নারী দিবস এবং অতিপৌরুষ

বিশেষ প্রতিনিধি : নারী কি? এ প্রশ্ন যদি আপনাকে ,আমাকে কিংবা যে কাউকেই করা হোক না কেন কতগুলো গতানুগতিক উত্তর পাবেন যেমন- মা, স্ত্রী, কন্যা, বোন, বান্ধবী । আবার অনেকেই কিছুটা রস মিশিয়ে বলবেন নারী লাস্যময়ী, ছলনাময়ী, হাস্যময়ী। কিন্তু প্রথম উত্তরে কেউ নারীকে মানুষ বলেছে এমনটা বোধহয় হয়নি কখনো।

এই নারীদের সমাজে অবস্থান কোথায়? একটু ভেবে দেখুন পৃথিবী আজ কত উন্নত,যেদিকে তাকাবেন দেখবেন এই বিশ্বায়নের সাথে কেমন মিশে আছে নারী। টিভি খুললেই যত অ্যাড, যত প্রোগ্রাম সেখানে নারী, টিভিরবাইরে শহরের রাস্তায় হাটবেন দেখবেন দোকান, দেয়াল, বিলবোর্ড এমনকি ডাস্টবিনে যে কাগজটা ছিরে পরে আছে তাতেও নারী। এই কি নারী জাগরণ, নারী মুক্তি? একটু ভালো করে তাকালেই দেখবেন এই রংচঙে মুখোশের আড়ালে নারী রয়ে গেছে সেই প্রাচীন বর্বর যুগে, ভোগ্য পণ্য হিসেবে, নারীর অবস্থান থেকে গেছে ওই ডাস্টবিনের ছেড়া কাগজের মতো।

নারী শ্রমিকরা যে কর্মদিবস, ন্যায্য মজুরি ও কল-কারখানায় কাজের পরিবেশের উন্নতির জন্য রাস্তায় নেমেছিল, মিছিল করেছিল, দাঁড়িয়ে ছিল বন্দুকের নলের সামনে সেই নারী পরে ভুলে গেছে তার সেই উদ্দ্যামতা। তার পূর্বে নারী মুক্তির জন্য লিখেছিলেন ম্যারি ওল্ডস্টোন ক্র্যাফট , প্রতিবাদ করেছিলেন ভার্জিনিয়া উলফ , ইবসেনের এ ডলস হাউস এর মতো সাহিত্যে এসেছে যে নারী মুক্তির কথা কিংবা আমাদের বেগম রোকেয়ার হাত ধরে যে নারী মুক্তির ইতিহাস রচিত হয়েছিল সেই ইতিহাস পরিমানে এতই নগণ্য যে পুরুষতান্ত্রিক এ সমাজে তাদের ইতিহাসের ভারে বেশির ভাগ সময় তা চাপা পরে থাকে ।

এই প্রতিপাদ্য নিয়ে বর্তমান সময়ে নারীদের সন্মান,তাদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে সারা বিশ্বব্যাপী। নারী কি তবে ওই এক দিনের জন্য নারী হয়ে উঠে? ওই একটি দিন কি যথেষ্ট তাদের সন্মান প্রদর্শনের জন্য? অথচ এই নারীকে প্রতিনিয়তই লড়তে হয় পুরুষতান্ত্রিক সৌন্দর্যের রাজনীতির ও পুঁজিবাদী সৌন্দর্য ব্যবসার সাথে। যে রাজনীতি মেয়েদেরকে আরও আকর্ষণীয় করে তুলতে ব্যস্ত রাখে। ভুলিয়ে রাখে নিজের অধিকার বোধ থেকে, যেন তারা নিজেদের মেধা, সময়, সবকিছু চোখ বন্ধ করে ওই সৌন্দর্য চর্চার পেছনে খরচ করে স্বনির্ভরতার চিন্তা, নিজের অবস্থান থেকে দূরে থাকে।

তাই সব বাদ দিয়ে নারীকে যখন মানুষ হিসেবে দেখতে শিখবে তক্ষনি এ নারী দিবস, এ নারী অধিকার আন্দোলন, নারীবাদ কিছুরই প্রয়োজন থাকবে না। শুধু এক দিনের জন্য দেখনো সন্মানের চেয়ে বছরের বাকি তিনশত চৌষট্টি দিন যখন গুরুত্বপূর্ণ হবে, নারী পাবে তার যোগ্য সন্মান তখনিই কেবল নারী হয়ে উঠবে নারী, তক্ষুনি এ নারী দিবসের প্রতিপাদ্য হয়ে সার্থক।

কিন্তু তার পরেও আর একটি প্রশ্ন থেকে যায়। পিতৃতন্ত্র শেষ বিচারে পুরুষের আধিপত্য নহে, পৌরুষের আধিপত্য। পৌরুষের একটি বিশেষ ধারণার আধিপত্য। সেই ধারণার মূলে থাকে অন্যকে দমন করার প্রবল তাগিদ। এই মুহূর্তে গোটা দেশ জুড়ে যা চলছে তার অন্তরে নিহিত রহিয়াছে ‘মাচো’ অতিপৌরুষ। ছাতির মাপ তার বহিরঙ্গ রূপমাত্র, অন্তর্নিহিত আধিপত্যকামিতার গরল আরও অনেক বেশি ক্ষতিকর, তাকে ইঞ্চির মাপকাঠিতে ধরা অসম্ভব। জনসমাজেও এই উগ্র অতিপৌরুষের প্রভাব দ্রুত বাড়ছে, রাজনীতিক ব্যবসায়ীরা তা হইতে রসদ সংগ্রহ করছে এবং তাকেও লালনও করছে। এই দুষ্টচক্র ভাঙিতে না পারিলে, সমাজ ও রাজনীতিতে উদার সহমর্মিতার সুধর্মকে ফেরাতে না পারিলে পিতৃতন্ত্রই বিজয়ী হবে। ব্যক্তি-নারীর সাফল্যের মাত্রা যাই হউক না কেন।