ইতিহাসের পাতায় ৫ মার্চ, ১৯৭১

বিশেষ প্রতিনিধি : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে ১৯৭১ সালের মার্চের পঞ্চম দিনেও বিক্ষোভে, বিদ্রোহে উত্তাল ছিল সারা পূর্ববাংলা। মার্চের এইদিনে জনতার ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে সারাদেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। গোটা পূর্ববাংলার সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পরিচালিত হচ্ছিল। তার নির্দেশ ছাড়া অফিস, দোকানপাট, ব্যাংক-বীমা কিছুই চলছিল না। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধিকার আন্দোলনে অংশ নেওয়া লাখ লাখ বাঙালির স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বস্তুত পূর্ববঙ্গ সরকার অকার্যকর হয়ে পড়েছিল।

পঞ্চম দিনের মতো হরতাল পালনকালে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের গুলিতে টঙ্গী শিল্প এলাকায় ৪ জন শ্রমিক শহীদ হন এবং ২৫ জন শ্রমিক আহত হন। এ সংবাদে ঢাকাসহ সারাদেশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। জনরোষের মুখে সন্ধ্যায় সরকারিভাবে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নেবার ঘোষণা দেওয়া হয়।

ঐতিহাসিক মার্চের এইদিনে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণাকে বেলুচিস্তান ন্যাপ অবাঞ্ছিত ও অগণতান্ত্রিক ঘোষণা করে। এদিকে, পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোরে দেশের পূর্বাঞ্চলে সামপ্রতিক আন্দোলনে নিহত শহীদদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং সঙ্কটময় মুহূর্তে দেশের সংহতির জন্য বিভিন্ন মসজিদে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়।

এদিন আওয়ামী লীগের তত্কালীন সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দিন আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর, সিলেটসহ বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে মিলিটারির বুলেটে নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষ, শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্রদের হত্যা করা হচ্ছে। নির্বিচারে নিরস্ত্র মানুষকে এভাবে হত্যা করা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ছাড়া আর কিছুই নয়।

বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে হরতালের পর ব্যাংক ও রেশন দোকান খোলা থাকে। মসজিদে মসজিদে জুমার নামাজের পর শহীদানের আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিবাদ সভা ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধিকার আন্দোলনের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিকালে কবি, সাহিত্যিক ও শিক্ষকবৃন্দ মিছিল নিয়ে রাজপথে নেমে আসেন। ছাত্রলীগ ও ডাকসুর উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম থেকে মিছিল বের হয়।

এদিন অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান বিকালে করাচি থেকে ঢাকায় পৌঁছান। তিনি রাতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ধানমন্ডির বাসভবনে সাক্ষাত্ করেন। বৈঠক শেষে আসগর খান মন্তব্য করেন সংখ্যাগুরু দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশের সংহতি রক্ষা করা অপরিহার্য বলে মনে করেন তিনি।

এদিকে, মাওলানা গোলাম গাউস হাজারি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সব নির্বাচিত সদস্যের পক্ষ থেকে ভুট্টোর কথা বলার অধিকার নেই। অবিলম্বে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি। কিন্তু তত্কালীন পাক শাসকগোষ্ঠী এসব নেতার কারো বক্তব্যকেই গুরুত্ব দেয়নি।

বরং পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে পার্টির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা মন্তব্য করেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া যেভাবেই বিচার করা হোক না কেন, তা অত্যন্ত অবাঞ্ছিত এবং আদৌ যুক্তিযুক্ত নয়।

এগারো দফা আন্দোলনের অন্যতম নেতা তোফায়েল আহমদ ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দান থেকে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি রিলে করার জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানান। রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশি বেতারে প্রচারিত ‘শেখ মুজিব জনাব ভুট্টোর সাথে ক্ষমতা ভাগ বাটোয়ারা করতে রাজি আছেন’ সংক্রান্ত সংবাদকে ‘অসত্ উদ্দেশ্যমূলক’ ও ‘কল্পনার ফানুস’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন।