ইসলামিক স্কলার ব্রাদার রাহুলের আত্মকথন- রফিকুল ইসলাম


ব্রাদার রাহুল ওরফে রাহুল হোসেন ওরফে রুহুল আমীন ভারতের মুর্শিদাবাদের অধিবাসী। তিনি একজন তরুন ইসলাম প্রচারক। বিগত কিছু দিনে তিনি বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের সাথে তুলনামূলক বিতর্কে অংশগ্রহণ করে বেশ সাড়া জাগিয়েছেন। এছাড়া অনলাইনে রয়েছে তার সরব পদচারণা। বিহার, ঝাড়খন্ড, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি এখন নিয়মিতভাবে জালসা ও ওয়াজ মাহফীলে অংশগ্রহন করে থাকেন। তাঁর মতাদর্শে তিনি দ্বীনের খাদেম হিসেবে এগিয়ে যেতে চান আরও অনেক দুর। সার্টিফিকেট অনুযায়ী তাঁর নাম রাহুল হোসাইন। তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্টেও এই নাম রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মাওলানা আব্দুল্লাহ সালাফী তাঁর নাম রুহুল আমীন রাখেন। এজন্য তিনি দু’টি নামই ব্যবহার করেন। তিনি বলেন ‘ব্রাদার’ লকব ইন্ডিয়াতে যথেষ্ট ব্যবহৃত হয়। তাঁর মতেই জেনারেল শিক্ষিত যারা ডা. জাকির নায়েকের ধর্মপ্রচারে অনুপ্রাণিত হয়ে দ্বীনের খেদমতে আত্মনিয়োগ করেছেন তারা অনেকেই ‘ব্রাদার’ লকব ব্যবহার করেন। মাদ্রাসার প্রথাগত শিক্ষালাভ না করা এমন প্রায় দশজন ভাই ভারতে রয়েছেন। যেমন- হায়দারাবাদে আছেন ব্রাদার ইমরান, কেরালায় ব্রাদার এমএন আকবার। অপরদিতে ব্রাদার সিরাজুর রহমান ও ব্রাদার শাফী রয়েছেন যারা যথাক্রমে তেলেগু ও মালালায়ম ভাষায় ইসলাম প্রচার করেন। এছাড়া আরও রয়েছেন ব্রাদার নাছিরুদ্দীন ইবনু মঈনুদ্দীন, এ্যাডভোকেট ফায়েয সাহেব প্রমুখ। সচরাচর তিনি উল্লেখিত ব্যক্তিবর্গের মতাদর্শ অনুসরণ করেন।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলার জলঙ্গী গ্রামে ১৯৯২ সালে তাঁর জন্ম, বাবার নাম বেলায়েত হুসাইন ও মায়ের নাম রহীমা বিবি, তাঁরা দুই ভাই ও দুই বোন। তাঁর ছোট ভাইয়ের নাম আব্দুর রাজ্জাক (রাজা) সৌদি আরবে থাকেন। আর পরিবারে ব্রাদার রাহুল তৃতীয়। মূলতঃ মুসলিম পরিবারেই জন্মগ্রহণ করেছেন কিন্তু তাঁর বাবা পূর্বে সনাতন ধর্মাবলম্বি ছিলেন। তার নাম ছিল বিমল দাস। পরে তাঁর মায়ের সাথে বিবাহের পূর্বে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তবে রাহুলের পরিবারে ইসলামের কোন চর্চা ছিল না। তিনি নিজে কখনও ঈদ ছাড়া ছালাত আদায় করেননি, কেননা তাঁর পিতা হিন্দু পরিবারের সদস্য ছিল বিধায় মাসী, পিশী সকলেই হিন্দু।
২০১২ সালে ডাঃ জাকির নায়েক সম্পর্কে তাঁর আগ্রহ জন্মায়। তিনি তখন তাঁর ‘কুরআন এন্ড মডার্ন সায়েন্স’ বক্তব্যটি শোনেন। পরবর্তীতে তাঁর অন্যান্য প্রায় সকল বক্তব্য তিনি শোনেন। তাঁর মাধ্যমেই তিনি ইসলাম ধর্মের প্রতি উৎসাহিত হন এবং মনে মনে দাওয়াতের বীজ বপন করতে শুরু করেন। বক্তব্য প্রদানের অভ্যাস স্কুলজীবন থেকেই ছিল। ফলে সাহস করে একদিন কলেজের এক অনুষ্ঠানে ‘কনসেপ্ট অফ গড’ বিষয়ে বক্তব্য প্রদান করেন। যেখানে অধিকাংশ শ্রোতাই ছিল হিন্দু। সেসময় উপস্থিত শ্রোতাদের মাঝে তাঁর বক্তব্য বেশ সাড়া পড়ে। এতে স্কুলে হিন্দু-মুসলিম সংঘর্ষ বাঁধার ভয়ে কর্তৃপক্ষ ধর্মীয় পূজা/জলসা/বক্তৃতা সবই বন্ধ করে দেয়। কেননা ভারতের সরকারী আইন অনুযায়ী কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষ কোন ধর্ম চর্চা নিষিদ্ধ। ফলে তখন থেকে ওই স্কুুলে পূজার কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়। সেই থেকে তাঁর প্রথম সফলতার সূত্র। তিনি দ্বীনের খেদমতে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং ব্যাপকভাবে পড়াশোনা শুরু করেন। তাঁর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি মূলত গ্রামের প্রাইমারী স্কুল ও হাই স্কুলে। এরপর ২০১৬ সালে নদীয়া জেলার কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতক (বিএ) সম্পন্ন করেন।
২০১৫ সালে মূলত তিনি পাবলিক লেকচার শুরু করেন, সে বছরেই ২৭টি প্রোগ্রামে বক্তব্য দেন। তখন হিন্দুধর্ম সম্পর্কেই বক্তব্য দিতেন কিন্তু শিরক-বিদআত বুজতেন না। তখন এইটুকুই বুজতেন যে কেবল মূর্তিপূজা হলো শিরক। আসলে তিনি হিন্দুদের সাথে বাহাছ-মুনাযারা করার জন্য তাদের গ্রন্থগুলো পড়তেন। কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করেননি। বিশেষ করে ধর্ম পালনে ডা. জাকির নায়েকের অনুসরী ছিলেন। তারপর থেকে ইন্টারনেট ভিত্তিক কুরআন ও হাদীছ পড়া শুরু করেন। এসময় ডা. জাকির নায়েকের বক্তব্যগুলো থেকে বিশেষভাবে উপকৃত হন। এভাবে তাঁর ইসলাম সম্পর্কে জানার দরজা খুলে যায়।
ভারতে নবম-দশম ও একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীতে সংস্কৃত পড়ানো হয়। সেখান থেকেই মূলত সংস্কৃত শেখা। আর সংস্কৃত শ্লোকগুলো তিনি গীতা বা বেদের প্রকৃত ছন্দে ও আবৃতিতে পড়ে থাকেন যা ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন মাধ্যমে শিখেছেন। হিন্দু ধর্মের চার খানা বেদ, আঠারটি উপনিষদ, আঠারটি পুরাণ পড়েছেন, এছাড়া মনুসংহিতা, যা ফিকহ গ্রন্থের মত এবং গীতার প্রায় পয়ত্রিশখানা ব্যাখ্যা পড়েছেন যা ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। সেই সাথে খৃষ্টানদের বাইবেলও পড়েছেন। কুরআন পড়ার আগে হিন্দু ও খিস্টানদের ধর্মগ্রন্থই প্রথমে পড়েছেন।
বাংলাদেশে প্রথম ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর প্রোগ্রাম ঠিক করেছিলেন মাদারীপুর জেলায়। কিন্তু অনাকাঙ্খিত কারণে প্রোগ্রামটি হয়নি। অতঃপর ঢাকার সুরিটোলা আহলে হাদীছ মসজিদে ‘গুলু ফিদ দ্বীন’ বিষয়ে সর্ব প্রথম বক্তব্য রাখেন। রাহুল হোসাইন নিজেকে আহলে হাদীছ বলতে বা দাবী করার ক্ষেত্রে জানতে চাইলে তিনি জানান, নিজেকে সবসময়ই আহলে হাদীছ হিসাবে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি, আর এ বিষয়ে বইও লিখেছি ‘আহলে হাদীছ ও হানাফী মাযহাব : ইখতিলাফ নিরসন’ শিরোনামে। সম্মিলিত দোয়া’র ব্যাপারে বিভিন্ন জায়গায় তাঁর সাথে মুনাযারা হয়। তিনি কুরআন ও হাদীছ থেকে দলিল দেওয়ার পূর্বে বিরোধীদের বই দিয়েই তাদের জবাব দিয়ে থাকেন। সুতরাং এ বিষয়ে বিরোধীদেরই বিতর্কের সুযোগ নেই।
জঙ্গীবাদ নিয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন যে, জঙ্গীবাদ ইসলাম সমর্থন করে না বরং জঙ্গিবাদ নির্মূল করাই এর কাজ। জিহাদ ও জঙ্গীবাদের মধ্যে আকাশ-জমীন পার্থক্য রয়েছে। জিহাদ ইসলামে ফরয আর জঙ্গীবাদ ইসলামে হারাম। যেমন- ভারত হল তাঁর নিকট দারুদ দাওয়াহ; দারুল কুফফার নয়। যদিও ভারতে প্রায় আশি ভাগ মানুষ অমুসলিম, জিহাদ হবে দাওয়াতের মাধ্যমে, অস্ত্রের মাধ্যমে নয়। অতএব প্রচলিত জঙ্গীবাদ মূলত সন্ত্রাসবাদ, যা প্রকৃত মুসলমানের কখনো কাম্য নয়।
‘আহলে হাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ কি ধারণা রাখে জানতে চাইলে তিনি বলেন যে, বাংলা ভাষাভাষী মানুষের জন্য হক্বের সবচেয়ে নিকটবর্তী যদি কোন সংগঠন থাকে তা হল ‘আহলে হাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’। ভারতে এই সংগঠনটির প্রভাব অনেক বেশী। হাদীছ ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন বই, লিফলেট, প্রকাশনা, জুমআর খুতবা, লেকচার ইত্যাদি পশ্চিমবঙ্গের মানুষের মাঝে ব্যাপকভাবে সুপরিচিত। বিশেষ করে ‘ছালাতুর রাসূল (সাঃ)’ বইয়ের কথা বলাই বাহুল্য। এই বইটির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। তিনি নিজেও বইটি প্রচুর পরিমাণে প্রচারণার জন্য বিলি করেছেন। ‘আহলে হাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর সাংগঠনিক কর্ম পদ্ধতি পশ্চিমবঙ্গেও অনুসরণ করার চেষ্টা করেন। পাঠকদের উদ্দেশ্যে বলেন, সবাইকে দাওয়াতী ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। যার লেখার সামথর্য আছে লিখবে; যার বলার সামথর্য আছে বলবে; যার অর্থ আছে সে অর্থ দিয়ে দ্বীন প্রচারে সার্বিক সহযোগিতা করবে। আর যার কিছুই নেই সে অন্ততঃ রাস্তায় দাঁড়িয়ে দ্বীনী লিফলেট বিলি করে হলেও দ্বীন প্রচারে সাহায্য করবে। তিনি বলেন, প্রমাণ স্বরুপ উল্লেখ করা যায় সূরা তাওবার ২২ নং আয়াত, যেখানে বলা হয়েছে যে, তোমরা কেউ জিহাদে যাবে আবার কেউ দ্বীনের জ্ঞান অর্জন করবে। আর নাসাঈতে ছহীহ সনদে একটি হাদীছে এসেছে এ মর্মে যে, সামর্থহীন একজন ব্যক্তি জিহাদে যাওয়ার কথা বললে রাসূল (সাঃ) বলেন, যাও তুমি উটের রশিটা বেঁধে দাও। তোমার জন্য এটাই জিহাদের নেকী। এ সকল দলীল থেকে এটাই বুঝা যায় যে, ব্যক্তির সাধ্যানুযায়ী দ্বীন প্রচারে সাহায্য করবে।

(দৈনিক এই আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, দৈনিক এই আমার দেশ কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার দৈনিক এই আমার দেশ নেবে না।)