ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শন রামগোপালপুর জমিদারবাড়ি ও জমিদারির উৎপত্তি

সাংবাদিক রায়হান উদ্দিন সরকারঃ

ইতিহাস-ঐতিহ্যের স্বর্ণখনি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা। এই উপজেলায় ছিল প্রাচীন জনপদ, কামরূপ জনপদ, টাকশাল, দু’টি কেল্লা (দুর্গ), ছোট-বড় অনেক নদী, সুলতান ও মুঘল আমলের মসজিদ, মন্দির, বারভূইয়া এবং মুঘল আমলের দেওয়ান বাড়ি, সর্দার বাড়ি, নবাব আমলের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের বাড়ি, মধ্যযুগের অজানা কিছু মাজার, প্রাচীন নির্দশন ইত্যাদি। উত্তর ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার অস্থিত্ব নয়টি এস্টেটের বারোটি জমিদারবাড়ির ইতিহাস পুরোপুরি না পাওয়া গেলেও কোন বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারের আগমনে রামগোপালপুর ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছে তা ধারাবাহিক গবেষণায় উদঘাটনের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে।

ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায়, মোমেনসিং পরগনা (উত্তর-পূর্ব ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা) ও জফরশাহীর পরগনা (জামালপুর)- এই দুই পরগনার জমিদার শ্রীকৃষ্ণ রায়চৌধুরীর দুই পুত্র দত্তক নিয়েছিলেন মাধবী তথা আলেয়ার গর্ভজাত সিরাজপুত্রকে। নবাব সিরাজের পুত্রের নয়া নামকরণ হয় যুগলকিশোর রায়চৌধুরী। এভাবেই নতুন করে যাত্রা শুরু করে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বংশ। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানরা আগে থেকেই পৃথকভাবে বসবাস করতেন। তারা পৃথক বাড়িতে থাকলেও শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর বিষয় সম্পত্তি অবিভক্ত ছিল। জমিদারির শাসন, সংরক্ষণ, তদারকি একযোগে হতো। জমিদারির দাপ্তরিক কাজও একত্রেই হতো। পরে ভ্রাতৃবিরোধ ও আত্মকলহে এই পরিবারের বন্ধন পৃথক হয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর মৃত্যুর পর কৃষ্ণকিশোর, কৃষ্ণগোপাল, গঙ্গানারায়ণ ও লক্ষীনারায়ণ এই অবশিষ্ট চার ভাই সমস্ত সম্পত্তির অধিকারী হন। চার ভাইয়ের মধ্যে দু’টি তরফ গঠিত হয়েছিল- তরফ রায় হিস্যা ও তরফ চৌধুরী হিস্যা।

তরফ রায় হিস্যা ও তরফ চৌধুরী হিস্যা নামের কারণ:

শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্র চাঁদ রায়, কৃষ্ণকিশোর ও কৃষ্ণগোপাল নবাব সরকারে চাকুরি অবস্থায় রায় উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। গঙ্গানারায়ণ ও লক্ষীনারায়ণ নবাব সরকারে কোন চাকুরিতে নিযুক্ত না হয়ে দিনাজপুরের অন্তর্গত ঘোড়াঘাট উপজেলার নিকটবর্তী এলাকায় করৈ বাড়িতেই বাস করতেন। এইজন্য তারা পিতৃ উপাধি ‘চৌধুরী’ নামে অভিহিত হতেন। তাই কৃষ্ণকিশোর, কৃষ্ণগোপাল যে অংশে বাস করতেন, তা ‘তরফ রায় হিস্যা’ নামে উচ্চারিত হতো এবং যে অংশে গঙ্গানারায়ণ ও লক্ষীনারায়ণ বাস করতেন তা ‘তরফ চৌধুরী হিস্যা’ বলে উচ্চারিত হতো। এই তরফ রায় ও তরফ চৌধুরী ঐক্যবন্ধন ছিন্ন করে একে অন্যের অনিষ্টকারী ও ছিদ্রান্বেষী হলেন। কারণে অকারণে উভয় দলে বিবাদ, মারামারি, কাটাকাটি আরম্ভ হলো। করৈ প্রজাদের উপর ভীষণ অত্যাচার শুরু হলো। উভয় দলের অত্যাচারে প্রজারা উদ্বিগ্ন থাকতেন সবসময়।

সে সময় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট চাকলায় ফকির মজনু শাহ নামে একজন কুখ্যাত দস্যু ছিল। তার ভয়ে সমস্ত চাকলা কম্পিত হতো। অত্যাচারী ব্রিটিশ কোম্পানি, জমিদার বা পুতুল নবাবদের বিরুদ্ধে লড়াকু নেতা ফকির মজনু শাহ-এর প্রভাবে তরফ রায় ও তরফ চৌধুরী উভয় দলই আত্মকলহের পরিবর্তে আত্মরক্ষার চেষ্টা চালাতে লাগেন। ফকির মজনু শাহ-এর অত্যাচার ও জমিদার মীর সাহেবের শত্রুতাবশত দিনাজপুরের করৈ অঞ্চল ত্যাগ করে জামালপুর জেলা অন্তর্গত জফরশাহী পরগনায় কৃষ্ণপুর গ্রামে তরফ রায় এবং মালঞ্চা গ্রামে তরফ চৌধুরী বসবাস করতে শুরু করেন। ঢাকায় অবস্থিত তৎকালীন প্রাদেশিক শাসনকর্তা মুহাম্মদ রেজা খানের নিকট আবেদন করার পর শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সমস্ত সম্পত্তি সমান দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে একাংশ তরফ রায় হিস্যা ও অপরাংশ তরফ চৌধুরী হিস্যা প্রাপ্ত হলেন। এর মধ্যদিয়ে বহুদিনের আত্নবিরোধ শেষ হয়।

ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক নির্দশন গৌরীপুরের রামগোপালপুর জমিদারবাড়ি:

গৌরীপুর উপজেলা শহর থেকে তিন কিলোমিটার দক্ষিণে রামগোপালপুর ইউনিয়ন পরিষদের নিকটে এই জমিদারবাড়ির অবস্থান। পাঠকদের জন্য সংক্ষেপে ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হলো রামগোপালপুর জমিদারবাড়ির ইতিহাস।

শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর সমস্ত সম্পত্তির অর্ধেক ও তরফ রায়ের উত্তরাধিকারসূত্রে জমিদারি পান যুগলকিশোর। তার প্রয়াত জ্যাঠা কৃষ্ণকিশোরের দুই বিধবা স্ত্রী রত্নমালা ও নারায়নীর দেখাশোনা করতেন তিনি। অবশ্য পরে তার দুই জ্যাঠীমার সাথে সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে তার ঝামেলা হয়। ধারণা করা হয়, যেকোনোভাবেই হোক তিনি যে মুসলিম বংশের ছেলে সে সম্পর্কে দুই বিধবা কোনো আঁচ পেয়েছিলেন। যুগলকিশোরের গায়ের রঙ ও গঠন স্বভাবতই বাঙালিদের মতো ছিল না। যুগলকিশোর অনেক চিন্তা-ভাবনা করে বিধবাদের জন্য মাসিক বৃত্তির ব্যবস্থা করে তাদের কাছ থেকে নিজের নামে সমস্ত দানপত্র লিখে নেবার আয়োজন করেন। কিন্তু বিধবাদ্বয়ের সাথে তার এই বিরোধ আদালত পর্যন্ত গড়ায় ও দীর্ঘ সময় মোকাদ্দমা চলতে থাকে। তরফ রায় জমিদারি অংশ থেকে অর্ধেক অংশ প্রাপ্ত হলেন প্রয়াত কৃষ্ণকিশোরের দুই বিধবা স্ত্রী রত্নমালা ও নারায়নী দেবী।

১৭৭৭ খৃষ্টাব্দ হতে রত্নমালা ও নারায়নী দেবীর নামে জমিদারি চলতে লাগল। রামগোপালপুর জমিদারবাড়ির নাম রাখার পেছনে রয়েছে আড়াইশ’ বছরের ইতিহাস। নবাব সিরাজ ও আলেয়ার পুত্র হিন্দু জমিদার পরিবারে তাদের পরিচয়ে বেড়ে ওঠা ময়মনসিংহের প্রতাপশালী জমিদার যুগলকিশোর রায় চৌধুরী ও তার বিধবা দুই জেঠীমা রত্নমালা ও নারায়নী দেবীর সাথে সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে ও মামলা-মোকাদ্দমায় জয় লাভের ফলে রামগোপালপুর জমিদারবাড়ির গোড়াপত্তন হয়। অর্থাৎ নতুন জমিদার হিসেবে রত্নমালা ও নারায়নী দেবীর হাতে রামগোপালপুর জমিদারবাড়ির গোড়াপত্তন ঘটেছিল এবং সেখানে কয়েক বছরের মধ্যেই তারা বসতি স্থাপন করেন।

তৎকালীন রামগোপালপুর জমিদার রাজা যোগেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী তার তৃতীয় পুত্র লেখক শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীর ’ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাম্মণ জমিদার’ নামক প্রামণ্য গ্রন্থে জমিদারদের বংশ ও বিভিন্ন ঘটনার কাহিনী বর্ণনা করেছেন।

যুগলকিশোর ছিলেন ময়মনসিংহ ও জফরশাহী পরগনার জমিদার কৃষ্ণগোপাল রায় চৌধুরীর দত্তক পুত্র। শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরীর প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত পুত্রদের নবাব সরকারের উপাধি ’রায়’ দ্বারা সৃষ্টি ’তরফ রায়’ ব্রাহ্মণ পরিবারেই বড় হন যুগলকিশোর। বাবা ও জ্যাঠামশাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি তাদের বিধবা স্ত্রীদের দেখাশোনাসহ জমিদারির দায়িত্ব পান। সে সময় জফরসাহি অঞ্চলে এক মহামারি দেখা দিলে যুগলকিশোর জামালপুর জেলার অন্তর্গত কৃষ্ণপুর থেকে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে আসেন।

গৌরীপুর তখনো জঙ্গলে পরিপূর্ণ। চাষবাসও তেমন নেই। দরিদ্র কিছু পরিবার সেখানে বাস করতো। যুগলকিশোরের দক্ষতায় অল্প সময়েই এই অঞ্চলের আমূল পরিবর্তন ঘটে। যুগলকিশোর রায় চৌধুরী অত্যন্ত বুদ্ধিমান এবং পরাক্রান্ত ব্যক্তি ছিলেন। বিষয়-বুদ্ধি, রাজনীতি, সমরনীতি প্রভৃতিতে তার মতো প্রতিভাবান ও তেজস্বী পুরুষ সেইসময়ে অতি নগন্য ছিল। তার প্রতাপে ”বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খাইত”। জনগণ তাকে যমের মতো ভয় করতো। তার অঙ্গুলি হেলানে সমগ্র পরগনা চলতো।

ধারণা করা হয় যে, তার আমলে উপ-প্রদেশ হিসেবে কয়েকটি অঞ্চলসহ বৃহত্তর ময়মনসিংহের নামকরণ মোমেনসিং পরগনার নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত হয়। আলাপ সিং পরগনার প্রাচীন শহর বাইগনবাড়িতে ইংরেজদের বিভিন্ন ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান ও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে কালেক্টর অফিস প্রতিষ্ঠিত হয়। ব্রিটিশ সরকার প্রশাসনিক সুবিধার জন্য বিভিন্ন এলাকাকে জেলায় বিভক্ত করেন।

১৭৮৭ সালের আগে বাইগনবাড়ির পাশ দিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রস্থতা ছিল বর্তমান বাংলাদেশের প্রবেশ মূখে অর্থাৎ কুড়িগ্রাম জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের মতো। বাইগনবাড়ি বন্দর হতে ময়মনসিংহ জেলার গোড়াপত্তন শুরু হয়। ১ মে ১৭৮৭ সালে মোমেনসিং জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৭৮৭ সালে বন্যা ও ভূমিকম্পে বাইগনবাড়ি শহরের ৯০ ভাগ ধ্বংস হওয়ার পর ইংরেজরা নতুন শহর তৈরী করার জন্য জরিপ কাজ শুরু করেন। তখন নাসিরাবাদ শহর প্রতিষ্ঠিত হয়।

ব্রিটিশ ভূবিদ জেমস রেনেলের মানচিত্র ও ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার ইতিহাসের পাতা ঘাটলে দেখা যায়, মোমেনসিং নামটি প্রথমে পরগনা এবং পরে উপ-প্রদেশ ও জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজদের পেশা-পদবী, চিঠি, তারিখসহ অফিসিয়্যাল ডকুমেন্ট থেকে ময়মনসিংহের ইতিহাস আরও সুস্পষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। যেমন, Board of Revenue Proceedings, 11th-18th April, 1788 : A letter from the Collector of Momensing : In the mean time I do myself, the honour to enclose an account of the Bazar prices of rice during the Pous and Maug Months of the Bengal year 1192, 1193 and 1194 in which it is useless to further remarks—. I am & W Woughton, Collector— Momensing The 9th April 1788. ### Magistrate of Momensing, Mr. J. Straccy: 29th January.1802.

যুগলকিশোরের সঙ্গে রত্নমালা ও নারায়নী দেবীর বিবাধের সূত্রপাত:

প্রয়াত জ্যাঠা কৃষ্ণকিশোরের দুই বিধবা স্ত্রী রত্নমালা ও নারায়নী দেবীর দেখাশোনা করতেন যুগলকিশোর। এ অবস্থা সত্ত্বেও তারা গৌরীপুরে এসে দেখলেন, তাদের স্বামী ছেলে-মেয়ে জমিদারি এবং ভবিষ্যত বলতে কিছু নেই, তখন ইচ্ছা পোষন করলেন দু’জনেই দত্তক নেবেন। আর এ দত্তক নিয়েই যতো ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। যুগলকিশোর তখন বলেন, তিনি তাদের পুত্ররূপে আছেন। তিনি বলেন যে, অন্য এক দত্তক পুত্র গ্রহণ করে আত্মবিরোধের বীজ বপন করা সঙ্গত নহে। যুগলকিশোর প্রথম মিষ্টি ভাষা ও পরে কঠোরভাবে জানিয়ে দিয়েছিলেন কোন অবস্থাতেই দত্তক নেয়া যাবে না। ফলে উভয় পক্ষই আস্তে আস্তে দূরে সরে যেতে লাগলো। মনোমালিন্য বাড়তে বাড়তে এমন এক পর্যায়ে ঠেকলো যে যুগলকিশাের সিদ্ধান্ত নিলো দু’জনের নিকট থেকে সম্পত্তি নিজ নামে দানপত্র করিয়ে নিতে। বিনিময়ে বিধবাদ্বয় নির্দিষ্ট হারে মাসিক বৃত্তি, ব্রত পূজাদি ধর্ম কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ পাবেন।

এই সিদ্ধান্ত হিতে বিপরীত হলো। কোন পক্ষই কাউকে ছাড় দিতে রাজি হলেন না। যুগলকিশাের দু’জনকেই গৃহবন্দী করে রাখলেন। এমনকি নিকট আত্মীয়-স্বজনও তাদের সাথে কথাবার্তা ভাব বিনিময় করতে পারতেন না। বিধবাদ্বয় বুঝতে পারলেন তাদের এ অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পেতে আর কোনো উপায় ছিল না। তাদের সামনে মৃত্যু ছাড়া আর কোন রাস্তা নেই।

রত্নমালা ও নারায়নী দেবীর পলায়ন:

যুগলকিশোরের রাজপ্রাসাদ থেকে রত্নমালা ও নারায়নী দেবীর অন্যত্র পালিয়ে রক্ষা পাবে তার কোনো উপায় নেই। এ অবস্থায় তারা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাকেই ভরসা করে তাঁর নাম জপ করে প্রার্থনা করতে লাগলেন। রত্নমালা ও নারায়নী দেবীর দূর্দশা দেখে নরসিংহ রায় নামক একজন মোক্তার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তিনি নিঃসন্তান বিধবাদের উপর অত্যাচার সহ্য করতে পারলেন না। কোনো একদিন যুগলকিশোর অসুস্থ অবস্থায় শায়িত, সবাই তার ওষুধপত্র ও সেবায় ব্যস্ত। এরইমধ্যে নরসিংহ সুযোগ খুঁজতেছিলেন বিধবাদ্বয়কে স্থানান্তর করার জন্য। সুযোগ পেয়েও গেলেন, গোপীমোহন চট্রোপাধ্যায় নামে এক কর্মচারীও সহায় হলেন। প্রাণভয়, অনাহার, অনিদ্রায় রত্নমালা ও নারায়নী দেবী দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন। পায়ে হেঁটে প্রাসাদের বাইরেও অগ্রসর হতে পারছিলেন না। পরে দু’জনকে দু’টি ঝুড়িতে বসিয়ে নরসিংহ ও গোপীমোহন গৌরীপুরের রাজপ্রাসাদ থেকে বের হলেন ও তাদের মুক্ত করলেন। অন্ধকার রাত, পদে পদে জীবননাশের সম্ভাবনা; এ অবস্থায় নরসিংহ রামগোপালপুর ইউনিয়নের ধুরুয়া গ্রামের এক মুসলমান ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় পেলেন, যুগলকিশোরের ভয়ে সেখানেও বেশি সময় রাখতে সাহস পেল না আশ্রয়দাতা। সে রাতেই ডুলি ও বেহারা সংগ্রহ করে, নিজেদের লোক সঙ্গে দিয়ে নৌকায় করে তখনকার সময়ে বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ পাড় করে উভয় মহিলাকে নাসিরাবাদ শহরে পাঠিয়ে দিলেন। নাসিরাবাদ (ময়মনসিংহ) শহরে বেশীদিন থাকা নিরাপদ নয় একই কারণে পালায়ণ পর সকলেই নৌকায় রাজশাহী রওনা হলেন।

যুগলকিশোরের ক্রোধ:

একদিন পর যুগলকিশোর জানতে পারলেন বিধবাদ্বয় নরসিংহ রায় ও গোপীমোহনের সহায়তায় পালিয়েছে তখন সমস্ত ক্রোধ ও ক্ষোভ গিয়ে পড়লো তাদের উপর। গৌরীপুরসহ সম্ভাব্য সকল স্থানে শত চেষ্টা করেও তাদের সন্ধান না পেয়ে যুগলকিশাের প্রহরীসহ দায়িত্বে থাকা অন্যান্য কর্মচারীদের পদচ্যুত, শাস্তি ও দণ্ড দিলেন। নরসিংহ রায় ও গোপীমোহনকে জীবিত বা মৃত যে অবস্থাতেই হোক ধরে আনার জন্য আদেশ দিলেন।

রত্নমালা ও নারায়নী দেবীর অভিযোগ ও মোকদ্দমায় সম্পত্তির অর্ধাংশ প্রাপ্তি:

রত্নমালা ও নারায়নী দেবী রাজশাহীর রামপুর বোয়ালীয়া গ্রামে একটি ছোট বাড়ি ভাড়া নিয়ে গুপ্তভাবে বসবাস করতে লাগলেন। তারা বিজ্ঞজনের পরামর্শ নিয়ে কলকাতার রাজস্ব কাউন্সিলে তাদের হিস্যা পৃথক করে দেওয়ার জন্য আবেদন করেন। ১৭৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জুলাই (বাংলা সন ১১৮১, ৩১ আষাঢ়) রেভিনিউ কাউন্সিলের রেসিডেন্ট ওয়ারেন হেস্টিংস যুগলকিশাের রায়কে তার অধিকৃত জমিদারির সম্পত্তির অর্ধাংশ আবেদনকারী রত্নমালা ও নারায়নী দেবীকে প্রদানের জন্য আদেশ দেন এবং রত্নমালা ও নারায়ণী দেবীর অনুকূলে মোমেসিং ও জফরশাহী পরগনার চার আনা অংশের জমিদারি সনদ প্রদান করেন।

রাজশাহীর রামপুর বোয়ালীয়া গ্রাম হতে ময়মনসিংহের রামগোপালপুরে রত্নমালা ও নারায়নী দেবীর আগমন:

১৭৭৭ খ্রিষ্টাব্দ (বাংলা ১১৮৪ সাল) হতে রত্নমালা ও নারায়নী দেবীর নামে জমিদারি চলতে লাগল। বিধবাদ্বয় যুগল কিশোরের জমিদারির সম্পত্তির অর্ধাংশের অধিকারী হলেও তারা সাহস করে গৌরীপুরে আসতে পারলেন না। কয়েক বছর ধরে রাজশাহীর রামপুর বোয়ালীয়া গ্রামে তারা বসবাস করতে লাগলেন এবং সেখান থেকে জমিদারি পরিচালনাও করতে লাগলেন। ঐ সময়ের মধ্যে গৌরীপুরের রামগোপালপুরে তাদের রাজপ্রাসাদ নির্মাণ হতে থাকে। রাজশাহীর রামপুরের নামানুসারে নতুন বাড়ির জায়গার নাম দেওয়া হয় রামগোপালপুর।

রামের সাথে গোপাল যুক্ত হওয়ার আরেকটি কারণ রেনেল কর্তৃক অংকিত ভারতবর্ষের প্রাচীন মানচিত্রে গৌরীপুরের বোকাইনগর হতে ১৪ কিলোমিটার পূর্বদিকে রামপুর নামে একটি প্রসিদ্ধ স্থান উল্লেখ পাওয়া যায়। রামপুর যেহেতু প্রাচীন প্রসিদ্ধ স্থান সেহেতু নতুন জয়গার নাম রামগোপালপুর হিসেবে গোড়াপত্তন হওয়ার পর অঞ্চলটি বিশেষ সমৃদ্ধি লাভ করে। পরবর্তীতে জয়গার নামের সাথে মিল রেখে নারায়নী দেবীর জমিদারি পরিচালনার জন্য দত্তকপুত্ররূপে ছেলের নতুন নাম রামকিশোর রায় চৌধুরী রাখা হয়।

রাজপ্রাসাদের নির্মাণ কাজ শেষ হলে লোকজনসহ রত্নমালা ও নারায়ণী দেবী রামগোপালপুরে এসে উঠেন। রত্নমালা ও নারায়ণী দেবীর অংশ এভাবে ‘রামগোপালপুর জমিদারি হিসেবে খ্যাত হয়। বিধবাদ্বয়ের কোনো সন্তানাদি ছিলো না, তাদের মধ্যে রত্নমালা দেবী ফরিদপুরের অন্তর্গত মোস্তাকপুরের মজুমদার বংশের এক বালককে দত্তক নিলেন। এই দত্তক পুত্রের নাম দেয়া হলো ‘নন্দকিশোর রায় চৌধুরী’।

রামগোপালপুরের প্রতিষ্ঠাতা জমিদার রত্নমালা দেবীর বিরুদ্ধে যুগলকিশোরের দত্তক অসিদ্ধির মোকদ্দমার প্রস্তুতি:

জমিদার শ্রীকৃষ্ণ রায়চৌধুরীর তরফ রায় হিস্যার দুই পুত্র কৃষ্ণকিশোর ও কৃষ্ণগোপাল সিদ্ধি দত্তক নিয়েছিলেন যুগলকিশোরকে। তাদের মৃত্যুর পর তরফ রায় হিস্যার উত্তরাধিকারসূত্রে একক জমিদারি পান যুগলকিশোর। যুগলকিশোর গেীরীপুরে আসার পর দুই জ্যাঠীমার সাথে সম্পদের ভাগাভাগি নিয়ে তার মামলা হয়। বিধবা রত্নমালা দেবীর দত্তকপুত্র (নন্দকিশোর রায় চৌধুরী) গ্রহণের কথা যুগলকিশোর জানতে পেয়ে পিতা ছাড়া দত্তক অসিদ্ধির মোকদ্দমার প্রস্তুতি নিতে আয়োজন করতে লাগলেন। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই অর্থাৎ ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে ( বাংলা ১১৯১ সালে) রত্নমালা মৃত্যুবরণ করেন এবং নন্দকিশোরও কিছুদিন পর মৃত্যুবরণ করেন। ফলে নারায়ণী দেবী সাকুল্য সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হন। যুগলকিশোর কিছুদিনের জন্য শান্ত থাকেন।

রামগোপালপুরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জমিদার নারায়ণী দেবীর বিরুদ্ধে দুই তরফ হতে মোকদ্দমার প্রস্তুতি:

তরফ রায় হিস্যা হতে যুগলকিশোর রায় এবং তরফ চৌধুরী হিস্যা হতে লক্ষীনারায়ণের পুত্র শ্যামচন্দ্র চৌধুরী ও রুদ্র চন্দ্র চৌধুরী উত্তরাধিকারী দাবি করে আদালতে মামলা দায়ের করেন। শেষ পর্যন্ত কলকাতা সদর দেওয়ানি আদালতে নারায়ণী দেবীকে উত্তরাধিকারী সাব্যস্ত করা হয়। এ বিবাদ লক্ষ্য করে ময়মনসিংহ অঞ্চলের দায়িত্বে থাকা কালেক্টর রটন সাহেব লিখেছিলেন- If I might Present to offer my opinion Rotton Malla’s death ought not in Justice to deprive the Surviving widiw of the enjoyment of the whole share. On the demise of Narayani, it will be time enough for each person to de-liver in his claims for the present. I conceive Narayani has an undoubted right to give the management to whom she pleases, provided her choice does not affect the dues of Government.

নারায়ণী দেবীর দত্তক গ্রহণ এবং দুই তরফ হতে নারায়ণী দেবীর দত্তক পুত্রকে অসিদ্ধ হিসেবে অভিযোগ:

নন্দকিশোরের মৃত্যুর পর নারায়ণী পতিকূলের জলপিণ্ড সংস্থানের জন্য রাজশাহী জেলার অন্তর্গত হালসা গ্রামের রামকিশোর রায় নামক একটি বালককে দত্তক পুত্ররূপে গ্রহণ করে বহুদিনের আশা পূর্ণ করেন। নারায়ণী রামগোপালপুরে এসে বাস করতে লাগলেন কিন্তু তার দত্তকপুত্রকে রামগোপালপুরে আনতে সাহস পেলেন না। দত্তকপুত্র রামকিশোরকে রাজশাহীতে কিছুদিন রাখলেন। যুগলকিশোর দত্তক গ্রহণ করার সংবাদ শুনে ক্রোধান্বিত হলেন এবং বিষয়টি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। তার ধারণা ছিল, নারায়ণী দেবী মারা গেলে এমনিতেই তিনি অর্ধেক সম্পত্তির মালিক হবেন। কিন্তু সেটা আর বাস্তবে হলো না। দত্তকপুত্রই তার স্বার্থের অন্তরায়, এজন্য ঐ বালককে জমিদারি থেকে বঞ্চিত করতে বদ্ধপরিকর হলেন। অচিরেই শ্যামচন্দ্র চৌধুরী, রুদ্রচন্দ্র চৌধুরীসহ যুগলকিশোর রাজদ্বারে একটি অভিযোগ করেন। তারা অভিযোগপত্রে লিখেন, “কৃষ্ণকিশোর রায়ের মৃত্যুকালে নারায়ণী দেবীর বয়স ছিল মাত্র চল্লিশ। তার স্বামী কৃষ্ণকিশোর রায়ের মাত্র অকস্মাৎ মৃত্যুমূখে পতিত হন, এই অবস্থায় পূর্বে দত্তক গ্রহণের অনুমতি দেয়াা সম্পূর্ণ অসম্ভব। সুতরাং এ দত্তক অসিদ্ধ। বিশেষত এক ব্যক্তির দুই পত্নীর দ্বারা দুই দত্তক গ্রহণ শাস্ত্র সঙ্গত হতে পারে না। তাছাড়া বংশ প্রচলিত, দেশ প্রচলিত বিধি, নিয়ম রক্ষা করে দত্তক গ্রহণ করা হয় নাই। এ দত্তক গ্রহণকালে জ্ঞাতি কুটুম্ব, আত্মীয়-স্বজন কেহ উপস্থিত ছিলেন না, সুতরাং এই দত্তক বৈধ নহে”। যুগলকিশোর দেশ-বিদেশের সাক্ষী যোগাড় করে অত্যন্ত স্বার্থকতার সাথে মামলা চালাতে লাগলেন, এ মামলাটি দীর্ঘ তিন বছর পর্যন্ত চলে। নারায়ণী দেবীর পক্ষে রায় হয় এবং রামকিশোর দত্তক হিসেবে বৈধতা পান। এই রায়ে দত্তক নিয়ে কলহের অবসান হয়।

দত্তক পুত্র রামকিশোর রায় চৌধুরী রামগোপালপুরের প্রথম পুরুষ জমিদার:

পরবর্তীকালে নারায়ণী দেবী তার প্রাপ্য সম্পত্তির অর্ধেক রামকিশোরকে প্রদান করেন। নবযৌবন প্রাপ্ত অবস্থায় রামকিশোর জগদীশ্বরী দেবীকে বিবাহ করেন। ১২১৪ বঙ্গাব্দে (১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে) রামকিশোরের অকাল মৃত্যু হয়। তাদের একমাত্র কন্যা দিগম্বরী দেবী। নারায়ণী দেবী দিগম্বরী দেবীকে ভিতরবন্দের জমিদার আনন্দচন্দ্র রায় চৌধুরীর সাথে তার বিবাহ সম্পন্ন হয় এবং যৌতুক স্বরূপ ‘দোহারদিগর তালুক’ প্রদান করেন। রামকিশোরের স্ত্রী জগদীশ্বরী দেবী বোকাইনগর বাসাবাড়ির জমিদার রুদ্রচন্দ্র চৌধুরীর পুত্র কেশবচন্দ্রকে দত্তক গ্রহণ করেন। কেশবচন্দ্র পরে কালীকিশোর রায় চৌধুরী নামধারণ করেন। কালীকিশোর রায় চৌধুরী নারায়ণী দেবীর খুব আদরের নাতনী ছিলেন। তিনি উপযুক্ত শিক্ষালাভ করতে পারেন নাই বটে, তিনি জমিদার হিসেবে ধার্মিক ও দয়ালু বলে লোকসমাজে পরিচিত ছিলেন। কালীকিশোর আমহাটি নিবাসী অমরনাথ রায়ের কন্যা কমলমণি দেবীকে বিবাহ করেন।

নারায়ণী দেবী ৮৬ বছর বয়সে ২৪ বৈশাখ, ১২৪৬ বঙ্গাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। কালীকিশোর রায় চৌধুরী ১২৬২ বঙ্গাব্দে (১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে) কাশীকিশোর নামে এক পুত্রসন্তান ও দুই কন্যা (প্রসন্নময়ী ও জয়দুর্গা) রেখে নাসিরাবাদ শহরে মৃত্যুবরণ করেন। কাশীকিশোর রায় চৌধুরী পিতা কালীকিশোর রায় চৌধুরীর উত্তরাধিকার হিসেবে জমিদারি লাভ করেন। পৈত্রিক সম্পত্তির যথেষ্ট পুষ্টিসাধন করেন। জমিদারি কার্যের গতি পরিবর্তন করে তিনি জমিদারের আয় প্রায় দিগুণ করেছিলেন। কাশীকিশোর রায় চৌধুরী উনিশ শতকের জমিদারদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন। তিনি রাজদ্ধারে খুব সম্মানিত ছিলেন। কাশীকিশোর দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্ষমতাপ্রাপ্ত অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের পদে রামগোপালপুরে স্বাধীন বেঞ্চে ২২ বছর ধরে সুখ্যাতির সহিত কর্তব্য পালন করেছেন। তিনি ময়মনসিংহ জেলায় প্রথম শ্রেণীর অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট হন এবং তার বিচার সন্তুষ্ট হয়ে ছোট লাটবাহাদুর ১৮৭৭ সালে প্রসংশাপত্র দেন। তার সমস্ত গুণের জন্য ঢাকা কমিশনার তাকে রাজা উপাধিতে ভুষিত করার জন্য প্রস্তাব করেন। এ উপাধি গ্রহণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে বিনীতভাবে সাহেবকে জানান।

কাশীকিশোর রাজশাহী জেলার অন্তর্গত ছাতিনগ্রাম নিবাসী কৃঞ্চমোহন চৌধুরীর কন্যা হরসুন্দরী দেবীকে বিবাহ করেন। হরসুন্দরী দেবীর গর্ভে যোগেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী নামে এক পুত্র এবং রামরঙ্গিনী নাম্নী এক কন্যা জন্মে। কাশীকিশোর রামরঙ্গিনীকে কালীপুরের বিখ্যাত জমিদার ধরণীকান্ত লাহিড়ীর সাথে বিবাহ দেন। কাশীকিশোর রায় চৌধুরী ১২৯৪ বঙ্গাব্দের ১৫ আশ্বিন মৃত্যুবরণ করেন।

রামগোপালপুরের জমিদারি তালিকায় চতুর্থ পুরুষ রাজা যোগেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী:

যোগেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী ব্রিটিশদের কাছ থেকে ‘রাজা’উপাধি ও ‘অনারারি ম্যাজিস্ট্রেট’পদ লাভ করেন। তিনি ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় রীতিমতো শিক্ষা লাভ করেন। রাজা যোগেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী স্বভাবত ধার্মিক, সঙ্গীতানুরাগী, শিক্ষানুরাগী ও দানশীল ছিলেন। তিনি ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দে সাধারণ জ্ঞান বিস্তারের জন্য রামগোপালপুরে (পি.জে.কে. হাই স্কুল) একটি এন্ট্রেন্স স্কুল স্থাপন করেন। এ স্কুলের বার্ষিক খরচ ছিল তিন হাজার টাকা। কলতাপাড়া গ্রামে ’যোগেন্দ্রকিশোর ব্রাঞ্চ স্কুল’ নামে একটি বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সাধারণ প্রজাদের নিকট শিক্ষার পথ উন্মুক্ত করেছিলেন। ময়মনসিংহ শহরে দশ হাজার টাকায় জমি ক্রয় করে ’কাশীকিশোর টেকনিক্যাল স্কুল’নামে একটি শিল্প বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন (বর্তমানে এই জায়গায় শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ প্রতিষ্ঠিত)। এ শিল্প স্কুলের বার্ষিক খরচ ছিল দুই হাজার টাকা। তাছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বড় অংকের টাকা অনুদান দিয়েছেন।

সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশা ও জলকষ্ট নিবারণের জন্য তিনি প্রায় বিশ হাজার টাকা ব্যয় করেছিলেন। ইংরেজ সরকার ১৩০২ বঙ্গাব্দে যোগেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরীকে ’রায় বাহাদুর’উপাধি প্রদান করেন। ১২৮০ বঙ্গাব্দে যোগেন্দ্রকিশোর রাজশাহী জেলার অন্তর্গত হরিশপুর গ্রাম নিবাসী গঙ্গাগোবিন্দ রায়ের কন্যা রামরঙ্গণী দেবীকে বিবাহ করেন। রামরঙ্গণী দেবীর গর্ভে নগেন্দ্রকিশোর, যতীন্দ্রকিশোর, শৌরীন্দ্রকিশোর, হরেন্দ্রকিশোরসহ পাচঁ পুত্র এক কন্যা জন্মে। দ্বিতীয় পুত্র ও এক কন্যা অকালে মৃত্যবরণ করেন।

শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী বিদ্বান লোক ছিলেন। তিনি দুই খণ্ডের “ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার” শীর্ষক প্রামণ্য গ্রন্থের লেখক। বাংলা ১৩০৪ সালের ভীষণ ভূমিকম্পে যোগেন্দ্রকিশোরের সমস্ত গৃহ ভূমিষ্যাৎ হয়। এখনও পূর্ব জমিদারদের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে রয়েছে মন্দিরের সামনে চিকন ইটের প্রাচীন দেওয়াল বা বাউন্ডারি।

জমিদারদের ইতিহাস ও স্মৃতিচিহ্নগুলো বর্তমান সময়ের মানুষের চিন্তা চেতনাকে উন্মোচিত করে:

রাজনৈতিক উত্থান পতনের কারণেও গড়ে উঠে নতুন জনপদ কিংবা বিলুপ্ত হয় লোকালয়। আর এসবের পরিচয় বহন করে প্রত্ননিদর্শন। বর্তমানের মানুষকে প্রত্ননিদর্শন নিয়ে যায় ইতিহাসের কাছে। এজন্য প্রত্ননিদর্শন হলো ‘ইতিহাস ঐতিহ্যের শেকড়’। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা এক হিন্দু জমিদারের দত্তকপুত্ররূপে যুগলকিশোর রায় চৌধুরী ইতিহাসের অনেক কথাই আমাদের অজানা ছিল, এমনই এক অজানা ইতিহাস আমাদের সামনে তুলে এনেছেন ভারতীয় ইতিহাসের গুরুনায়ক অধ্যাপক অমলেন্দু দে। যুক্তি প্রমাণ ছাড়া যারা এ বিষয়ে সন্দিহান থাকবে, রামগোপালপুর জমিদারির উৎপত্তির ইতিহাস পড়ে মনে হবে এই কাহিনী সত্য হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া ময়মনসিংহের ইতিহাসের পাতায় বারোভূঁইয়ার অধিনায়ক ঈশা খাঁ, পাঠান সর্দার রোমান্টিক হিরু খাজা উসমান খাঁসহ যারা আলোচিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে যুগলকিশোর রায় চৌধুরী একজন। যুগলকিশোরের মাধ্যমে মোমেনসিং পরগনা থেকে মোমেনসিং উপ-প্রদেশ ও মোমেনসিং বৃহত্তর জেলা পরিণত হয়েছে। গৌরীপুর, গোলকপুর, কালীপুর ও রামগোপালপুরের নামকরণ তার আমলে হয়েছে। কারণ, যুগলকিশোরের নেতৃত্বে জামালপুর জেলার অন্তর্গত কৃষ্ণপুর এলাকার জমিদারগণ গৌরীপুরে আগমন করেন।