গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত একুশে পদক এবং বাংলা একাডেমির ফেলোশিপ প্রাপ্ত লালনপন্থী সাধক কবি সংগীত গুরু ও শিল্পী খোদাবক্স সাঁইয়ের ৩৪তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আজ ১৫ জানুয়ারি ২০২৪ সোমবার চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার জাহাপুর গ্রাম খোদাবক্স সাঁই নিকেতনে ২৪ ঘন্টাব্যাপী সাধুসঙ্গের আঙ্গিকে একটি স্মরণোৎসব অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক ড, কিসিঞ্জার চাকমা। এছাড়াও উপস্থিত থাকবেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের খ্যাতিমান সাধুগুরু, লেখক, গবেষক, অনুবাদক ও শিল্পী বৃন্দ। আলমডাঙ্গা উপজেলার জাহাপুর গ্রামে বাংলা ১৩৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন ক্ষণজন্মা সাধক পুরুষ একুশে পদকপ্রাপ্ত খোদাবক্স শাহ । তিনি ঘোলদাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর তিনি অভিনয় ও সঙ্গীতে আকৃষ্ট হয়ে যাত্রাদলে যোগ দেন। তার ছিল অসাধারণ সুরেলা কন্ঠ। ১৬ বছর বয়স পর্যন্ত যাত্রা দলে তার সঙ্গীত জীবন অতিবাহিত হয়। ১৭ বছর বয়সে খোদাবকশ ভাবসঙ্গীত শিক্ষায় আগ্রহী হয়ে ঝিনাইদহের হরিনাকুন্ডুর শুকচাঁদ শাহ এর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং অমূল্য শাহ‘র আখড়ায় অতি অল্প সময়ে তিনি ভাবসঙ্গীতে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। তিনি ফকির লালন শাহের চতুর্থ তম স্তরের সাধক । তার জীবদ্দশায় তিনি ৯৫০ টি এর অধিক গান রচনা করেছেন। কথিত আছে তার মানস পটে তিনি ২০০০ এর অধিক গান মুখস্থ রেখেছিলেন । তাছাড়া তিনি ১০৪ জন মহৎ এর গান জানতেন ।
তার কর্মময় জীবনে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় শিল্পকলা একাডেমীতে ৫ বছর লালন সংগীতের প্রভাষক হিসেবে চাকুরী করেন। তিনি লালন পরিষদ কেন্দ্রীয় সংসদ থেকে প্রকাশিত লালন সংগীত স্বরলিপি গ্রন্থের ২৫ টি গানের স্বরলিপি সম্পন্ন করেন। গ্রন্থটি ১৯৮৬ সালের ৩১ মার্চ প্রকাশিত হয়। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমী লালন সংগীত বিশারদ হিসেবে তাঁকে ফেলোশীপ প্রদান করেন। ফেলো সংখ্যা-১৫৮। ১৯৮৩ সালে ১৫ জানুয়ারী ইছাপুর অনুশীলনী পাঠাগার তিনাকে সনদ পত্র প্রদান করে। পৌর প্রধান উত্তর ব্যারাকপুর, পৌরসভা ২৪ পরগনা)। এছাড়াও ঐ একই সালের পৌষ মেলা উপলক্ষে শান্তি নিকেতন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সনদ পত্র প্রদান করে। ১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেডিও বাংলাদেশ কর্তৃক গুণীজন সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে সনদ পত্র প্রদান করা হয়। এছাড়াও বাংলা ১৩৯০ সালের ১৬ মাঘ চতুর্থ জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মেলনে তাঁকে গুণীজন সম্বর্ধনা দেয়া হয়। শুধু তিনি মুঠো মুঠো পুরস্কারই পাননি, তিনিও দিয়েছেন অনেক। তিনি একাধারে বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী জাতীয় প্রেস ক্লাব, আকাশবানী ও দূরদর্শনে সংগীত পরিবেশন করে দেশ তথা ভারত বর্ষের সূধীজন, বুদ্ধিজীবি সকলকে বিমোহিত করেছিলেন। ১৯৭৬ সালে তিনি ফকিরি পোষাক গ্রহণ করেন। ১৯৮৩ সালের ৯ জুন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে লালন সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৮৫ সালে বাংলা একাডেমি খোদাবকশ শাহকে বাংলা একাডেমি ‘ফেলো’ পদ প্রদান করে। ১৯৮৬ সালে তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ১৯৮৭ সালের ৩১ মার্চ তিনি শিল্পকলা একাডেমির চাকরী ছেড়ে নিজের আখাড়ায় ফিরে আসেন।
তার আত্মজীবনী তে তিনি নিজের সম্বন্ধে বর্ণনা করেছেন যে, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবনের সূচনাতেই তথা ৫ম-৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময় এলাকায় আসা লেটো দলে যুক্ত হন। পরে যাত্রাদলে বিবেকের ভূমিকায় অভিনয়ে যুক্ত হবার কথাও বর্ণনা করেছেন। পরবর্তীকালে যাত্রাদল ভেঙে গেলে নাটকীয়ভাবে নিজের এলাকায় একটি আসরে গিয়ে তিনি আকৃষ্ট হন বাউলগানের পরিবেশনে। সেখানে সাক্ষাৎ পান এলাকার সবচেয়ে বিখ্যাত বাউল গানের সাধক শিল্পী অমূল্য শাহ, বেহাল শাহ ও শুকচাঁদ শাহের। যখন তিনি তাঁদের নিকটে বাউলগান শেখার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন তখন জানতে পারেন বাউল-সাধনায় কোনো গুরুর শিষ্যত্ব না নিয়ে এই গান গাওয়া যায় না। সহসা তিনি সেই দিনই শুকচাঁদ শাহের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং বাউলগান শিখতে শুরু করেন। কিন্তু গুরুবাদী ধারায় শিষ্যত্ব নিয়ে বাউলগান শেখা ও পরিবেশনের সঙ্গে যুক্ত হবার পর খোদাবক্স সাঁইকে বেশ কয়েকবার সমাজচ্যুত হতে হয়েছিল। তার প্রমাণ রয়েছে এই আত্মজীবনীর পরের অংশে। যেখানে খোদাবক্স সাঁই লিখেছেন, পরবর্তীকালে প্রায় ১২ বছর ধরে সমাজের মানুষের কাছে নানাবিধ অত্যাচারের শিকার হয়েছেন এবং শেষে সমাজের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে অন্তত চার চারবার তাদের ডেকে খাওয়াতে হয়েছিল। এরপর তিনি সমাজের মানুষের কাছ থেকে বিবাহ করার অনুমতি পান। সমাজের মানুষের সেই অমানবিক ও নিষ্ঠুর ব্যবহারের পরও খোদাবক্স সাঁই গুরুবাদী ধারায় নিজের সাধন ও সংগীত জীবন ছাড়েননি। তিনি লিখেছেন প্রায় ৩৬ বছর ধরে তিনি দাস্যভাবে সাধুগুরুদের সঙ্গে সাধন ও সংগীত জীবন অতিবাহিত করেছেন।
‘আমার সংক্ষিপ্ত জীবনী ও ইতিহাস’-এ নিজেকে ‘সংসারি বাউল’ হিসেবে উল্লেখ করে পারিবারিক জীবনে স্ত্রী, কন্যা, পুত্রের নাম ও পরিচয় দিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি স্ত্রী সম্পর্কে লিখেছেন-‘আমার স্ত্রীর নাম রাহেলা খাতুন। আমার সকল কর্মের প্রাণসম সাহায্যকারী।’ ১৯৮৯ সালের শেষ দিকে তিনি ভীষণ অসুস্থ্য হয়ে পড়েন এবং ১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারী (১ মাঘ ) তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। নিজস্ব আখড়া বাড়িতে তাকে সমাহিত করা হয়।
১৯৯০ সালে বাংলাদেশ সরকার তার মৃত্যুর ১মাস ৭ দিন পর তাঁকে বাংলা একাডেমী মরণত্তোর একুশে পদকে ভূষিত করে।
abdulla/saha alam montu