমা খাতুনের জিম্মায়।

মানুষ একটি সন্তানের জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করে। আর ফারুখের মতো বাবারা নিজ সন্তানকে বিক্রি করে জুয়ার আসরে এক রাতে হেরে যায় ৭০ হাজার টাকা। এমন বাবাও পৃথিবীতে আছে বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয় সাধারণ মানুষের। শিশু সন্তানহারা মা রিমা খাতুন নিজ কন্যা রাবেয়াকে ফিরে পেয়ে যারপর নাই খুশি হয়েছেন। পুলিশ নিয়ে তার শোনা গল্পগুলো যে মিথ্যা ছিল তা আর তাঁকে বোঝাতে হয়নি। প্রাণ খুলে দোয়া করেছেন পুলিশের জন্য। সেদিন যারা হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে ফারুখের কান্না দেখেছিলেন, তারও এসেছিলেন ফারুখের হাতে হাতকড়া দেখতে। শিশু রাবেয়া তার মায়ের কোল পেয়েছে ফিরে। মা রিমা আক্তার স্বামী ফারুখের বাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন বেতাল গ্রামে বাবার ভিটায়। স্বামী ফারুখ ছিল রিমা আক্তারের আপন ফুফাতো ভাই। মামাতো বোন বিয়ে করেছিলেন ফারুখ হোসেন। জুয়ার নেশায় একটি পরিবার কিভাবে ধ্বংসের শেষ পরিনীতিতে পৌঁছাতে পারে তার অনন্য উদাহরণ হয়ে থাকবে আসামি ফারুখের পরিবার। নিস্পাপ মেয়েটি পৃথিবীর আলো দেখতে এসে এখন দেখছেন বাবা মায়ের চোখে কান্নার জল। আর কখনও বাবার আদর পাবে কিনা শিশু রাবিয়া তা বলা ভার। ভালো থাকুক রাবেয়া, ভালো থাকুক রিমা। অপরাধী হিসেবে ফারুখ ও তার দোসররা শাস্তি পাক এটাই এখন সকলের চাওয়া।