একাই একটা চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউট এবং সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র আরীজ রাজ বীরজান

আলাউদ্দিন আহমেদঃ  তিনি একাধারে একজন চিত্রনায়ক, চিত্রনাট্যকার, গীতিকার, গল্পকার,কবি,আবৃত্তি শিল্পী,সাংবাদিক,আলোকচিত্রী, চলচ্চিত্র পরিচালক, চলচ্চিত্র শিক্ষক ও গবেষক, এক কথায় বলতে গেলে উনি একাই একটা চলচ্চিত্র ইনস্টিটিউট এবং সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র।

গত ৪ মাস আগে এফডিসিতে “শেষের কবিতা” নামক  সিনামার শুটিং চলাকালিন সময়ে আমি গিয়েছিলাম তাঁর শুটিং টেকনিক দেখার জন্য। কারন আমি শুনেছিলাম তিনি নাকি ক্যামেরার জাদুকর।যেখানে অন্যান্য ছবির শুটিং, লাইট,ট্রোলি,ক্যেন,জিবার্ম ও অন্যান্য যন্ত্রপাতিতে সয়লাভ থাকে। সেখানে বীরজান সাহেব শুধু ক্যামেরাদিয়ে প্রাকৃতিক আলোতেই রিফ্লেক্টোর বোর্ড ছাড়া এমন কি কনো প্রকার আলাদা যন্ত্রপাতি ছাড়াই অবলিলাক্রমে শুটিং করে যাচ্ছেন। তাঁর কথা উঠতেই মিডিয়ার সকলেই বলে উনি হলেন ক্যামেরা ও অভিনয়ের জাদুকর। যিনি নিজে একা একশত জনের ইউনিট কে  পরিচালনা করেন। তার ইউনিটে সবসময়ই সুনশান পরিবেশ বিরাজ করে বলে শুনেছি।আমি স্পটে উপস্থিত হয়ে তাই দেখলাম। তিনি তখন ক্যামেরার সামনে অভিনয় করছিলেন। সংলাপটা আজো আমার কানে বাজে। এতো অসাধারণ ভাবে সংলাপ ডেলিভারী দিলেন,যাঁরা শুনেননি তাদেরকে ঠিক বুঝাতে পারবো না।

ক্যামেরার পিছনে দাঁড়িয়ে বীরজান সাহেবের অভিনয় আর ডায়লগ ডেলিভারী দেখে এতটাই মুগ্ধ হলাম যে সংলাপ আর অভিনয় মনে গেঁথে গেল।(আর তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম ওনার একটা সাক্ষাৎকার নিব।)

হলো “মেনে নেয়া, আর মনে নেয়া এক কথা নয়”। সংলাপটি শেষ হতেই তার যে মুখের ও চোখের কোনে জমে থাকা চিক চিক করা চোখের জল আঁটকে রাখা সত্যিই অভিনয়ের জাদুকর নাহলে সম্ভব হতো না। পেছনে নায়িকা জয়া জুবান ভুলে  গেছেন তাঁর সংলাপ। পরোক্ষনে নায়িকা sorry sorry বলে ক্ষমা চাইলেন, আর বলেন আমার কোনো দোষ নেই, আমি বীরজান ভাইয়ের অভিনয়ের ইন্দ্রজালে আটকে নিজের সব ভুলে যাচ্ছি। তারপর টানা সাত থেকে আটবার একি টেক দিয়ে গেলেন নাইকার ভালো অভিনয়ের জন্য।কিন্তু তাঁর  মুখে একটু বিরক্তির ছাপ দেখতে পাইনি। তার শট শেষে আমাকে দেখতেই স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বরন করে নেন আমাকে এবং বলেন আমার আজকে দুটো সাক্ষাৎকার আছে, শুটিংয়ের ফাঁকে ওদের একটু সময় দিতে হবে।আমি বললাম ওদের সাথে  আমিও ২-১টা প্রশ্ন করতে চাই।উনি হেসে বললেন ঠিক আছে।”রাজিবুল হক রনি” এই আমার দেশ১.প্রশ্নঃ-নিজেকে কোথায় দেখতে চান?উাত্তরঃ_সবার অন্তরে।২.প্রশ্নঃ-আপনার তো সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সব শাখায় বিচরণ, কোন পরিচয়ে আপনি তৃপ্ত?উত্তর- অবশ্যই অভিনয় শিল্পী হিসাবে।৩.প্রশ্নঃ-কেনো?উত্তর-আমার মা সবসময় স্বপ্ন দেখতেন আমি হবো মহা নায়ক উত্তম কুমার ও মারলন ব্রানডোর মতো। তো ছোট থেকেই আমার মা আমাকে সেভাবেই গড়ে তুলেছেন।৪.প্রশ্নঃ- তা হলে আপনার মা-ই আপনার সব। মায়ের স্বপ্ন আপনার স্বপ্ন?উত্তর- হে আমার মা বাবা আমার পরিবারি আমার সব, আমার মায়ের বয়স ৭৮ তিনি অনেক স্কুল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রিন্সপাল ছিলেন,তাঁর অনেক ছাত্র- ছাত্রী দেশের অনেক বড় অবস্থানে আছেন। যখন উনাদের সাথে আমার মা-র  দেখা হয়। তখন উনারা যে সম্মান মা কে করেন তাতে আনন্দ অশ্রু চলে আসে(বীরজান সাহেবের চোখে পানি)। তবে এবার একেবারেই স্বভাবিক ভাবে চোখের জল গড়িয়ে পড়ে পরে মাটিতে।৫.প্রশ্নঃ- কিন্তু আমরাতো জানি আপনার বাবা বিশ্বখ্যাতো আলোকচিত্রী,চিত্রশিল্পী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সহ বহু গুণে গুণান্বিত “বি,পি,কে” অলোক শাইর।তাই আপনিও আলোকচিত্রের আর তার সব গুণগুলো নিয়ে নিলেন? জাদুকর হয়ে গেলেন?উত্তর- আসলেই বাবা-মা ই আমার সব তাঁরাই আমার আদিগুরু। আসলে আমি অন্য কিছু করার চেষ্টা করেছি কিন্তু মনে বারবার বাবা-মার আদর্শ কে ধারন করেছি,৬.প্রশ্নঃ-ঈশ্বর প্রদত্ত গুন ছাড়া এতোটা কেউ পারেনা,এটা মানেন?উত্তর-আমার বাবা মাকেই ঈশ্বর মানি।৭.প্রশ্ন-বাবা মা এর কোনদিকটা আপনি গ্রহণ করেছেনউত্তরঃ-সততা,বিনয়,কর্ম নিষ্ঠা ও মানব সেবা।৮.প্রশ্নঃ- এর করনেই কি আপনি এতো বিনয়ী এবং সৎ? উত্তর-লজ্জিত হাঁসি দিয়ে এটাতো আমি জানিনা,তবে অসৎ কিছু ঘৃণা করি।৯.প্রশ্নঃ-মিডিয়ার অস্থির রেট’রেইসে আপনাকে পাই না কেনো?উত্তরঃ-শিশুকাল থেকে আমার মা আমাকে মেডিটেশন শিখিয়েছেন আর বলেছেন মনছবি স্থির করার জন্য। বলেছেন প্রতিযোগিতা করো নিজের সাথে সেরা হবার জন্য কিন্তু  সবসময়  প্রথম হওয়ার জন্য নয়। বলতেন তোমার যা ভালো কিছু তা সবসময় চর্চা করো। কিন্তু পরচর্চা একদম নয়। ওনার মতে সুন্দর চেহারার চেয়ে সুন্দর কাজ বেশি দামি।আর আমি আমার মাকে গ্রহণ করেছি মনে প্রাণে।১১.প্রশ্নঃ- আমাদের দেশে বেহাল দশা থেকে সিনামার উত্তরণ কিভাবে সম্ভব?উত্তরঃ-নকলবাজি ছেড়ে আমাদের সমৃদ্ধ সাহিত্য ও জীবন নির্ভর সরল সহজ সুস্থ সিনামা বানাতে হবে। সেখানে মা-বাবা,ভাই-বোন একসাথে সিনামা দেখতে পারা যাবে।  আর আধুনিক প্রযুক্তির দিকে দ্রুত নয় ধিরে ধিরে অগ্রসর হবে একের পরে এক। এক থেকে  দুই, কিন্তু একথেকে একশ এক লাফে নয়। আর খুব দ্রুত শর্ট পরিবর্তন থেকে বিরত থাকতে হবে। এক্ষেত্রে সত্যজিৎ রায়ের ছবি ও বর্তমান ইরানি সিনামা উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে। এটা সম্পুর্ণ আমার মত।১২.প্রশ্নঃ-তাহলে কি আমরা মর্ডান সিনেমা বানাবো না?উত্তরঃ-কেন নয়? তবে আগে আমাদের উচিৎ নিজেকে চেনা, নিজের সাইন তৈরি করা পরেরটা পরে।১৩.প্রশ্নঃ- এখন যাকে তাকে ধরে অভিনেতা বানিয়ে দিচ্ছে, এ বিষয়ে আপনার মত কি?উত্তরঃ-এগুলো হয়েছে হবে আর এটাও অধঃপতনের কারণ।মনে রাখতে হবে সাইক্লোন বা ভূমিকম্প হটাৎ এসে চলে  যায় কিছু ধ্বংসাবশেষ রেখে যায়।(হটাৎ বীরজান সাহেবের শুটিং এর ডাক আসে এর মাঝে আমি শেষ প্রশ্নটি করি)১৪.প্রশ্ন: দেশ ও জাতির জন্য আর ব্যক্তি বীরজানের চিন্তা চেতনা কি?উত্তরঃ-প্রতিটি মানুষের মুখে খাবার থাকবে,হাসি থাকবে,মা বা ও গুরুজনের প্রতি ভক্তি থাকবে। আর সত্যটাকে গ্রহণ করবে। সত্য বলার জন্য কোনো শিশুকে তার মা-বাবা ও প্রিয় জনরা নির্যাতন করবে না। সত্য বলার জন্য  পুরস্কৃত করবে ও ধর্ম মতে শিশুকাল থেকে  চলতে শিখাতে হবে।একটি নতুন সবুজ সুন্দর আলোকিত পৃথিবীর মুখ দেখুক প্রতিটি শিশু। আমি যাচ্ছি নতুন নিউরনের ভিতরে যেখানে নিজের  জিনটাকে মুক্ত করে দিচ্ছি মুক্ত আকাশে বাতাসে।